মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানে কেমিক্যাল পল্লি স্থাপন করা হচ্ছে। সম্প্রতি পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর এ সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এর আগে ৫০ একর জমিতে এটি কেরানীগঞ্জে কেমিক্যাল পল্লি গড়ে তোলার কথা থাকলেও এলাকটি জনবহুল হওয়ায় সিরাজদিখানকে বেছে নেওয়া হয়েছে। কেমিক্যাল পল্লির জন্য এখন জমির পরিমাণ বাড়িয়ে ৩১০ একর করা হয়েছে। এ জন্য ১ হাজার ৬৪৮ কোটি ৯০ লাখ টাকা ব্যয়ে সংশোধন করা হচ্ছে ‘বিসিক কেমিক্যাল পল্লি’ প্রকল্পটি।
প্রক্রিয়াকরণ শেষে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদন পেলে চলতি বছর থেকে ২০২২ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। এটি বাস্তবায়ন করবে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রকল্পটির দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিকল্পনা কমিশনের শিল্প ও শক্তি বিভাগের সদস্য (সচিব) শামীমা নারগিস জানান, গত ৩১ মার্চ প্রথম সংশোধনী প্রস্তাবের ওপর প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় বেশকিছু সুপারিশ করে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) পুনর্গঠন করার জন্য শিল্প মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এখনো সংশোধিত ডিপিপি পরিকল্পনা কমিশনে আসেনি। হাতে পেলেই পরবর্তী প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে।
পরিকল্পনা কমিশনের একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, পুরান ঢাকাকে নিরাপদ সরকার কাজ করছে। এরই অংশ হিসেবে কেমিক্যাল পল্লিতে ২ হাজার ১৫৪টি প্লট তৈরি করা হবে। ফলে ঢাকা মহানগরীর বিশেষ করে পুরনো ঢাকার কেমিক্যাল কারখানা ও গোডাউনগুলো একটি পরিবেশবান্ধব এবং অপেক্ষাকৃত কমজনবহুল স্থানে স্থানান্তর করা সম্ভব হবে। এ জন্য সকল প্রকার অবকাঠামোগত সুযোগ সুবিধা সম্বলিত একটি কেমিক্যাল পল্লি গড়ে তোলা হচ্ছে। যেখানে প্রায় ২০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে অগ্নি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) অবদান রাখবে।
শিল্প মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ৪ হাজার কেমিক্যাল গোডাউন রয়েছে। এসব কেমিক্যাল বিস্ফোরক জাতীয় এবং অত্যন্ত দাহ্য পদার্থ হওয়ায় এসব গোডাউন কারখানা সংলগ্ন এলাকায় আবাসিক বসবাসের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
২০১০ সালের ৩ জুন পুরানো ঢাকার নবাব কাটরার নিমতলিতে অবস্থিত কেমিক্যাল গোডাউন সংঘটিত দুর্ঘটনার বহু হতাহতসহ সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি হয়। এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধসহ আবাসিক এলাকা থেকে কেমিক্যাল কারখানা গোডাউন অপসারণের জন্য ঢাকার কেরানীগঞ্জে ৫০ একর জমিতে আধুনিক সুযোগ সুবিধা সম্বলিত একটি বিসিক কেমিক্যাল পল্লি স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ জন্য মোট ২০১ কোটি ৮১ লাখ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে ২০১৮ সালের জুলাই হতে ২০২১ সালের জুনে বিসিক কেমিক্যাল পল্লি ঢাকা শীর্ষক প্রকল্পটি ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবর অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক)।
