সৌদির নাগরিকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে সৌদি সরকারের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তে বিপাকে পড়েছে সেদেশে অবস্থানরত বিদেশি শ্রমিকরা। সৌদি সরকার ১২ টি সেক্টরকে সৌদিকরণ করার ঘোষণা দেওয়ায় গত ১৫ মাসে ৭ লাখ ২০০ জন প্রবাসী শ্রমিক চাকরিচ্যুত হয়ে সৌদি আরব ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। সৌদি সরকারের পরিসংখ্যান দফতরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, শুধুমাত্র ২০১৭ সালেই চাকরি হারিয়ে নিজ নিজ দেশে ফিরে গেছে ৪ লাখ ৬৬ হাজার শ্রমিক। আর গত তিন মাসেই সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরতে বাধ্য হয়েছে ২ লাখ ৩৪ হাজার ২০০ জন শ্রমিক। তবে এর মধ্যে কী পরিমাণ বাংলাদেশি আছেন তা জানা সম্ভব হয়নি। তবে সৌদি আরবের রিয়াদে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস বলছে, এর মধ্যেও বাংলাদেশি শ্রমিকরা অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতির সম্মুখীন হবে।
জানা গেছে , ১২ টি সেক্টর সৌদিকরণের ফলাফল নিয়ে মুখোমুখি বিতর্কে জড়িয়ে গেছে সৌদি সরকারের দুই মন্ত্রণালয়। দেশটির সমাজ কল্যাণ ও শ্রম মন্ত্রণালয় বলছে সৌদিকরণের ফলে দেশটির ৬০ হাজার নাগরিকের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে, অন্যদিকে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ মন্ত্রণালয় বলছে প্রায় ৫ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টির কথা। তাই শ্রমবাজার সংকোচনে কার ক্ষতি বা কার লাভ হবে এ নিয়ে দেখা দিয়েছে ধোঁয়াশা।
এর আগে সৌদিআরবের শ্রম ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় এক ঘোষণায় জানিয়েছে সৌদি নাগরিকদের মধ্যে বেকারত্ব কমিয়ে আনতে ১৪৪০ হিজরিতে তিন ভাগে সৌদি আরবের আরও ১২ ধরনের প্রাইভেট সেক্টরকে সৌদিকরণ করা হচ্ছে। এই ১২টি সেক্টরে সৌদি পুরুষ এবং নারী ব্যতীত অন্য কোনও দেশের নাগরিক কাজ করতে পারবে না। হিজরি ১৪৪০ সালের প্রথম মাসের ১ তারিখ (১২ সেপ্টেম্বর ২০১৮) থেকে মোটরযান / মোটর সাইকেল কিংবা এর যন্ত্রাংশ খুচরা বা পাইকারি বিক্রয় কেন্দ্র, পাইকারি ও খুচরা পোশাক/ কাপড়/ জুতা/ প্রসাধনী বিক্রয় কেন্দ্র, গৃহস্থালী/ অফিসিয়াল ফার্নিচার (আছাছ মানজিলি/ মাকতাবি ) বিক্রয় কেন্দ্র, গৃহস্থালী তৈজসপত্র ( আওয়ানি মানজিলি) হাড়ি-পাতিল জাতীয় দ্রব্যাদি বিক্রয় কেন্দ্র সৌদিকরণ করা হবে।
সৌদি আরব থেকে একটি সূত্রে জানা গেছে, ঘোষণা অনুযায়ী ইতিমধ্যে পরিদর্শন শুরু করেছে সৌদি আরবের শ্রম ও সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়। এতে দাম্মাম এবং আল খোবার এলাকার অনেক দোকান বন্ধ হয়ে গেছে। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলছেন, জরিমানা কিংবা শাস্তির হাত থেকে রক্ষা পেতেই প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখেছে তারা। মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শকরা দাম্মাম, আল খোবার ছাড়াও কাতিফ, আহসা, জুবাইল এলাকাসহ কয়েকটি জায়গায় অভিযান চালিয়েছে। অভিযানে এসব এলাকার ছোট ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও বড় শপিং মলের দোকানগুলো খোলা পাওয়া যায়। সূত্রটি আরও জানায়, শপিং মলের দোকানগুলোতে সৌদি সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী সৌদি নাগরিকদের কর্মরত দেখা গেলেও, মালিক বলছে এভাবে প্রতিষ্ঠান চালানো কষ্টকর হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কারণ, বিদেশি শ্রমিকদের বদলে নতুন শ্রমিক পাওয়া এই মুহূর্তে দুষ্কর হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এতে তাদের আর্থিক ক্ষতির সম্ভাবনাও দেখা দিয়েছে।
সৌদি আরব ফেরত কয়েকজন বাংলাদেশির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যেসব দোকান বন্ধ হয়ে গেছে সেসব প্রতিষ্ঠান প্রবাসী শ্রমিকরা চালাতেন। দীর্ঘ সময় ধরে তারা অনেকটা লুকিয়ে এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
