ক্যালকুলাসের প্রথম আবিষ্কারক নিউটন নাকি লিবনিজ?

651
Zahid Hasan Mithu: বিজ্ঞানের হাজার বছরের ইতিহাসে অনেক তত্ত্বই যুগপৎভাবে আবিষ্কৃত হয়েছে। যেমন- মাইকেল ফ্যারাডে ও জোসেফ হেনরির ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ইন্ডাকশন আবিষ্কার ছিল সমসাময়িক। এরপর চার্লস ডারউইন ও আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস একই সময়ে ‘প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তন’ তত্ত্বের ধারণা প্রদান করেন।

এমন অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। কিন্তু সেগুলোর একটিও আইজ্যাক নিউটন ও গটফ্রেড লিবনিজের ক্যালকুলাস তত্ত্বের মতো বিতর্কিত হয়নি। বর্তমানে নিউটন ও লিবনিজ দুজনকেই ক্যালকুলাসের জনক বলা হয়। কিন্তু একসময় এই তত্ত্ব নিয়ে দুই গণিতবিদ বিবাদে জড়িয়ে পড়েন। তাদের দুজনের মধ্যে কে সবার আগে ক্যালকুলাস আবিষ্কার করেছেন, সেটি ছিল বিবাদের মূল কারণ। এই বিতর্ককে ঘিরে বেশ কাঁদা ছোঁড়াছুড়ি হয়েছিল, যেটা বেশ কয়েক বছর চলমান ছিল।

গণিতের বিতর্কিত এক অধ্যায়ের সাথে জড়িয়ে আছে নিউটন ও লিবনিজের নাম; Image Source: Raizde2

ব্যারো নামে আইজ্যাক নিউটনের একজন শিক্ষক ছিলেন। তিনি ক্যালকুলাস সম্পর্কে প্রাথমিকভাবে কিছু ধারণা প্রদান করেন। কিন্তু তিনি তখন ক্যালকুলাসের তাৎপর্য বুঝতে পারেননি। সেই কারণে তিনি এই বিষয়ে তেমন গুরুত্ব দেননি এবং তার প্রাথমিক ধারণাগুলোও জনসম্মুখে প্রকাশ করেননি। কিন্তু নিউটন যেহেতু ব্যারোর ছাত্র ছিলেন, সেই সূত্রে তিনি তার শিক্ষকের কাছে থেকে ক্যালকুলাসের সামান্য কিছু ধারণা পান। পরবর্তীতে তিনি তার শিক্ষকের দেয়া ধারণাকে কাজে লাগিয়ে ক্যালকুলাসের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব আবিষ্কার করেন।

কিন্তু আইজ্যাক নিউটন প্রথম থেকেই কিছুটা প্রচারবিমুখ ছিলেন। তিনি তার আবিষ্কৃত বিভিন্ন তত্ত্ব জনসম্মুখে প্রকাশ করতে পছন্দ করতেন না। একই কাজ তিনি ক্যালকুলাসের ক্ষেত্রেও করেন। সপ্তদশ শতকের ষাটের দশক থেকে তিনি ক্যালকুলাস নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করেন এবং ১৬৬৪-৬৬ সালের মধ্যে তিনি ক্যালকুলাসের মূল বিষয়গুলো আবিষ্কার করতে সক্ষম হন। এরপর নিউটন ১৬৬৯, ১৬৭১ ও ১৬৭৬ সালে ক্যালকুলাস নিয়ে ৩টি আলাদা গবেষণাপত্র লেখেন। কিন্তু তিনি সেগুলোর একটিও সেই সময়ে প্রকাশ করেননি। ১৬৬৯ সালে তিনি যে তত্ত্ব লেখেন, সেটি প্রকাশ হয় ১৭১১ সালে, অর্থাৎ ৪২ বছর পর। দ্বিতীয় গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয় ১৭৩৬ সালে, তার মৃত্যুরও ৯ বছর পর। তবে সর্বশেষ তত্ত্বকোষটি তিনি ১৭০৪ সালে প্রকাশ করেন।