প্রকল্পের প্রধান কার্যক্রম হচ্ছে, ৩১০ একর ভূমি অধিগ্রহণ, ১৭৮ দশমিক ৯০ বর্গমিটার অফিস ভবন নির্মাণ, ৪৬ দশমিক ৫০ বর্গ মিটার পাম্প ড্রাইভার কোয়ার্টার, ২টি মেইন গেট, একটি ফায়ার সার্ভিস ইউনিট, ৫ হাজার ৭৩০ মিটার শিল্প নগরীর সীমানা প্রাচীর, ৩২৬ বর্গফুট পুলিশ ফাঁড়ি, ৩টি নলকূপ স্থাপন, ৩১ হাজার ৩২৫ মিটার পানির লাইন, ৩১ হাজার ৯৪০ মিটার বিদ্যুৎ লাইন, ৬ হাজার মিটার গ্যাস লাইন, দুটি জেটি নির্মাণ, একটি সিইটিপি ও ডাম্পিং ইয়ার্ড ও ইনসিনেরেটর এবং ১৮৫ দশমিক ৮৬ বর্গমিটার পুকুর পাড়ে প্যালাসাইটিং নির্মাণ করা হবে।
অন্যদিকে যতদিন এই কেমিক্যাল পল্লি স্থাপন না হচ্ছে ততদিন পুরান ঢাকাকে নিরাপদ করতে অস্থায়ী ভিত্তিতে স্থাপন করা হচ্ছে ৫৪টি কেমিক্যাল গোডাউন। পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ডে অধিক সচেতনতার অংশ হিসেবে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
ঢাকার কদমতলীর শ্যামপুরে এসব গুদাম নির্মাণের লক্ষ্যে ‘অস্থায়ী ভিত্তিতে রাসায়নিক দ্রব্য সংরক্ষণের জন্য গুদাম নির্মাণ’ নামের একটি প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে পরিকল্পনা কমিশনে। এটি বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ৭৯ কোটি ৪১ লাখ টাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে জনগণের নিরাপত্তার স্বার্থে রাসায়নিক দ্রব্যাদি নিরাপদ স্থানে সংরক্ষণ করা, পুরনো ঢাকার ঝুঁকিপূর্ণভাবে সংরক্ষিত রাসায়নিক পদার্থগুলো দ্রুত স্থানান্তর নিরাপদ সংরক্ষণের জন্য গুদাম নির্মাণ এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বিভিন্ন দাহ্য পদার্থের নিরাপদ সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। প্রক্রিয়াকরণ শেষে একনেক বৈঠকে অনুমোদন পেলে চলতি মাস থেকে ২০২০ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি)।
পরিকল্পনা কমিশনের একাধিক কর্মকর্তা জানান, প্রকল্পটি চলতি অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) অন্তর্ভূক্ত নেই। কিন্তু রাষ্ট্রীয় অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় অত্যন্ত দ্রুততম সময়ে গত ১৪ মার্চ পিইসি সভা করা হয়েছে। বর্তমানে একনেক বৈঠকে উপস্থাপনের চূড়ান্ত প্রস্তুতি রয়েছে। প্রকল্পের আওতায় প্রধান কার্যক্রমগুলো হচ্ছে, ৫৪টি গুদাম নির্মাণ, গুদাম সংশ্লিষ্টদের জন্য দুটি অফিস ভবন নির্মাণ, বিসিআইসি’র জন্য একটি অফিস ভবন ও মসজিদ তৈরি, ১ লাখ গ্যালন ধারণ ক্ষমতার একটি আন্ডার গ্রাউন্ড পানির ট্যাংক নির্মাণ, ১ হাজার লিটার বা ঘণ্টা শোধন ক্ষমতা সম্পন্ন দুটি ইটিপি স্থাপন, ৯টি ফায়ার হাইড্রান্টসহ স্বয়ংক্রিয় অগ্নি নির্বাচন ব্যবস্থা স্থাপন, ৩০টি সিসি ক্যামেরা ও অনলাইন মনিটরিং সিস্টেম স্থাপন, এক লাখ ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন একটি ওভারহেড পানির ট্যাংক, বৈদ্যুতিক সাবস্টেশন-ট্রান্সফরমান-জেনারেটর, রাস্তা, ড্রেন ও বাউন্ডারি ওয়াল নির্মাণ প্রভৃতি।