২৫ ডিসেম্বর বড়দিন। বিশ্বব্যাপী কোটি কোটি খ্রিস্টধর্মাবলম্বী ভক্তের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব, যা পশ্চিমা বিশ্বে ক্রিসমাস হিসেবে পরিচিত। পাপে নিমজ্জিত মানব জাতিকে মুক্তি দিতে দুই হাজারেরও বেশি বছর আগে ঈশ্বর তাঁর একমাত্র পুত্রকে মানুষ হিসেবে এ জগতে প্রেরণ করেন- মানুষকে ভালোবেসে মানবরূপ ধারণ করে মানুষের মধ্যে বাস করতে এবং সময় পূর্ণ হলে মানুষকে পাপের দাসত্ব থেকে মুক্ত করতে ক্রুশে মৃত্যুও মধ্য দিয়ে নিজের জীবন উৎসর্গ করতে।

ঈশ্বর এ জগতকে ও তাঁর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষকে এতই ভালোবাসলেন যে নিজ পুত্রকে তিনি অকাতরে দান করলেন। এর মাধ্যমে বহু বছর পূর্বে প্রবক্তা বা নবীগণের মুখে উচ্চারিত প্রতিশ্রুতির ভাববাণী ঈশ্বর পূর্ণ করলেন। ঘোর অমানিশায় উদিত হলো নতুন সূর্য, হতাশা-নিরাশার পৃথিবীতে জন্ম হলো আশার, রচিত হলো মানুষের প্রতি ঈশ্বরের ভালোবাসার পরম নিদর্শন, এক অসামান্য প্রেমগাঁথা। ঈশ্বরের এই অনবদ্য প্রেমের ঘটনা, তাঁর পুত্র যীশু খ্রিস্টের মানুষ হিসেবে জন্ম গ্রহণের কথাকে স্মরণ করেই প্রতি বছর মহাসমারোহে বড়দিন উৎসব পালন করা হয়।

যীশুর মানবদেহ ধারণ ও মানুষের মধ্যে বাস করা প্রমাণ করে মানুষের প্রতি সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বরের অকৃত্রিম ভালোবাসা। ঈশ্বরপুত্র হয়েও গোয়াল ঘরে যাবপাত্রে জন্মগ্রহণ মানব ইতিহাসে অসামান্য ও অদ্বিতীয় নম্রতার নিদর্শন স্থাপন করেছেন।

বাইবেল বলে, “তিনি তো স্বরূপে ঈশ্বর হয়েও ঈশ্বরের সঙ্গে তাঁ সমতুল্যতাকে আঁকড়ে থাকতে চাইলেন না বরং নিজেকে তিনি রিক্ত করলেন, দাসের স্বরূপ গ্রহণ কওে তিনি মানুষের মতো হয়েই জন্ম নিলেন (ফিলিপ্পীয় ২:৫-৮)।” মানুষের মধ্য দিয়েই  ঈশ্বরের মহান ও শ্বাশত প্রেম সবার কাছে প্রকাশিত হয়েছে। তাই তো জীবনবোধ ও মানবিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আধ্যাত্মিক রসবোধ ও আনন্দে আপ্লুত হয়ে গেয়েছেন-

“তাই তোমার আনন্দ আমার ’পর
তুমি তাই এসেছ নিচে
আমায় নইলে, ত্রিভুবনেশ্বর,
তোমার প্রেম হত যে মিছে।”

অন্য খবর  স্মৃতির আড়ালে নবাবগঞ্জের সন্তান অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক

স্রষ্টার সৃষ্টির এই প্রেমের প্রকাশ আনন্দের মধ্যে ও নতুন সৃষ্টি বিকাশে। জীবনের আনন্দরসের চেতনা স্বয়ং স্রষ্টার, সৃষ্টির মধ্যে তার প্রকাশ ও বিকাশ। তাঁর প্রেমময় সত্তায় আছে জীবন, আছে মহাশান্তি। জীবনে পূর্ণতা আনার জন্য ও পরমানন্দের অংশীদার হবার আকাংক্ষা বড়দিনের মনো-চেতনার অন্যতম অনুসঙ্গ।

শান্তি ও আনন্দের অনুভূতি নিয়ে অন্তরলোক আলোকিত করে প্রতি বছরই উদযাপন করা হয় যীশু খ্রিস্টের জন্মোৎসব ‘বড়দিন’। বিশ্বের সর্বত্রই বড়দিন অতি পরিচিত, জনপ্রিয় ও আনন্দোৎসব হিসেবে বিবেচিত। পরিবর্তনশীল মননে বড়দিনের উৎসবময়তায় এসেছে পরিবর্তনের ছোঁয়া। এই বড়দিনের আয়োজনে বিশ্বম-লের মানুষ ব্যস্ত হবে উৎসবের আনন্দে হৃদয়পাত্র পূর্ণ করায়। বাইবেলীয় ঘটনায় যীশু অতি দীনহীনভাবে নিঝুম শীতের রাতে গোয়াল ঘরে যাবপাত্রে জন্ম নিয়েছিলেন। একখ- বস্ত্রে জড়িয়ে নবজাত ত্রাণকর্তাকে তাঁর জননী মেরী শীতের প্রকোপ থেকে রক্ষার প্রয়াস চালিয়েছিলেন।

