” আমার বাবা, হায়াত আলী মিঞা: আলোর পথের দিশারী”

1222

“আমার বাবা, হায়াত আলী মিঞা: আলোর পথের দিশারী” লিখাটি শ্রদ্ধেয় মরহুম হায়াত আলী স্যারের কনিষ্ঠ কণ্যা ও ইউনিসেফ বাংলাদেশের এডুকেশন অফিসার তানিয়া লাইজু সুমি’র একটি আত্মসৃতিচারণ মূলক প্রবন্ধ। এই প্রবন্ধটি একজনের মেয়ের তার পরম ভালোবাসার পিতাকে নিয়ে লিখা।  news39.net এই প্রবন্ধটি তানিয়া লাইজু সুমির ফেসবুক থেকে সংগ্রহ করেছে। পাঠকদের উদ্দেশ্যে তা তুলে ধরা হলো।

আজ থেকে প্রায় আট যুগ আগের কথা, সময়টা ছিল ১৯৪৩ সাল। তখন সারা বিশ্বে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা। আজকের বাংলাদেশ, তৎকালীন ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতবর্ষের দোহারের ঘরে ঘরে আলোর বাতি জ্বলে ওঠেনি, বিদ্যুতের আলো যেমন নয়, শিক্ষার আলোও নয়। এই দোহারেই অবস্থিত; জয়পাড়া থেকে অনতিদূরত্বে কুসুমহাটি ইউনিয়নের একটি ছোট সুন্দর গ্রাম, চরকুশাই। অন্য অনেক গ্রামের মতোই ঠিক ছায়া সুনিবিড় আর শান্তির নীড় ধরনের। সেই গ্রামেরই একটি বড় বাড়ির (তৎকালীন তালুকদার বাড়ি এবং পরবর্তীতে মাদবর বাড়ি নামে পরিচিত) ছোট্ট ঘরে জন্ম নিলেন এক শিশু। বাবা তোরাব আলী মিঞা ও মা সৈয়দুন্নেসা আদর করে ছেলের নাম রাখলেন হায়াত; যেন ছেলের দীর্ঘ জীবনের প্রত্যাশা নিয়েই এই নামকরণ। অত্যন্ত আকর্ষণীয় এ শিশু বাবা-মায়ের চতুর্থ ছেলে হিসেবে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠতে থাকে পরিবারের মধ্যে। ছোটবেলা থেকেই সহোদর ও খেলার বন্ধুদের মধ্যে তাকে ঠিক আলাদা করা যেত। কিছুটা জেদ, কিছুটা নেতৃত্ব এবং অনেকটাই ভালোবাসার ক্ষমতা এই শিশুকে অন্যদের মধ্যে আলাদা এক অবস্থান দিয়েছিল। ধীরে ধীরে এই শিশুই বড় হয়ে সমাজের একজন উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব হয়ে সবার মাঝে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, সবার ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন। হ্যাঁ, আমি জনাব হায়াত আলী মিঞা মহোদয়ের কথাই বলছি; যিনি তাঁর এই জীবনে শিক্ষার প্রদীপ হাতে নিয়ে আলো বিতরণ করেছেন হাজার হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে। যাদের অনেকে আজ দেশে-বিদেশে স্ব-অবস্থানে নিজেদের ও দেশের মুখ উজ্জ্বল করছে।

দেখতে সুদর্শন, রাশভারি, কিন্তু অসম্ভব স্নেহপ্রবণ এ মানুষটি আমার জন্মদাতা, আমার বাবা, আমার শিক্ষাগুরু ও অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব। আমার হাতেখড়ি হয়েছিল তাঁর কাছেই। জীবনের প্রথম বর্ণ লেখাটি আমি তাঁর কাছেই শিখেছিলাম। ‘‘ব থেকে বক” দিয়েই শুরু হয়েছিল আমার বর্ণ ও শব্দ শেখা । আমার মতো আমার ভাই-বোনদেরও একইভাবে শুরু হয়েছিল বর্ণ ও শব্দ পরিচয়। এখনো চোখ বন্ধ করলে দিনগুলো হাতছানি দেয়। তখন ছিলনা কোনো আধুনিক প্রযুক্তি, ছিলনা কোনো ট্যাব, মোবাইল কিংবা কম্পিউটার; ছিল বাবা এবং মা নামক শিক্ষাকেন্দ্র ও সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত এমন প্রযুক্তি যারা আমাদের আজকের পরিচয়ে প্রতিষ্ঠিত হতে এগিয়ে দিয়েছেন। এই নাতিদীর্ঘ লেখায় আমার বাবার জীবনের খুব কম অংশই হয়তো লিখতে পারব; অলিখিত রয়ে যাবে তাঁর জীবনের অনেক অনেক কথা।

অন্য খবর  দোহারের পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে আপনি কি বিব্রত?

