সমাজসেবা বা সামাজিক কার্যক্রম একটি কল্যাণমূলক কাজ। দুনিয়াবী দৃষ্টিতে সমাজসেবা সর্বজন সমর্থিত ও স্বীকৃত একটি মহত্ কর্ম হিসেবে পরিগণিত। তবে ইসলামের দৃষ্টিতে সমাজসেবা ইবাদত বলে গণ্য। জাতিসংঘের সংজ্ঞা অনুযায়ী ব্যক্তি ও তার পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্য বিধানে সহায়তা দানের লক্ষে গৃহীত ও সংগঠিত কাজের সমষ্টিকে সমাজসেবা বলা হয়। এই দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে মানবসম্পদ উন্নয়ন, সংরক্ষণ ও সমস্যা প্রতিরোধকল্পে গৃহীত ও সংগঠিত যাবতীয় কর্মকাণ্ড সমাজসেবার অর্ন্তভুক্ত। তবে ইসলামের দৃষ্টিতে সমাজসেবার পরিধি আরো ব্যাপক। দরিদ্র ও নিরীহ মানুষকে সাহায্য করা, ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্তকে খাদ্য ও পানীয় দান, বিধবাকে সাহায্য করা, অসুস্থ বা অসমর্থ মানুষের সেবা করা, আশ্রয়হীনকে আশ্রয় দান, বস্ত্রহীনকে বস্ত্র দান, অসচ্ছ মানুষের দারিদ্র বিমোচন, মানুষের সুবিধার জন্য রাস্তা-ঘাট ও সেতু নির্মাণ, বৃক্ষরোপণ, পরিবেশের উন্নয়ন, সস্ত্রাস নির্মূল, সামাজিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষা ইত্যাদি প্রতিটি কাজ সমাজসেবার অর্ন্তগত। মহান আল্লাহ এসব কর্মকে ঈমানদারদের জন্য একান্ত করণীয় হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা সত্কর্ম ও আল্লাহ ভীতির কাজে পরস্পরকে সহযোগিতা করো এবং পাপ ও সীমা লঙ্ঘের কাজে পরস্পরকে সহযোগীতা কর না।’ (সূরা মায়েদা : ২)
মানবজাতির পথপ্রদর্শক মুহাম্মদ (সা.) নবুয়তের আগে ও পরে এ মহান কাজে তত্পর ছিলেন। মহানবী (সা)-এর বয়স তখন ২৫ বছর। তিনি মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দূর করা, সাহায্যপ্রার্থীকে সহযোগীতা করা, মজলুমকে সাহায্য করা, জুলুমকারীকে শায়েস্তা করা এবং দেশে শান্তি বজায় রাখার জন্য গঠন করেন কল্যণসংস্থা ‘হিলফুল ফুজুল।’ ৪০ বছর বয়সে মহানবী (সা) হেরা গুহায় নবুয়ত লাভ করলেন। এ সময় তিনি ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বাড়িতে আসেন এবং স্ত্রী খাদিজা (রা)-এর কাছে তাঁর জীবন নিয়ে শঙ্কার কথা জানালেন। খাদিজা (রা) স্বামীকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ‘আল্লাহর কসম! আল্লাহ আপনাকে কখনোই অপমানিত করবেন না। আপনি তো আত্মীয়-স্বজনের সাথে সদ্ব্যবহার করেন, অসহায়-দুর্বলের দায়িত্ব বহন করেন, নিঃস্বকে সাহায্য করেন। মেহমানের সমাদর করেন এবং দুর্দশাগ্রস্তকে সাহায্য করেন।’
খাদিজা (রা)-এর এই কথার মাধ্যমে মহানবী (সা)-এর সেবাকর্ম সম্পর্কে জানা যায়, যা তিনি প্রতিনিয়ত সম্পন্ন করতেন।
পবিত্র কোরআন ও হাদিসে মানবগোষ্ঠীর সেবার ওপরও জোর তাগিদ প্রদান করা হয়েছে। কোরআনের ভাষ্য হচ্ছে, ‘তোমরা আল্লাহর ইবাদত করবে ও কোনো কিছুকে তাঁর সঙ্গে শরিক করবে না এবং মা-বাবা, আত্মীয়স্বজন, এতিম, অভাবগ্রস্ত, নিকট প্রতিবেশী, দূর প্রতিবেশী, সঙ্গী-সাথী, পথচারী এবং তোমাদের অধিকারভুক্ত দাস-দাসীদের প্রতি সদ্ব্যবহার করবে। নিঃসন্দেহে আল্লাগ দাম্ভিক ও অহঙ্কারীকে পছন্দ করেন না, যারা কৃপণতা করে, মানুষকে কৃপণতার নির্দেশ দেয় এবং আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদের যা দিয়েছেন, তা গোপন করে।’ (সুরা আন-নিসা, হাদিস : ৩৬-৩৭)
মহানবী (সা) সামাজিক সেবাকে জেহাদের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি একদা বলেন, ‘যারা বিধবা এবং গরীবের উন্নতির জন্য কাজ করে তারাই যেন আল্লাহর পথে জেহাদের মতোই কাজ করল।’ তিনি বলেন, ‘তোমরা দান কর, সাহায্য কর এবং নিজেদের আগুন থেকে রক্ষা কর, সে দিন পর্যন্ত যখন তোমরা সামান্যতম সময়ও পাও।’
মহানবী (সা.) তাঁর অনুসারীদের বিভিন্ন সময় দান ও বদান্যতা সমপর্কে উত্সাহিত করতেন। তিনি আরো বলেছেন, ‘যে কেউ কোনো ঈমানদারের দুঃখ দূর করবে আল্লাহ বিচারের দিন তার একটি কষ্ট লাঘব করে দেবেন। যে কেউ কোন গরীব বা অভাবি মানুষের অভাব দূর করবে আল্লাহ দুনিয়া ও আখিরাতে তার অনেক সমস্যা দূর করে দেবেন। যে কেউ কোনো মুসলমানকে আশ্রয় দেবে আল্লাহ এখানে ও পরপারে তাকে আশ্রয় দেবেন। যে তার ভাইকে সাহায্য করে আল্লাহও তাকে সাহায্য করবেন।’ (সহিহ বুখারি)
সমাজসেবামূলক কাজ পরকালে অনেক মূল্যবান আমল হিসেবে বিবেচিত হবে বলে রাসুল (সা.) মন্তব্য করেছেন। তিনি সাহাবিদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমি কি তোমাদের রোজা, নামাজ ও সদকার চেয়ে মর্যাদাবান আমলের সংবাদ দেবো?’ সাহাবিরা বলেন, হ্যাঁ। রাসুল (সা.) বলেন, ‘মানুষের মধ্যে সমঝোতা করে দেওয়া। কেননা, মানুষের মধ্যকার বিশৃঙ্খলা ধ্বংসাত্মক।’ (মুসনাদে আহমদ : ২৭,৫০৮)
সমাজসেবার অন্যতম একটি কাজ রোগীর খোঁজ-খবর নেওয়া। মহানবী (সা.) এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘যখন কোনো ব্যক্তি কোনো রোগীকে দেখতে যায়, আসমানে তখন একজন প্রার্থনাকারী প্রার্থনা করতে থাকে, তুমি সুখী হও, তোমার পথচলা বরকতময় হোক, তুমি জান্নাতে স্থান লাভ কর।’ (মুসনাদে আহমদ : ১৪১২)