স্যার আইজ্যাক নিউটন; Image Source: openculture.com

অষ্টাদশ শতকের আগে ক্যালকুলাস নিয়ে নিউটনের কোনো তত্ত্বই জনসম্মুখে প্রকাশ হয়নি। তবে ১৬৮৪ সালে লেইপজিগ সাময়িকীতে তিনি ক্যালকুলাস নিয়ে ‘অ্যাক্টা এরুডিটোরাম‘ নামে একটি অসমাপ্ত গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। এছাড়া তিনি তার আবিষ্কৃত তত্ত্বসমূহ গোপনে বন্ধুদের মাঝে চিঠি আকারেও বিলি করতেন। এই চিঠিগুলোর একটি লিবনিজও পেয়েছিলেন। তবে সেই চিঠিতে নিউটন ক্যালকুলাস সম্পর্কে যা লিখেছিলেন, সেটি পুরো অস্পষ্ট ছিল। এছাড়া অনেক বিষয় তিনি ইচ্ছা করে এড়িয়ে যান, যাতে কেউ তার তত্ত্ব চুরি করতে না পারে। অন্যদিকে, সপ্তদশ শতকের সত্তরের দশকের মাঝামাঝিতে লিবনিজও ক্যালকুলাস আবিষ্কার করতে সক্ষম হন। ১৬৭৪ সালে তিনি ক্যালকুলাস নিয়ে তার চিন্তাভাবনাকে প্রকাশ করতে শুরু করেন এবং ১৬৮৪ তিনি এই বিষয়ে লিখিত আকারে তত্ত্ব প্রকাশ করেন। কিন্তু তার ছয় পৃষ্ঠার সেই তত্ত্বটি বেশ অস্পষ্ট এবং অনেকের কাছে বোধগম্য ছিল না। তবে সেই সময়ে  ক্যালকুলাস নিয়ে তার তত্ত্বটি সঠিক ছিল।

অন্য খবর  প্রাচীন উপমহাদেশের সবচেয়ে উঁচু মঠ বিক্রমপুরের শ্যামসিদ্ধির মঠ
গটফ্রেড লিবনিজ Image Source: The Independent

বিতর্কের আদ্যোপান্ত

প্রথমদিকে নিউটন ও লিবনিজ দুজনেই একে অপরকে ক্যালকুলাসের আবিষ্কারক হিসেবে সম্মান করতেন। কিন্তু তাদের একজন বন্ধু বিখ্যাত দুই গণিতবিদকে মুখোমুখি দাঁড় করান। ১৬৯৬ সালে লিবনিজের একজন বন্ধু নিউটনকে তার ক্যালকুলাস তত্ত্ব নিয়ে চ্যালেঞ্জ করে বসেন। তিনি ভেবেছিলেন, নিউটন তার  উত্থাপিত সমস্যার সমাধান করতে পারবেন না। কিন্তু নিউটন ও লিবনিজ উভয়ই সেই সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম হন। কিন্তু এই ঘটনার পর লিবনিজ এক প্রবন্ধে নিউটনের এক বন্ধুকে উদ্দেশ্য করে বলেন, তিনি ক্যালকুলাসের আবিষ্কারক এবং এ বিষয়ে নিউটন তার শিষ্য। নিউটনের বন্ধু বিষয়টি পুরোপুরি হজম করতে পারেননি। তিনি বেশ রাগের সাথে পূর্বে উত্থাপিত সমস্যার বিচার বিশ্লেষণ তুলে ধরেন এবং পরোক্ষভাবে লিবনিজের বিরুদ্ধে নিউটনের লেখা চুরির অভিযোগ করেন।

তিনি প্রমাণ হিসেবে বহু বছর আগে লিবনিজের কাছে ক্যালকুলাস নিয়ে নিউটনের পাঠানো চিঠিকে সামনে আনেন। কিন্তু মূলত সেই চিঠিতে নিউটন ক্যালকুলাস নিয়ে নিজের তত্ত্বের বিষয়ে স্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যাই প্রদান করেননি। এরপর বেশ কয়েক বছর এই বিষয়টি চাপা পড়ে ছিল। কিন্তু ১৭০৫ সালে লিবনিজ নিউটনের ক্যালকুলাস সম্পর্কিত কিছু কাজ রিভিউ করে নিজেদের দুজন বিজ্ঞানীর সাথে তুলনা করেন, যারা উন্নততর কিছু আবিষ্কারের উদ্দেশ্য জুটি বেঁধেছিলেন। কিন্তু নিউটনের একজন বন্ধু লিবনিজের এই বিষয়টিকে লেখা চুরির নতুন ফন্দি হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন। সম্ভবত লিবনিজ যে দুজন বিজ্ঞানীর উদাহরণ টেনেছিলেন, তারা একে অপরের তত্ত্ব চুরি করেছিলেন।