১৯৪৩ সালের ০৬ জানুয়ারি জন্ম নেওয়া জনাব হায়াত আলী মিঞা বেড়ে উঠেছেন তাঁর নিজস্ব গ্রাম চরকুশাইয়ে। গ্রামের পাঠশালা পেরিয়ে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় জয়পাড়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে। নিজ বাড়ি থেকে অনেকটা দূরত্ব থাকা সত্ত্বেও কিশোর হায়াত তার পড়ালেখার বিষয়ে এতটুকু ছাড় দেননি। অনেক প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও হাঁটি হাঁটি পা পা করে তিনি পৌঁছে গেছেন বিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ শ্রেণিতে। ১৯৫৯ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে কৃতকার্য হয়েছেন। এরপর পরিবারের অনিচ্ছ্বা উপেক্ষা করে মনে অনেক স্বপ্ন নিয়ে পাড়ি জমিয়েছেন ঢাকার পথে। কিছুই চিনতেন না তিনি। কিন্তু, বুকে ছিল সাহস আর মনে ছিল স্বপ্ন। জীবনে কিছু ভালো মানুষ আর বন্ধুর দেখা পেয়েছেন তিনি যারা তাঁকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে সহায়তা করেছেন। পড়ালেখার খরচ নিজেই জুগিয়েছেন প্রাইভেট টিউশন করে। কষ্ট করেছেন, কিন্তু পিছপা হননি এতটুকু। অদম্য উৎসাহ আর চেষ্টায় তিনি ১৯৬১ সালে আইএ পাশ করেন তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ থেকে। এরপরই একই কলেজে ভর্তি হন বিএ কোর্স এ।

কলেজে পা দিতেই যুবক হায়াত আলী মিঞাকে যে বিষয়টি প্রচণ্ডভাবে আকর্ষণ করেছিল, তা হলো রাজনীতি। ১৯৪৭ থেকে ৫২ এবং ক্রম চলমান আন্দোলন, অনেক কিছুই দেখেছেন তিনি। মিছিল, মিটিং, আলোচনা, স্বাধীনতা… তাঁকে খুব টানতো। তাইতো তখন ছাত্র রাজনীতি র সাথে জড়িয়ে পড়েন তিনি। পড়ালেখার পাশাপাশি চলতে থাকে তার রাজনীতি। প্রাতিষ্ঠানিক পাঠের বাইরেও জ্ঞান অর্জনের নেশা তাঁকে পেয়ে বসে। যার জন্য সারাজীবন তিনি পাঠ্যবইয়ের বাইরের পড়াই বোধ করি বেশি করে পড়েছেন, শিখিয়েছেন তাঁর আত্মজাদেরও। মিটিং মিছিল করেও তিনি পেরিয়ে গেলেন গ্র্যাজুয়েশনের দরজা এবং পা রাখলেন প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম.এ পড়ার জন্য। একই সাথে যোগ দেন শিক্ষকতা পেশায়। তাঁর আনুষ্ঠানিক কর্মজীবন শুরু ১৯৬৪ সালে গেণ্ডারিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে। দুই বছর পরই তিনি যোগ দেন জয়পাড়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে। চাকরি ও পড়ালেখা তিনি চালিয়ে গেছেন একই সাথে সব্যসাচীর মতো। তিনি ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্র বিজ্ঞানে স্নাতোকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর কষ্টার্জিত শিক্ষা জীবনে শিক্ষক হওয়ার ব্রত নিয়েই বরাবর সামনের দিকে অগ্রসর হয়েছেন, তাই জীবনে অনেক আকর্ষণীয় হাতছানি তিনি মুহূর্তে উপেক্ষা করতে পেরেছেন।

