আগামী জাতীয় নির্বাচনে ঢাকায় নিরঙ্কুশ আধিপত্য ধরে রাখতে মরিয়া দেশের প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি।এ লক্ষ্যে নানা হিসাব-নিকাশ, চুলচেরা বিশ্লেষণ ও পরিকল্পনার ছক কষছেন দুই দলের হাইকমান্ড। এক্ষেত্রে জনপ্রিয় প্রার্থী বাছাইকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছেন তারা।
জানা গেছে, অর্ধেক আসনে আওয়ামী লীগ এবার প্রার্থী পরিবর্তন করবে। অন্যদিকে প্রার্থী বাছাইয়ে চমক দেখানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি। তবে অনেকে নিজের নির্বাচনী এলাকায় ভিড়তে না পেরেও প্রার্থী হতে চাচ্ছেন রাজধানীর আসনগুলোয়।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের একাধিক নেতা জানান, ভোটারদের মন জয় করে বিজয়ী হওয়ার মতো জনপ্রিয় কেন্দ্রীয় ও নগর রাজনীতিতে প্রভাবশালীদের ঢাকার ২০টি আসনে প্রার্থী করা হবে।
আওয়ামী লীগ নেতারা আরো বলেন, রাজধানীর দক্ষিণে প্রভাবশালীদের বেছে নেয়া হবে। উত্তরে একটু পরিশীলিত প্রার্থী দেয়া হবে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরবর্তী সময়ে দেশজুড়ে নাশকতা প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে শুধু রাজধানী আওয়ামী লীগের দখলে থাকায়।
এ কারণে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকার ২০টি আসন কিভাবে ধরে রাখা যায় তা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ চালাচ্ছে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ড। দশম নির্বাচনে ঢাকায় মহাজোট শরিকদের পাঁচটি আসনে ছাড় দিলেও আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচনে দুই থেকে তিনটি আসনের বেশি ছাড় দেবে না আওয়ামী লীগ।
এদিকে আগামী একাদশ জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে ঢাকার নির্বাচনী আসনগুলোতে চমক দেখাতে চায় বিএনপি। এতে পাল্টে যেতে পারে বিএনপির ঢাকার বেশ কয়েকটি আসনের প্রার্থী তালিকা।
২০০৮ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের যোগ্যতা ও দুর্বলতাকে বিবেচনা করে এসব প্রার্থী বদল হবে বলে জানা গেছে। এছাড়া অনেক নেতার মৃত্যু ও নিষ্ক্রিয়তার কারণেও জনপ্রিয় নতুন প্রার্থীদের দেখা যাবে আগামী নির্বাচনে। সে জন্য ঢাকা মহানগর শীর্ষ নেতাদের মধ্যে ভেতরে ভেতরে চলছে প্রতিযোগিতা। যে যার অবস্থানে নিজেদের ধরে রাখার জন্য অবতীর্ণ হচ্ছেন নানা কৌশলে।
জানা গেছে, প্রার্থী পরিবর্তনের ইঙ্গিতের প্রেক্ষিতে সব আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশীরা ইতোমধ্যে এলাকাভিত্তিক গণসংযোগ এবং নেতাকর্মীদের নিয়ে দলীয় কর্মসূচি পালন ও বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করছেন। এর পাশাপাশি দলের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি করে গুলশান অফিস ও নয়াপল্টন অফিসে যাতায়াত বাড়িয়ে দিয়েছেন। ব্যবহার করছেন ফেইসবুক, টুইটারসহ যোগাযোগের সব মাধ্যম। আর এসব মাধ্যমে আগামী নির্বাচনে নিজের প্রার্থিতার বিষয়ে প্রচারণা চালাচ্ছেন।
ঢাকা-১ (দোহার ও নবাবগঞ্জ) জাতীয় পার্টির (জাপা) সঙ্গে জোট না থাকলে এ আসনে প্রার্থী দেবে আওয়ামী লীগ। বর্তমান এমপি জাতীয় পার্টির নেতা সালমা ইসলাম।
আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীর তালিকায় আছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি খাত উন্নয়ন বিষয়ক উপদেষ্টা ও বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান, দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুল মান্নান খান। স্বেচ্ছাসেবক লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি নির্মল রঞ্জন গুহ। সেই সাথে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পনিরুজ্জামান তরুন ও মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী স্মৃতি কণা।
এ আসনে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুুল মান্নান মনোনয়ন পেতে পারেন। তবে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও ঢাকা জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক, নবাবগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান খন্দকার আবু আশফাক ও মনোনয়ন চাইবেন বলে জানা গেছে। সেই সাথে ভিপি কামালও মনোনয়ন চাইবেন বলে জানা গেছে।