লন্ডনের বিখ্যাত রয়্যাল সোসাইটি; Image Source: royalsociety.org

এই ঘটনার কিছুদিন পরেই নিউটনের সেই বন্ধু লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটি থেকে একটি দলিল প্রকাশ করেন এবং সেখানে তিনি নিউটনকে সন্দেহাতীতভাবে ক্যালকুলাসের আবিষ্কারক হিসেবে ঘোষণা করেন। সেই সাথে তিনি লেখেন, লিবনিজ নিউটনের তত্ত্ব চুরি করেছেন এবং কিছু কাটছাঁট করে নিজের নামে তা প্রকাশ করেছেন। এই বিষয়টি লিবনিজের জন্য ছিল চরম অপমানজনক। তিনি বেশ ক্রুদ্ধ হয়ে রয়্যাল সোসাইটি বরাবর চিঠি লিখে ক্ষমা চাইতে বলেন। কিন্তু ক্ষমা তো দূরে থাক, প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে লিবনিজকে প্রতি আক্রমণ করে চিঠি পাঠানো হয় এবং সেখানে তার প্রতি সমস্ত অভিযোগের বিস্তারিত তুলে ধরা হয়। জবাবে অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত চেয়ে লিবনিজ আরো একটি চিঠি পাঠান।

অন্য খবর  মিজানুর রহমান শমশেরীর দুটি কবিতা

রয়্যাল সোসাইটি লিবনিজের দাবির পক্ষে সাড়া দেয়। তারা একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। সেই সময়ে রয়্যাল সোসাইটির সভাপতি ছিলেন আইজ্যাক নিউটন। আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি সেই কমিটির সদস্য হিসেবে না থাকলেও, তদন্ত কমিটি যে  প্রতিবেদন প্রকাশ করে, সেটি পুরোপুরি তার পক্ষে ছিল। সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে, তদন্ত প্রতিবেদনটি নিউটন নিজ হাতে লিখেছিলেন। সেখানে তিনি নিজেকে ক্যালকুলাসের আবিষ্কারক হিসেবে তুলে ধরেন এবং লিবনিজ তার তত্ত্ব চুরি করেছেন বলে প্রতিবেদনে লেখেন।

এ নিয়ে রয়েছে অনেক রম্য কার্টুন; Image Source: Marek Bennett

লিবনিজ ও তার বন্ধুদের জন্য এটি ছিল অনেক বড় পরাজয়। তারা নিউটনের বিপক্ষে বিভিন্ন প্রমাণ সংগ্রহ করে নিজেদের দাবির পক্ষে লিফলেট প্রকাশ করে প্রচার করেন। এর বেশ কয়েক বছর পরও গণিতশাস্ত্রের অন্যতম সেরা দুই বিজ্ঞানী একে অপরের বিপক্ষে অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ অব্যাহত রাখেন এবং পূর্বে প্রকাশিত যুক্তিতর্কগুলো পরিমার্জন করে প্রকাশ করতে থাকেন। এমনকি লিবনিজের মৃত্যুর পরও তার বিরুদ্ধে নিউটনের তত্ত্ব চুরির অভিযোগের উপর বিভিন্ন যুক্তিতর্ক ও প্রমাণ প্রচার করা হয়।

এত বিতর্কের পরও বিংশ শতাব্দীর পূর্ব পর্যন্ত নিউটন ও লিবনিজ উভয়কে ক্যালকুলাসের আবিষ্কারক হিসেবে মানা হতো। কিন্তু গত শতাব্দীতে এসে বিজ্ঞানীরা একমত হন যে, নিউটন সর্বপ্রথম ক্যালকুলাস আবিষ্কার করেছেন। তিনি ১৬৬৫-৬৬ সালে দিকে ক্যালকুলাস আবিষ্কার করেন। তবে লিবনিজ নিউটনের সাথে কোনো যোগাযোগ ব্যতিরেকে নিজ প্রচেষ্টায় ১৬৭৫-৭৬ সালে ক্যালকুলাসের মূল নীতিসমূহ আবিষ্কার করেন।

ক্যালকুলাস বিতর্ক নিয়ে ট্রল; Image Source: YouTube

তবে দিন শেষে প্রকৃত বিজয় হয়েছে লিবনিজেরই। কারণ নিউটন যে ক্যালকুলাস আবিষ্কার করেছিলেন, সেটি ছিল বড্ড সেকেলে। ফলে সেটি ইতোমধ্যে জাদুঘরে স্থান পেয়েছে। তবে লিবনিজের ক্যালকুলাস ছিল বাস্তবভিত্তিক। বর্তমানে স্কুল-কলেজে যে ক্যালকুলাস চর্চা করা হয়, তার শতকরা ১০০ ভাগই লিবনিজের আবিষ্কৃত ক্যালকুলাস। ফলে তিনি ক্যালকুলাসের দ্বিতীয় আবিষ্কারক হলেও তার সৃষ্টিকর্মই স্থায়ীত্ব লাভ করেছে।

https://roar.media/bangla/main/history/who-is-the-inventor-of-calculus-leibniz-or-newton/

আপনার মতামত দিন