অন্য খবর  একাদশ নির্বাচন নিয়ে প্রবল ঘূর্ণিঝড় আসছে

জীবনের প্রথমে রাজধানী থেকে কর্মজীবন শুরু করলেও নিজের এলাকার ডাক, নিজের বিদ্যালয়ের ভালোবাসা তাঁকে ছুটে যেতে বাধ্য করেছে। সন্তান হিসেবে তাঁর এ টান আমি আজও দেখতে পাই। প্রথমে সহকারি শিক্ষক হিসেবে যোগদান করলেও পরবর্তীতে ১৯৭২ সালে তিনি প্রধান শিক্ষক হিসেবে বিদ্যালয়ের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন এবং ২০০৮ সাল পর্যন্ত প্রায় চল্লিশ বছর জয়পাড়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন যোগ্যতা ও সুনামের সাথে। শিক্ষকতা পেশায় থেকে তিনি ক্রমাগত তাঁকে ধাপে ধাপে যোগ্য করে তুলেছেন জ্ঞানে, দক্ষতায়, নেতৃত্বে। বি.এডসহ বিভিন্ন ধরনের পেশাগত প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, যুক্ত হয়েছেন বাংলাদেশ ক্রীড়া সংস্থা, রোয়িং ফেডারেশন, ফুটবল ফেডারেশনসহ বিভিন্ন সংস্থা ও এসোসিয়েশনের সাথে। তাঁর নেতৃত্বে জয়পাড়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের তাৎপর্যপূর্ণ আঙ্গিক ও গুণগত পরিবর্তন উল্লেখযোগ্য। দোহার উপজেলার শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর অবদান অনুস্বীকার্য।

সবার প্রিয় শিক্ষক, জনাব হায়াত আলী মিঞা আমাদের মুক্তিযুদ্ধে মানিকগঞ্জ জেলার হরিরামপুর থানার থানা-কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি প্রতিহত করেছেন অনেক অন্যায় ও অনিয়মকে। নিজের হাতে তৈরি করেছেন অনেক ছেলেমেয়ের জীবন। নিজের সুখের চিন্তা না করে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন অন্যের প্রয়োজনে। ছেলেবেলা থেকে আমি দেখেছি আত্মীয়, অনাত্মীয়, পরিচিত, অর্ধপরিচিতদের আমাদের বাড়িতে বেড়ে উঠতে ও পড়ালেখা করতে।

বাবা কখনো নিজের পরিবারের বাজার করার টাকা, কিংবা কোনো প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার টাকা তুলে দিয়েছেন অন্যের বই কিনতে বা পরীক্ষার ফি জমা দিতে। জীবন নিয়ে কখনো হিসেব করতে দেখিনি তাঁকে। জীবনের এই পড়ন্ত বিকেলে এসে যখন সময়ের সাথে বদলে নিতে হয়েছে নিজের শারিরীক যোগ্যতাকে, মনকে বদলে দিতে দেননি এতটুকু। প্রচণ্ড শারিরীক কষ্ট-ব্যথা ও পরিবর্তনকে বরণ করেছেন অদম্য শক্তি ও সাহসের সাথে। সময় তাঁর কাছ থেকে হয়তো হেঁটে বেড়ানোর শক্তি কেড়ে নিয়েছে প্রকৃতির নিয়মে, কমিয়ে দিয়েছে চোখের জ্যোতি, অস্পষ্ট করে দিয়েছে শব্দ; কিন্তু মনের জোর কমায়নি এতটুকু। এখনো দৃঢ় কণ্ঠে বলেন, ‘‘ভালো আছি।” তাঁর সেই উদাত্ত ডাক, ‘‘এই ছেলেরা…” হয়তো এখনো শুনতে পায় তাঁর শত সহস্র ছেলের দল। তাইতো দেশ-বিদেশ থেকে আজও তাঁর ছেলেরা খবর নেয় তাঁর, ছুটে আসে তাদের ‘‘হেডস্যার” এর সাথে দেখা করতে। নিজের প্রতিষ্ঠিত চার মেয়ে ও দুই ছেলের বাইরেও তাই হাজার হাজার ছেলেমেয়ের ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, সম্মান সিক্ত করে রাখে তাঁকে অহর্নিশি।”

আপনার মতামত দিন