ঢাকা-২ (কেরানীগঞ্জ-কামরাঙ্গীরচর) খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম এমপির আসনে মনোনয়ন পেতে নির্বাচনী মাঠে নেমেছেন কেরানীগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান ও থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহিন আহমেদ।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমান এবারও এই আসন থেকে বিএনপির মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচনে লড়বেন বলে তার অনুসারীরা জানান। তবে কোনো কারণে তাকে দেওয়া না হলে কামরাঙ্গীচর থানা বিএনপির সভাপতি মনির হোসেন রয়েছেন এ তালিকায়।
ঢাকা-৩ (কেরানীগঞ্জ) আওয়ামী লীগের একক প্রার্থী বিদ্যুত্ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু। এখানে তেমন বিকল্প প্রার্থী নেই। এ আসনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ও তার মেয়ে বিএনপির প্রান্তিক জনশক্তি উন্নয়ন বিষয়ক সহ-সম্পাদক অপর্ণা রায় দলের মনোনয়ন প্রত্যাশী।
ঢাকা-৪ (শ্যামপুর-কদমতলী) বর্তমান এমপি জাতীয় পার্টির (জাপা) নেতা সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা। স্থানীয় আওয়ামী লীগ এই আসনে দলীয় প্রার্থী চান। এখানে প্রার্থী হতে চান আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর সাবেক সহকারী একান্ত সচিব ড. আওলাদ হোসেন, অ্যাডভোকেট সানজিদা খানম ও শ্যামপুর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি তোফাজ্জল হোসেন। এই আসনে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব প্রকট।
২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন মুন্সীগঞ্জের সাবেক এমপি আবদুল হাই। আগামী নির্বাচনে তিনি আবারো মুন্সীগঞ্জ থেকেই মনোনয়ন পেতে পারেন। এভাবে কাজও করেছেন তিনি। অন্যদিকে বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য সাবেক এমপি সালাহউদ্দিন আহমেদের ছেলে তানভির আহমেদ রবিন এই এলাকায় সাংগঠনিক অবস্থান শক্তিশালী করার পাশাপাশি নিজের অবস্থানকেও মজবুত করেছেন। সেই হিসেবে তাকে এবার মনোনয়ন দেওয়া হতে পারে।
ঢাকা-৫ (ডেমরা-যাত্রাবাড়ী) বর্তমান এমপি আওয়ামী লীগের হাবিবুর রহমান মোল্লা। বয়সের ভারে এবার বাদ পড়ার আশঙ্কায় মনোনয়ন পেতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন বৃহত্তর ডেমরা থানা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমানে যাত্রাবাড়ী থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশীদ মুন্না।
বর্তমান এমপিপুত্র ডেমরা থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মশিউর রহমান সজলও এ আসনে মনোনয়নের জন্য কাজ করছেন। এ আসনে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার অংশগ্রহণ করার কথা রয়েছে। তা সম্ভব না হলে সাবেক এমপি সালাউদ্দিন আহমেদ এ আসন থেকে মনোনয়ন নিয়ে লড়বেন। কেন্দ্রীয় গণশিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক অধ্যক্ষ সেলিম ভুঁইয়া এবং ২০ দলীয় জোট শরিক বিজেপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব আব্দুল মতিন সাউদও মনোনয়নের প্রত্যাশায় তত্পরতা চালাচ্ছেন।
ঢাকা-৬ (সূত্রাপুর-কোতোয়ালি) দলীয় প্রার্থী দিতে পারে আওয়ামী লীগ। বর্তমান এমপি জাতীয় পার্টির (জাপা) নেতা কাজী ফিরোজ রশিদ। এ আসনে নগর নেতাদের দৃষ্টি বেশি। এখানে প্রার্থী হতে পারেন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহে আলম মুরাদ। এছাড়া এ আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীর তালিকায় আছেন মহানগরের সিনিয়র সহ-সভাপতি আবু আহমেদ মান্নাফি, সাংগঠনিক সম্পাদক হেদায়েতুল ইসলাম স্বপন, ওয়ারী থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি চৌধুরী আশিকুর রহমান লাভলু, সূত্রাপুর থানার সভাপতি হাজী মো. শাহিদ।
এ আসনে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা। মামলা ও অসুস্থতার কারণে দেশে ফিরতে না পারলে তার ছেলে ইশরাক হোসেন মনোনয়ন চাইবেন। এছাড়া ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কাজী আবুল বাশারও মনোনয়ন প্রত্যাশী।
