ছাত্রদের হাতেই থাকুক ছাত্রদলের রাজনীতি— এমন চিন্তা-ভাবনা থেকেই দীর্ঘ ২৭ বছর পর কাউন্সিলের মাধ্যমে ছাত্রদলের কমিটি গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে বিএনপি। বেঁধে দিয়েছে বয়সসীমা। প্রার্থী হওয়ার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না বিবাহিত ছাত্রনেতাদের। কিন্তু এই সিদ্ধান্তগুলো যারা বাস্তবায়ন করবেন তাদের মধ্যেই রয়েছে সমস্যা। নির্বাচন পরিচালনায় দায়িত্বপ্রাপ্ত ছাত্রদলের সাবেক নেতদের অধিকাংশেরই রয়েছে ব্যক্তিগত পছন্দ। প্রত্যেকেই চাচ্ছেন তার অনুসারীরা ছাত্রদলের নেতৃত্বে আসুক। বড় দুই পদে তার পছন্দের লোকটিই থাকুক।
ছাত্রদলের নির্বাচন পরিচালনা কমিটিতে রয়েছেন— ডাকসুর সাবেক জিএস বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন, ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি (১৯৯৬-৯৮) বিএনপির প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানী, ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি (১৯৯৮-২০০০) বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হাবীব-উন-নবী-খান সোহেল, ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক (২০০২) বিএনপির প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক এ বি এম মোশাররফ হোসেন, ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক (২০০৫-২০০৯) স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি শফিউল বারী বাবু, ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক (২০০৯-১২) বিএনপির সহ-প্রচার সম্পাদক আমিরুল ইসলাম খান আলিম, ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি (২০১৪-২০১৯) বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য রাজিব আহসান।
অন্যদিকে, বাছাই কমিটিতে রয়েছেন— ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি (১৯৯৩-১৯৯৬) বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ফজলুল হক মিলন, ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি (২০০৫-২০০৯) বিএনপির তথ্য বিষয়ক সম্পাদক আজিজুল বারী হেলাল, ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি (২০০৯-১২) যুবদলের সাধারণ সম্পাদক সুলতান সালাহ উদ্দিন টুকু, ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি (২০১২-১৪) স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কাদির ভূঁইয়া জুয়েল, ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক (২০১২-২০১৪) ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ) বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক হাবিবুর রশিদ হাবিব, ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক (২০১৪-১৯) বিএনপির নির্বাহী সদস্য আকরামুল হাসান।
আপিল কমিটিতে রয়েছেন— ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি (১৯৮৩-৮৬) বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু, ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি (১৯৮৭-৯০) ও বিএনপির বিশেষ সম্পাদক আসাদুজ্জামান রিপন, ছাত্রদলের সাবেক আহ্বায়ক (১৯৯০-৯২) বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমান।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, নির্বাচন পরিচালনা কমিটি, বাছাই কমিটি ও আপিল কমিটিতে যে ১৬ জন নেতা নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার দায়িত্ব পালন করছেন, এদের মধ্যে শামসুজ্জামান দুদু, আসাদুজ্জামান রিপন ও খায়রুল কবির খোকন ছাড়া বাকি ১৩ জনেরই রয়েছে পছন্দের প্রার্থী। এই ১৩ জনই চান তাদের অনুসারীরা ছাত্রদলের নেতৃত্বে বসুক। আর সে কারণেই ইলেকশনের নামে সিলেকশনের মধ্য দিয়ে নেতা নির্বাচন সম্ভবনাকে উড়িয়ে দিচ্ছেন না প্রার্থীরা।
১৯৯২ সালে অনুষ্ঠিত ছাত্রদলের সর্বশেষ কাউন্সিলে সভাপতি হন রুহুল কবির রিজভী, সাধারণ সম্পাদক হন এম ইলিয়াস আলী। এরপর ছাত্রদলের যে ১০টি কমিটি গঠন করা হয়, তার মধ্যে অন্তত চারটি কমিটিতে এম ইলিয়াস আলীর অনুসারীরা সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক সভাপতি হাবীব-উন-নবী খান সোহেল, আজিজুল বারী হেলাল, আব্দুর কাদির ভূঁইয়া জুয়েল ও সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসান।
আসন্ন কাউন্সিলে এরা প্রত্যেকেই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন। এদের রয়েছে একাধিক পছন্দের প্রার্থী। এই গ্রুপের পছন্দের তালিকায় আছেন সভাপতি প্রার্থী আল মেহেদী তালুকদার, হাফিজুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী আমিনুর রহমান, শাহ নেওয়াজ ও ইকবাল হাসান শ্যামল।
একাধিক প্রার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নিখোঁজ এম ইলিয়াস আলীর অনুসারীরা যাদের চাইবেন, তারাই সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হবেন। সে কারণেই একপদের জন্য একাধিক প্রার্থী রেখেছেন তারা। বিয়ে, বয়স, ছাত্রত্ব ইস্যুতে একজন বাদ পড়লে, অন্যজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।
ছাত্রদলের সাবেক আবাহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমান, সাবেক সভাপতি শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, সুলতান সালাহউদ্দিন টুকু, রাজিব আহসানের পছন্দের সভাপতি প্রার্থীদের মধ্যে রয়েছেন— কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণ, আশরাফুল আলম ফকির লিংকন, মো. আব্দুল মাজেদ, তানভীর রেজা রুবেল, ফজলুর রহমান খোকন। এই গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক প্রার্থীরা হলেন— তানজিল হাসান, মো. মহিউদ্দিন রাজু, জোবায়ের আল মাহমুদ রিজভী, আরিফুল হক ও আব্দুল মোমেন মিয়া।
অর্থাৎ নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে যাদের দায়িত্ব পালন করার কথা, তাদের প্রত্যেকেরই রয়েছে পছন্দের প্রার্থী এবং প্রত্যেকেই চেষ্টা করছেন পছন্দের প্রার্থীকে বিজয়ী করতে। ফলে ‘বড় ভাই’দের পছন্দের তালিকার বাইরে থাকা প্রার্থীরা নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিয়ে সন্দিহান।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সভাপতি প্রার্থী মো. আরজ আলী শান্ত বলেন, ‘বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান চেয়েছেন ভোটের মাধ্যমে নেতা নির্বাচন করতে। তবে অনেকেই চাচ্ছেন তাদের পছন্দের প্রার্থীকে জয়ী করতে। কিন্তু নিয়মের ব্যাত্যয় হলে আমরা প্রতিরোধ গড়ে তুলব।’
সভাপতি প্রার্থী তানভীর রেজা রুবেল বলেন, ‘গত ২৭ বছর ধরে সিলেকশনের মাধ্যমে নেতা নির্বাচন হচ্ছে। সে কারণেই হয়তো ইলেকশন নিয়ে নানা কথা উঠছে। অর্থাৎ আমাদেরকে সিলেকশন থেকে ইলেকশনে অভ্যস্ত হতে সময় লাগবে।’
নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক খায়রুল কবির খোকন বলেন, ‘আমি যতক্ষণ পর্যন্ত আছি, ততক্ষণ পর্যন্ত কেউ কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আমাকে যে দায়িত্ব দিয়েছেন, শেষ বিন্দু দিয়ে চেষ্টা করব, সেটা ঠিকমতো পালন করতে।’
‘নির্বাচন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যারা যুক্ত আছেন, তাদের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ থাকতে পারে। তবে দায়িত্ব পালনের সময় সেই পছন্দ, অপছন্দ এখানে প্রাধান্য পাবে না, এই গ্যারান্টি আমি দিতে পারি,’— বলেন খায়রুল কবির খোকন।