কবি গুরু সমীপে

547

আমার ক্ষুদ্র মানব জীবনে যে কজন বাঙ্গালী মানব প্রভাব বিস্তার করিয়াছে তাহার ভিতর রবি বাবু অন্যতম। রবি বাবুর সহিত প্রথম পরিচিতি লাভ হয় আমার চার কি পাঁচ বৎসর বয়সে “আমাদের ছোট নদী” কবিতার মধ্য দিয়া।

কালের পরিক্রমায় সেই “ছোট নদী” কবিতা ছাড়াইয়া রবি বাবুর ছোট গল্প, উপন্যাস, নাটক, গীতিনাট্যে বিচরণ করিয়াছি। আর মনের অজান্তেই প্র্রেয়সীর পট আঁকিয়াছি রবি বাবুর “চারুলতা” চরিত্রটি দিয়া। সময় গতি যতই গড়াইয়াছে ততই মনপ্রকোষ্ঠের প্রতি কোণে আঁকিয়া গিয়াছি তাহাকে। প্রতিটি মূহুর্ত খুঁজিয়া ফিরিয়াছি তাহারে। মোর “মনদূয়ারী” তে কেহ কড়া নাড়িলে মিলাইয়া লইয়াছি সে “চারুলতার” সহিত কতটুকু খাপ খাইয়া থাকে। কোন মোহনিয়াকে দেখিয়া মন সামান্য আন্দোলিত হইলেও কবি গুরুর সেই নারী চরিত্রের সহিত মিলকরণ কখনো বন্ধ হয় নাই।

দীর্ঘকাল পরে কোন এক চৈত্রের সাঁজ বেলায় সম্পুর্ন অলৌকিকভাবে দেখা পাইয়া যাই মোর “চারুলতার”। একটি ছবির সামনে সে দাঁড়াইয়া ছিল। প্রথম দর্শনেই মোর মন গাহিয়া উঠিয়াছিল-

“আমারো পরাণ যাহা চায় তুমি তাই, তুমি তাই গো…।”

মোর মনের অবস্থা হইয়াছিল রবি বাবুর ভাষায়:

“সেই সুধাকণ্ঠের সোনার কাঠিতে সকল কথা যে সোনা হইয়া ওঠে। মেয়েটির সমস্ত শরীর মন যে একেবারে প্রাণে ভরা, তার সমস্ত চলায় বলায় স্পর্শে প্রাণ ঠিকরিয়া ওঠে। তাই মেয়েরা যখন তার মুখে গল্প শোনে তখন, গল্প নয়, তাহাকেই শোনে; তাহাদের হৃদয়ের উপর প্রাণের ঝরনা ঝরিয়া পড়ে। তার সেই উদ্ভাসিত প্রাণ আমার সেদিনকার সমস্ত সূর্যকিরণকে সজীব করিয়া তুলিল; আমার মনে হইল, আমাকে যে প্রকৃতি তাহার আকাশ দিয়া বেষ্টন করিয়াছে সে ঐ তরুণীরই অক্লান্ত অম্লান প্রাণের বিশ্বব্যাপী বিস্তার।”

অন্য খবর  নবাবগঞ্জের রহস্যঘেরা আন্ধারকোঠা

মোর চারুলতা ষোড়শী নহে, তরুণী। তবুও তাহার সৌন্দর্যের বর্ণনায় এই উপমা যেন শুধু তাহার ক্ষেত্রেই খাটে:

“এবার সেই সুরটিকে চোখে দেখিলাম। তখনো তাহাকে সুর বলিয়াই মনে হইল। মায়ের মুখের দিকে চাহিলাম; দেখিলাম তাঁর চোখে পলক পড়িতেছে না। মেয়েটির বয়স ষোলো কি সতেরো হইবে, কিন্তু নবযৌবন ইহার দেহে মনে কোথাও যেন একটুও ভার চাপাইয়া দেয় নাই। ইহার গতি সহজ, দীপ্তি নির্মল, সৌন্দর্যের শুচিতা অপূর্ব, ইহার কোনো জায়গায় কিছু জড়িমা নাই। আমি দেখিতেছি, বিস্তারিত করিয়া কিছু বলা আমার পক্ষে অসম্ভব। এমন-কি, সে যে কী রঙের কাপড় কেমন করিয়া পরিয়াছিল তাহাও ঠিক করিয়া বলিতে পারিব না। এটা খুব সত্য যে, তার বেশে ভূষায় এমন কিছুই ছিল না যেটা তাহাকে ছাড়াইয়া বিশেষ করিয়া চোখে পড়িতে পারে। সে নিজের চারি দিকের সকলের চেয়ে অধিক—রজনীগন্ধার শুভ্র মঞ্জরীর মতো সরল বৃন্তটির উপরে দাঁড়াইয়া, যে গাছে ফুটিয়াছে সে গাছকে সে একেবারে অতিক্রম করিয়া উঠিয়াছে।”

তাহাকে দেখিয়া মোর মনদুয়ারে যে তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি হইয়াছে তাহা বলার ভাষা আজও আমার জানা নাই। তাহাকে দেখিয়া বারবার মনে হইতেছিল “কেন সে শাড়ি পড়িয়া আসে নাই, কেন???” কল্পনায় মোর মন ক্যানভাসে আঁকিয়া লইলাম তাহার ছবি, “কপালে লাল টিপ, পড়নে শান্তিনীকেতনী ঘরনায় পরা সাদা জমিনে লাল পাড়ের শাড়ি। তাহার ডাগর ডাগর নয়নে ক্ষণিকের জন্য হারায়েছিলেম নিজের অবস্থান। প্রাণে বাজিয়া চলিতেছিল:

অন্য খবর  আজ ১৫ মার্চ;৭১ এর এইদিনে

“বঁধু কোন আলো লাগলো লাগলো চোখে বঁধু”

তাহার রূপমাধুরীতে আমার অবস্থা বড়ই সঙ্গিন:

“প্রাণ চায় চক্ষু না চায়”

ভরিয়া তাহাকে দেখিতে ছিলাম, এক পলকের জন্যও তাহার উপর হইতে চক্ষু সরাইতে সক্ষম হই নাই। একগোছা দোলনচাঁপা লইয়া কহিতে ব্যকুল হইয়াছিলাম:

“ভালোবাসি ভালোবাসি এই সূরে কাছে দূরে, জলে স্থলে বাঁজায়,

বাঁজায় বাঁশি ভালোবাসি ভালোবাসি”

দুহাত সম্মুখে প্রসারিত করিয়া কহিতে চাইয়াছি:

“বড় আশা করে এসেছিগো কাছে ডেকে লও” এখনও সেই ভালবাসা লইয়া দাঁড়ায়ে রইয়াছি। মরফিয়াসের বাঁশীর সুরেরও টলাইবার ক্ষমতা নাই মোরে। মন মোর গাহিয়া চলে: “মাঝে মাঝে তব দেখা পাই চিরকাল কেন পাইনা”

বিশ্বকবির প্রয়াণ দিবসে আমার শ্রদ্ধাঞ্জলি।

লেখক: নওয়াজেশ হোসাইন পাটোয়ারী

ছবি: ১৮৯০ সালে লন্ডনে

আপনার মতামত দিন