ঢাকা-৭ (লালবাগ-চকবাজার) বর্তমান এমপি হাজী মোহাম্মদ সেলিম। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করেন তিনি। এখন আওয়ামী লীগের এমপি হিসেবে পরিচিত সেলিম। শারীরিক সমস্যার কারণে একাদশ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন থেকে বঞ্চিত হতে পারেন তিনি।
এখানে মনোনয়ন দৌড়ে আছেন বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) সভাপতি মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, নগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক মোহাম্মদ আকতার হোসেন, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি হুমায়ুন কবির।
২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি থেকে প্রার্থী হয়েছিলেন সাবেক এমপি কারাবন্দি নাসিরউদ্দিন আহমেদ পিন্টু। বিগত ওয়ান-ইলেভেনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল থেকে আমৃত্যু তিনি জেলে ছিলেন। তার অকাল শূন্যতায় সহধর্মিণী ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সহ-সভাপতি নাসিমা আক্তার কল্পনা মনোনয়ন চাইবেন। মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে আরো রয়েছেন-বিএনপির সহ-যুববিষয়ক সম্পাদক মীর নেওয়াজ আলী নেওয়াজ, পিন্টুর ভাই নাসিমউদ্দিন আহমেদ রিন্টু, মহানগর দক্ষিণের সহ-সভাপতি মীর আশরাফ আলী আজম, বিএনপির ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ড. তুহিন মালিক।
ঢাকা-৮ (রমনা-মতিঝিল) বর্তমান এমপি বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন। বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে এবারও মহাজোটের প্রার্থী হবেন রাশেদ খান মেনন।
তবে এ আসনে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী অনেক নেতার দৃষ্টি আছে। সম্ভাব্য প্রার্থী ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহে আলম মুরাদ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোল্লা আবু কাউসার, দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাঈল চৌধুরী সম্রাট, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা বাহালুল মজনুন চুন্নু, বাহাদুর বেপারি, আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন, সাবেক কমিশনার কামাল চৌধুরী, মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম আশরাফ তালুকদারসহ অনেকে।
বিএনপি থেকে বরাবরই অংশ নিয়ে আসছেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস। কারাগারে থাকার কারণে গত নির্বাচনে অংশ নিতে না পারায় ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি হাবিবুন্নবী খান সোহেলকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এ আসনটি মির্জা আব্বাসের থাকায় আগামী নির্বাচনে তিনি এখান থেকে মনোনয়ন আশা করছেন।
ঢাকা-৯ (মুগদা-সবুজবাগ) বর্তমান এমপি আওয়ামী লীগের সাবের হোসেন চৌধুরী। আগামী নির্বাচনে এ আসনে মনোনয়ন পেতে চান সাবেক ছাত্রনেতা গিয়াস উদ্দিন পলাশ, আনিসুর রহমান আনিস, আলমগীর চৌধুরী ও আশরাফুজ্জামান ফরিদ। গত নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী হয়েছিলেন জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শিরিন সুলতানা। তবে মির্জা আব্বাস তার সহধর্মিণী ও মহিলা দলের সভাপতি আফরোজা আব্বাসের জন্য মনোনয়ন চাইবেন বলে জানা গেছে।
ঢাকা-১০ (ধানমন্ডি) আওয়ামী লীগের একক প্রার্থী ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস এমপি। নির্বাচনী এলাকায় সব ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন তিনি। এখানে আওয়ামী লীগ বিকল্প প্রার্থী বিবেচনা করছে না। ২০০৮ সালে বিএনপির প্রার্থী হয়েছিলেন সাবেক এমপি ও সিনিয়র আইনজীবী খন্দকার মাহবুবউদ্দিন আহমদ। তার মৃত্যুতে এবার ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক শেখ রবিউল আলম রবি মনোনয়ন প্রত্যাশী। বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী তালিকায় আরো রয়েছেন বিএনপির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক সম্পাদক নাসিরউদ্দিন অসীম, সাবেক কমিশনার আবদুল লতিফ। এছাড়া এ আসনে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের স্ত্রী ডা. জোবাইদার বড় বোন বিন্দুর প্রার্থিতা নিয়েও গুঞ্জন রয়েছে। সূত্র: ইত্তেফাক