ঈশ্বরপুত্রের মানবরূপে পরিগ্রহণে ন্ম্রতার যে অভূতপূর্ব নির্দশন ফুটে উঠে, তা আমাদের আহ্বান জানায় হৃদয়ের নম্র ও বিনয়ী হবার। যে রাতে যীশুর জন্ম হয় সে রাতে উৎসবের কোন আয়োজন ছিলো না। তবে দেবলোকের আনন্দ সঙ্গীতের সাথে সুর মিলিয়ে রাখাল ও পন্ডিতেরা এসেছিল খ্রিস্টকে প্রণাম জানাতে, উপহার দিতে। স্বর্গদূত বাহিনীর আনন্দধ্বনি শুনে রাখালরা খ্রিস্টের জন্মের প্রথম দর্শক ও প্রথম জন্মোৎসবকারী ভক্ত হিসেবে মানবত্রাতা শিশু যীশুর করকমলে ভক্তির অঞ্জলি নিবেদন করে।

এরপর প্রাচ্যদেশের তিনজন পন্ডিত মুক্তিদাতার জন্ম লক্ষণ হিসেবে আকাশে উদিত উজ্জল তারা দেখে এসেছিল রাজাধিরাজকে সম্মান ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতে। সেই আনন্দ সংবাদ, মুক্তিদাতার জয়গানে জগৎ আজ মুখরিত।

খ্রিস্ট সর্বজনীন। তাঁর প্রেম, তাঁর মুক্তিদায়ী কাজও সর্বজনীন। খ্রিস্টধর্ম তাই সর্বজনীনতার ধর্ম। কেউ ধর্ম নিয়ে জন্মায় না। মানবধর্ম কিংবা সমাজধর্মে তাকে দীক্ষা নিতে হয়। সে যে ধর্মেরই হোক না কেন, মানব ধর্মই তার প্রথম ধর্ম। সে ‘মানুষ’ এটাই তার প্রথম  ও প্রধান পরিচয়। মানবতাবোধ না থাকলে কোন ধর্ম পালনই যথার্থ হয় না। এই বোধ সব ধর্মের সার হওয়ার আহ্বান, শ্রেষ্ঠতম আহ্বান। এটা সর্বজনীন আহ্বান।

অন্য খবর  ইতিহাসের এই দিনে: ২৭ জুন

খ্রিস্ট মানবতাকে সামনে এনে ধর্মীয় গোঁড়ামী, কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসকে বারংবার তিরস্কার করেছেন। নিয়ম-সর্বস্ব ও মৌলবাদী শাস্ত্রী, ফরিশী ও ধর্মনেতাদের অন্যায্য ও অমানবিক আচরণের কঠোর সমালোচনা করেছেন।

তিনি এসেছিলেন মানুষকে মুক্ত করতে। পাপ কালিমা আর অসত্যের ঘোর অন্ধকারে মানুষ যখন আচ্ছন্ন, মোহাবিষ্ট তখনই খ্রিস্ট এলেন আলো হয়ে। এই আলো মানুষের প্রয়োজন ছিলো। অনেকেই সেই আলোতে জীবনে সঠিক পথের সন্ধান পেলো। কিন্তু কিছু অকৃতজ্ঞ মানুষ তাঁকে চিনতে না পেরে প্রত্যাখ্যান করলো। জগতের পাপের বোঝা বয়ে তিনি ক্রুশের উপরে প্রাণ দিলেন, মানুষের প্রতি ভালোবাসার চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে নিজের হত্যাকারীদের জন্য উচ্চারণ করলেন ক্ষমার বাণী। সৃষ্টি করলেন অনন্য আদর্শ, যা যুগে যুগে কালে কালান্তরে অনুকরণীয়। খ্রিস্টের আদর্শে জীবনে আলোকিত মানুষ হবার প্রেরণায় নশ্বর দেহ নয় বরং অবিনশ্বর আত্মার সৌন্দর্য বর্ধনের চেতনাই বড়দিনের অঙ্গীকার।

বড়দিনের আনন্দ চেতনা সর্বদা সুন্দর সহভাগিতাময় উপলব্ধিতে তাৎপর্যমন্ডিত। কেননা বড়দিন হলো মুক্তি, ক্ষমা ও আত্মশুদ্ধি, সর্বোপরি ভালোবাসার উৎসব। আত্মার সৌন্দর্য হলো ক্ষমা, ক্ষমার ফল মিলন এবং মিলনের আনন্দোৎসবই হলো বড়দিন। এই মহোৎসবের আনন্দ ও মাহাত্ম্য দিয়ে জীবন নতুনভাবে শুরু করা যায় এবং পূর্ণতার জন্য আজীবন সাধনা করে যেতে হয়। ক্যালেন্ডারের পাতায় বড়দিন যেভাবে উজ্জ্বল বর্ণে চিহ্নিত থাকে, তেমনি করে বড়দিনের আনন্দধ্বনি জ্বলজ্বল করে জ্বলুক সবার হৃদয়ে। বড়দিনের উৎসবমুখরতার মাঝে অকৃত্রিম প্রেমে প্রতিবেশী মানুষকে ‘ভাই-বন্ধু’ বলে বুকে টেনে নিতে পারলে সার্থক হবে আমাদের জীবনে ঈশ্বরের প্রেমের মহাকাব্য, গড়ে উঠবে ভালোবাসার মিলন সমাজ॥

– রক রোনাল্ড রোজারিও: লেখক ও সাংবাদিক

আপনার মতামত দিন