সৌদি আরবে অবস্থিত বিভিন্ন প্রবাসী শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগামী দুই মাসের মধ্যে প্রবাসীদের চালানো আরও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবে। তাসাতুর পদ্ধতিতে সৌদির নাগরিকরা এসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান প্রবাসী শ্রমিকদের সঙ্গে লাভের অংশীদারিত্বে পরিচালনা করতেন। তাসাতুরকে সৌদি সরকার অপরাধ হিসেবে গণ্য করে। কারণ, এই উপায়ে ব্যবসা থেকে যে লভ্যাংশ আসে তা জিডিপিতে কোনও ভূমিকা রাখেনা। আবার প্রবাসী শ্রমিকরা এই উপায়ে ব্যবসা করে যেই অর্থ উপার্জন করে সেই টাকা বৈধ উপায়ে সেদেশ থেকে নিজ দেশে পাঠাতে পারে না। তখন তারা এই টাকা অবৈধভাবে তাদের নিজ দেশে পাঠায়। বৈধ পথে পাঠাতে গেলে তাদের অর্থ আদালতের সম্মুখীন হতে হতো। এই লোক দেখানো ব্যবসা এক সময় সৌদি আরবে খুব প্রচলন ছিল। প্রবাসী শ্রমিকদের এই ব্যবসা করার কোনও অনুমতি সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়নি। যে ব্যবসাগুলো সৌদি নাগরিকরা করতে পারে সেটা প্রবাসীরা বিনিয়োগকারী না হয়েও করতো। মালিক না হয়ে দোকানের কর্মচারীরা এই ব্যবসাগুলোর সঙ্গে জড়িত ছিল। এদের মধ্যে অনেক বাংলাদেশিও জড়িত আছেন বলে জানা গেছে।
সৌদির শুরা কাউন্সিল সদস্য সাঈদ বিন কাশেম আল খালিদি আল মালিকি রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম সৌদি গেজেটকে জানিয়েছেন,স্বাস্থ্য এবং শিক্ষা খাতে বর্তমানে ৬০ হাজার বিদেশি শ্রমিক কাজ করছে, আমাদের সারা জীবন বিদেশি শ্রমিকদের ওপর নির্ভর করা উচিৎ নয়, যেখানে আমাদের নাগরিক যোগ্য প্রার্থী হিসেবে বসে আছে। সব সেক্টরেই কাজ করার মতো যোগ্য নাগরিক আমাদের আছে।
সৌদি আরবের রিয়াদে বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রম কাউন্সিলর সারওয়ার আলম সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, সৌদি সরকারের সিদ্ধান্তে কী পরিমাণ বাংলাদেশি ফিরে গেছে তার পরিসংখ্যান এ মুহূর্তে পাওয়া যাবে না। আমাদেরকে যারা জানিয়ে যান না তাদের তথ্য তো আমাদের কাছে থাকবে না। যারা আকামাজনিত কারণে কিংবা ধড়পাকড়ের সমস্যায় পড়ে তাদেরকেই কেবল আমাদের কাছে পাঠিয়ে দেয় সৌদি সরকার। তখন আমরা তাদেরকে দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করি বলে আমাদের কাছে তাদের হিসাব থাকে। কিন্তু অন্য কোনও কারণে কেউ যদি স্বেচ্ছায় চলে যায় সেটার তথ্য আমাদের কাছে আসে না। তবে এই সিদ্ধান্তে আমাদের লোকদের ক্ষতি কম হবে বলে মনে করি।
কারণ হিসেবে তিনি বলেন, সৌদি সরকার যে পরিসংখ্যান দিয়েছে সেখানে সব দেশের আলাদা করে পরিমাণ দেওয়া থাকলেও বাংলাদেশের পরিসংখ্যান দেওয়া হয়েছে ‘আদার ন্যাশনালিটি’র মধ্যে, আর সেই তুলনায় বাংলাদেশিদের সংখ্যা ‘ইনসিগনিফিকেন্ট’ (খুব বেশি নয়)। তিন চারটি ক্যাটেগরি তারা উল্লেখ করেছিল, তার মধ্যে আমাদের অবস্থান কমই আছে।
যারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে তাদের অন্য কোনও পেশায় যুক্ত হওয়ার সুযোগ আছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে সারওয়ার আলম আরও বলেন, তাদের আকামা পরিবর্তনের সুযোগ আছে। কিন্তু আমাদের লোকরা তো থাকবে না, কারণ এখানে যারা কাভার আপ বিজনেস করছে, এটা তো এদেশের আইনে অবৈধ। তারা চিন্তা করছে যে এইভাবে আর কতো, তাই তারা ফিরে যাচ্ছে দেশে। যারা হয়তো প্রফেশনাল জায়গায় কাজ করছে তারা হয়তো পরিবার দেশে পাঠিয়ে আকামা পরিবর্তন করে থাকবে, যদি তাদের স্কিল থাকে।
এর আগে রিয়াদে বাংলাদেশ দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত গোলাম মসিহ সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, ‘সৌদি সরকার একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখনও বাস্তবায়ন করেনি, তবে ধীরে ধীরে করবে। আমাদের লোকজন কিছুটা হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে আমরা চেষ্টা করছি নতুন নতুন সেক্টরে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা যাতে করা যায়। সে লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি।