সুদান: সভ্য মানুষ চিরতরে মুছে দিল প্রকৃতির এক নিযুত বয়সী প্রাণ

487
সুদান: সভ্য মানুষ চিরতরে মুছে দিল প্রকৃতির এক নিযুত বয়সী প্রাণ

কয়েক মিলিয়ন বছর ধরে পৃথিবীতে গন্ডারের বসবাস। অসংখ্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ, প্রতিকূল জলবায়ু কিংবা রোগ-বালাই মোকাবেলা করে তারা টিকে আছে পৃথিবীর বুকে। হাজার হাজার বছর ধরে যে প্রাণীগুলো এসব প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা পেরিয়ে টিকে আছে, সেই প্রাণীগুলোই একে একে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে মানুষ নামক সভ্য সমাজের কারণে। সর্বশেষ গত ১৯ মার্চ উত্তরাঞ্চলীয় পুরুষ শ্বেত গন্ডারটির মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এই উপ-প্রজাতিটির বিলুপ্তিও এক প্রকার নিশ্চিত হয়ে গেল।

কে এই সুদানঃ  ৪৫ বছর বয়সী উত্তরাঞ্চলীয় শ্বেত গন্ডারটির নাম ছিল সুদান। এর জন্ম আনুমানিক ১৯৭৩ বা ১৯৭৪ সালে দক্ষিণ সুদানের এক জঙ্গলে। এক বা দুই বছর বয়সে তাকে সমগোত্রীয় আরো কয়েকটি প্রাণীর সাথে আটক করে নিয়ে যাওয়া হয় তৎকালীন চেকোস্লোভাকিয়ার দাভুর ক্রালোভ চিড়িয়াখানাতে। পরবর্তীতে ২০০৯ সালে একে কেনিয়ার ওআই পেজেটা  তত্ত্বাবধানকেন্দ্রে স্থানান্তর করা হয়। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত সুদান সেখানেই দুটি নারী গন্ডারের সাথে অবস্থান করছিল। এদের একটি হচ্ছে ২৭ বছর বয়সী নাজিন, অন্যটি ১৭ বছর বয়সী ফাতু। একটি তার মেয়ে, অন্যটি নাতনী।

কীভাবে সুদানের মৃত্যু ঘটলঃ মৃত্যুকালে সুদানের বয়স হয়েছিল ৪৫ বছর, যা ৯০ বছর বয়সী মানুষের সাথে তুলনীয়। বয়সজনিত কারণে সুদানের শরীরে নানা জটিলতা দেখা দিয়েছিল। হাড় ও মাংসপেশী দুর্বল হয়ে এসেছিল এবং শরীরের বিভিন্ন স্থানে ক্ষত সৃষ্টি হচ্ছিল। গত মাসের শেষের দিকে পেছনের পায়ে ক্ষত সৃষ্টি হলে তার শারীরিক কষ্ট আরো বৃদ্ধি পায়। ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে এবং মার্চের শুরুর দিকে তাকে দুই সপ্তাহ তার খাঁচায় শুয়ে শুয়ে কাটাতে হয়েছিল। তত্ত্বাবধান কেন্দ্রের কর্মীদেরকে সুদানের ক্ষতস্থানগুলো দিনে দুবার করে পরিষ্কার করে দিতে হতো।

কিন্তু তারপরেও তার শারীরিক অবস্থার তেমন কোনো উন্নতি দেখা যায়নি। শেষ ২৪ ঘণ্টায় তার শারীরিক কষ্ট অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং শারীরিক অবস্থার উন্নতির কোনো সম্ভাবনা না থাকায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তাকে ঘুমের মধ্যে মৃত্যুর ব্যবস্থা করা হবে। ফলে তার মৃত্যুর কষ্ট লাঘব হবে। সে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গত ১৯ মার্চ সোমবার তাকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়।

অন্য খবর  ড্যান ব্রাউন: এক কলম জাদুকরের কথা

কেন প্রজাতিটি বিলুপ্ত প্রায়ঃ হাতির পরেই আকারে সর্ববৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণী এরা। পৃথিবীতে মোট পাঁচ প্রজাতির গন্ডারের সন্ধান পাওয়া যায়, যার মধ্যে একটি হচ্ছে আফ্রিকার শ্বেত গন্ডার। শ্বেত গন্ডারের আবার দুটি প্রকরণ আছে- উত্তরাঞ্চলীয় এবং দক্ষিণাঞ্চলীয়। উত্তরাঞ্চলীয় শ্বেত গন্ডারের আবাসস্থল ছিল উগান্ডা, চাদ, সুদানসহ পূর্ব ও মধ্য আফ্রিকার বেশ কিছু দেশ জুড়ে। কিন্তু সত্তর ও আশির দশকে এসব অঞ্চলে বন্যপ্রাণী শিকারিদের দৌরাত্যে এদের সংখ্যা ক্রমে হ্রাস পেতে থাকে। সর্বশেষ বন্য গন্ডারের দেখা পাওয়া গিয়েছিল ২০০৬ সালে।

গন্ডারের চামড়া এবং শিংয়ের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। তাদের শিং ছুরির বাট এবং ঐতিহ্যবাহী চীনা ওষুধ তৈরিতে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। প্রাণী শিকারি তথা পোচারদের কারণে নব্বইয়ের দশকেই অধিকাংশ উত্তরাঞ্চলীয় শ্বেত গন্ডার নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। শুধুমাত্র কঙ্গোর গারাম্বা ন্যাশনাল পার্কে বেঁচে থাকে হাতে গোনা মাত্র অল্প কয়েকটি গন্ডার। তাদেরকে সংরক্ষণের জন্য পরিবেশ এবং বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আন্দোলনকর্মীরা যথেষ্ট সোচ্চার ছিলেন।

যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে পারলে হয়তো প্রজাতিটিকে রক্ষা করা যেত। দক্ষিণাঞ্চলীয় শ্বেত গন্ডারও বিংশ শতাব্দীর শুরুতে প্রায়  বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। এদের সংখ্যা মাত্র ২০-এ নেমে এসেছিল। কিন্তু সংরক্ষণ কর্মসূচী এবং শিকার বিরোধী কঠোর আইনের ফলে ধীরে ধীরে এদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। বর্তমানে দক্ষিণাঞ্চলীয় শ্বেত গন্ডারের সংখ্যা ২০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে।

কিন্তু নব্বইয়ের দশকের শেষভাগে শুরু হওয়া দ্বিতীয় কঙ্গো যুদ্ধের কারণে উত্তরাঞ্চলীয় শ্বেত গন্ডার সংরক্ষণ কর্মসূচী বাধাগ্রস্ত হয়। যুদ্ধে কঙ্গোর জনগণ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ফলে গন্ডারের দিকে দৃষ্টি দেওয়ার মতো অবকাশ কারো ছিল না। তাছাড়া সেভ দ্য রাইনো সংগঠনের মতে, এসময় গৃহযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বাহিনীগুলোর হাতেও গারাম্বা বনের গন্ডারগুলো হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়। সশস্ত্র বাহিনীগুলো নিজেদের অস্ত্র এবং গোলাবারুদের খরচ যোগানোর জন্য গন্ডারগুলোকে হত্যা করে তাদের চামড়া এবং শিং বিক্রি করে দেয়।

প্রজাতিটি টিকিয়ে রাখার প্রচেষ্টাঃ সুদানকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এবং এর মাধ্যমে প্রজাতিটির বংশ বৃদ্ধির জন্য ওআই পেজেটা কর্তৃপক্ষ অনেক চেষ্টা করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের সব চেষ্টা বিফল হয়েছে। সুদানকে দীর্ঘদিন বাঁচিয়ে রাখার জন্যই ২০০৯ সালে তাকে চেকোস্লোভাকিয়া থেকে কেনিয়ার ওআই পেজেটাতে স্থানান্তর করা হয়েছিল। আফ্রিকার পরিবেশ তার জন্য তুলনামূলকভাবে বেশি সহনীয় হবে, এই আশায় তাকে ৭০ একর জমির উপর নির্মিতপ্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যেই রাখা হয়েছিল। চিড়িয়াখানা কিংবা তত্ত্বাবধান কেন্দ্রেও সশস্ত্র পোচারদের আক্রমণ করার উদাহরণ আছে। তাই সুদানকে রক্ষার জন্য ওআই পেজেটাতে সার্বক্ষণিক সশস্ত্র প্রহরীর ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

অন্য খবর  আমার পিতৃভূমি ‘বিক্রমপুরে’ কোনদিন না যাওয়ার আক্ষেপ এখনো আছে : শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

২০১৪ সালে সুদানের শুক্রাণু সংগ্রহ করে তা দিয়ে অন্য দুই নারী গন্ডারকে গর্ভধারণ করানোর উদ্যোগও নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বয়সজনিত কারণে ততদিনে সুদানের উৎপাদন ক্ষমতা অনেক হ্রাস পাওয়ায় এ উদ্যোগ সফলতার মুখ দেখেনি। এর নামে গত বছর ডেটিং অ্যাপ টিন্ডারে একটি অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছিল। এর উদ্দেশ্য ছিল প্রধানত প্রচারণামূলক, যেন গন্ডারের জন্য কৃত্রিম প্রজনন পদ্ধতি ‘ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন’ (IVF) এর উন্নয়নের জন্য তহবিল গঠন করা যায়।

সুদানের মৃত্যুর পর প্রাকৃতিকভাবে গন্ডারের প্রজাতিটির বংশবৃদ্ধির সম্ভাবনা প্রায় শেষ হয়ে গেছে, যদি না আফ্রিকার প্রত্যন্ত কোনো জঙ্গলে এখনো এ প্রজাতির দুই-একটি গন্ডারের অস্তিত্ব টিকে থাকে। প্রজাতিটিকে টিকিয়ে রাখার জন্য এখন আইভিএফ পদ্ধতিই শেষ ভরসা। আইভিএফ এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। এর মাধ্যমে সন্তান উৎপাদন করা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। একটি গন্ডারের জন্ম দিতে খরচ হতে পারে প্রায় ৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। তারপরেও তা সফল হবে কিনা, তার নিশ্চয়তা নেই।

গন্ডারের বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে বর্তমানে দক্ষিণ আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলীয় শ্বেত গন্ডারের সংখ্যাই সর্বাধিক, প্রায় ২০ হাজার। তবে সুমাত্রান এবং জাভান নামক দুটি প্রজাতির সংখ্যা বর্তমানে যথাক্রমে ১০০টি এবং ৬৭টি। ২০১৩ সালে কালো গন্ডারের একটি উপ-প্রজাতিকে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছিল। উত্তরাঞ্চলীয় শ্বেত গন্ডারও হয়তো শীঘ্রই সে তালিকায় নাম লেখাতে যাচ্ছে। মানুষ যদি তাদের লোভ সংবরণ না করে এবং বন্য প্রাণী সংরক্ষণে আরো সোচ্চার না হয়, তবে অচিরেই হয়তো পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে যাবে এরকম আরো অনেক প্রাণী। দিন শেষে প্রাকৃতিক ভারসাম্য হারিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে মানুষই।

আপনার মতামত দিন