ছোটবেলায় স্বপ্ন ছিল সারা পৃথিবী ঘুরব। বড় হয়ে দেখতে পেলাম দেশটাই ঘোরা হয় নি। ভ্রমণের লক্ষ্য দুনিয়া থেকে কমিয়ে বাংলাদেশে সীমিত করলাম- দেশের সব জেলায় ঘুরব। এখন দেখি সেই সময়ও নেই, টাকাও নেই। সময় পেলে দেশ ভ্রমণের টাকা তবু ব্যবস্থা করা যায়। তাই ভ্রমণদুনিয়া ছোট করে আনলাম আরও। নিজের দুটো উপজেলার সব গ্রামে অন্তত একবার করে পা দিয়ে আসব। এটা হয়তো সম্ভব।

পৃথিবী ভ্রমণ না করার আক্ষেপ মেটাতে অন্যের ভ্রমণের আশ্রয় নিব ঠিক করলাম। পৃথিবীর সব দেশের ভ্রমণ কাহিনী পড়ব এবং সেই বিশ্ব ভ্রমণ কাহিনীর বই নিজের সংগ্রহে থাকবে। মানে আলমারিতে সব দেশের অন্তত একটা করে ভ্রমণ বই থাকবে। আলমারিতে থাকতে বইগুলোর আবশ্যক বৈশিষ্ট্য হল বাংলাদেশী লেখকের ভ্রমণ কাহিনী হতে হবে। কোনো দেশের ভ্রমণ কাহিনী বাংলদেশী লেখকের না পাওয়া গেলে ভারতীয় বাংলা লেখকের হলে চলবে। কোনো বাঙালির লেখা বই একেবারেই না পাওয়া গেলে অনুবাদ রাখা যাবে, তবু সব দেশ পূর্ণ করতে হবে।

আমি চাচ্ছি বাংলাদেশীদের দৃষ্টিতে পৃথিবী দেখতে। বিদেশী লেখকদের অনেক আকষর্ণীয় ভ্রমণ কাহিনী হয়তো পাওয়া যাবে, কিন্তু সেখানে আমার দেশের মানুষের অনুভূতির প্রকাশ থাকবে না তাই দেশী লেখকরের বাধ্যবাধকতা। সব দেশের ভ্রমণ কাহিনী পাওয়া যাবে না তা নিশ্চিৎ। যদিও পৃথিবীর সব দেশেই বাংলাদেশীদের পা পড়েছে, কিন্তু সবাই বই লিখে নি। সবার হয়তো লেখার মানসিকতা বা দক্ষতা নেই। তাই গত এক বছরের বেশি সময় ধরে খুঁজেও অনেক দেশের ভ্রমণ কাহিনী পাওয়া যায় নি। এমন কিছু পাওয়া গিয়েছে এক বইতে একাধিক দেশের ভ্রমণ কাহিনী রয়েছে।

অন্য খবর  আজ ১৬ মার্চ;৭১ এর এই দিনে

ভ্রমণ কাহিনী পড়ার সবচে’ বড় চ্যালেঞ্জ হল লেখার মান। শত শত বইয়ের ভীরে মানসম্মত ভ্রমণ কাহিনী পাওয়া আসলে মুশকিল। বাংলা সাহিত্যের প্রতিথযশা অনেকে ভ্রমণ কাহিনী লিখেছেন, তাদের লেখা দিয়ে বিশ্ব ভরতে পারলে ভাল হত। কিন্তু তারা খুব বেশি দেশ ভ্রমণ করেন নি।

সৈয়দ মুজতবা আলী ভ্রমণ সাহিত্যে মানদণ্ড প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছেন বলা চলে। আফগানিস্তান, মিশর, জার্মানি, মালদ্বীপের অনবদ্য বিবরণ পেয়েছি তার কাছে যার মাধ্যমে ভ্রমণ সাহিত্যে ধ্রুপদী ধারা সৃষ্টি হয়েছে। তিনি যে সময় ভ্রমণ করছেন সে সময় উপমহাদেশের মানুষ ভ্রমণ করত কম। তবু এই সময়ের কিছু প্রতিথযশা লেখকদের ভ্রমণ কাহিনী আমরা পেয়েছি। যেমন, সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বুদ্ধদেব বসু, হরিপ্রভা দেবী, পৃন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁ, এস ওয়াজেদ আলী, সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী, কেদারনাথ বন্দোপাধ্যায়, শেখ হাবিবর রহমান ইত্যাদী লেখকদের বর্ণনায় ভ্রমণ কাহিনী শুধু ভ্রমণ কাহিনী নয় একটা সময়ের ধারক। দুঃখজনক যে সেই সময়ের সব বই এখন আর প্রকাশিত হয় না।

স্নায়ুযুদ্ধের দিনগুলোতে বিবাদমান দেশগুলো বিভিন্ন দেশের কবি, লেখক, সাহিত্যিকদের আমন্ত্রণ জানাত তাদের দেশ ভ্রমণ করতে। কবি জসিম উদ্দিনের সহজ সরল বর্ণনা, মানুষের সাথে মেশার আকুতি, ভাষা বাধা পেরিয়ে মানুষের সাথে মিশে যাওয়ার কাহিনীগুলো পড়ে মনে হয় তিনি যদি আরও বেশি ভ্রমণ করতেন। তার লেখা পড়ে আজকের লেখকরা যদি বাহুল্য ও ইতিহাসের জবরজং বর্ণনা বাদ দিয়ে সহজ ভাবে লিখতে শিখতেন।

এই যুগের লেখকদের ভ্রমণ কাহিনী পড়তে খুব কষ্ট হয়, পৃষ্ঠা এগুনোই দুরূহ হয়ে উঠে। কেও কেও লেখায় সাহিত্যরস ঢালতে গিয়ে এতো অলঙ্কার যুক্ত করেন যে বাহুল্যদোষে সেই বই ভারী হয়ে যায়। কারো কারো লেখায় ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ অতিরিক্ত বর্ণনা করেন। এক লেখিকার ব্যাগের চাবি হারিয়ে গিয়েছিল, সেই চাবি হারানো ও খুঁজে পাওয়ার দুর্ধর্ষ বর্ণনা পড়তে বিরক্তি ধরে গিয়েছিল। কেও কেও ইতিহাসে এতো বিস্তারিত বর্ণনা করতে থাকেন যে ইতিহাস পড়ছি নাকি ভ্রমণ কাহনী পড়ছি সেটা আর বোঝে উঠা যায় না। ইতিহাস আমরা ইন্টারনেটে খোঁজ নিলেই জানতে পারি। ইতিহাস আমি পুরো বাদ দিতে বলি না, ভ্রমণ কাহিনীতে কিছু ইতিহাস থাকতে হয়, তবে সেটা যা সচারচর বইয়ে পাওয়া যায় না বা স্থানীয়দের মুখে শোনা। ইতিহাস ছাড়াও যে ভ্রমণ যে মধুরপাঠ্য হতে পারে তা জানা যায় হুমায়ুন আহমেদ পড়লে।

অন্য খবর  তুরস্ক ভ্রমণ - সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী

বর্তমান সময়ের এক বিখ্যাত প্রকৌশলী লেখক এক ঐতিহাসিক ভবনের দৈর্ঘ্য প্রস্থের এতো বিবরণ দিয়েছেন তার কিছুই কি আমরা মনে রাখতে পারব, শুধু লিখলেই হত, “সে এক বিশাল দালান!” সেই দৈর্ঘ্য প্রস্থের হিসাব কবেই ভুলে গিয়েছি।

আর কিছু লেখক বইয়ের এমন দাম ধরেন মনে হয় তার ভ্রমণের বিমান ভাড়া, হোটেল ভাড়া পুরোটাই পাঠককে বহন করতে হবে। এই সময়ের লেখকদের মধ্যে মঈনুস সুলতান বইয়ের দাম ছাড়া আর সব দিক দিয়ে ব্যালান্সড।

এইসব ছাকুনিতে ছেঁকে বাংলা সাহিত্য থেকে দেশ ভিত্তিক বিশ্ব ভ্রমণ কাহিনী-র তালিকা করছি যা  এই লিংকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। সব দেশ পাওয়া যাচ্ছে না, আবার কোনো কোন দেশের খুব বেশি আছে, যেমন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, চীন, রাশিয়া ইত্যাদি। 

আপনার মতামত দিন