জাকির হোসেনঃ
৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পর আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাব্য কারণগুলো খতিয়ে দেখতে গিয়ে বিএনপির পর্যবেক্ষণে সবার আগে উঠে এসেছে ঢাকা জেলা বিএনপির ব্যর্থতার চিত্র। নেতৃত্ব ব্যার্থতায় নেতা কর্মিদের ক্ষোভ বাড়ছে ঢাকা জেলা বিএনপি সভাপতি আব্দুল মান্নানের ওপর। আর বিএনপি থাকলেও বিএনএফ এর চেয়ারম্যান নাজমুল হুদার অভাব পূরণ হয়নি এখনও। আর এইসব কারণেই ‘রোড মার্চ ফর ডেমোক্রেসিসহ” মহানগরীর আন্দোলন সফল হয়নি বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় বিএনপি।
মহানগীর বিএনপির ব্যর্থতার পাশাপাশি আশপাশের এলাকা; বিশেষ করে ঢাকা জেলা বিএনপির সীমাহীন ব্যর্থতা এবং সংশ্লিষ্ট নেতাদের রহস্যময় নীরবতা দলটিতে এখন প্রধান আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে- সব মিলিয়ে সরকারের ওপর কোনো চাপ সৃষ্টি করা সম্ভব হয়নি। ফলে ব্যর্থ হয়েছে দীর্ঘ আড়াই বছর ধরে চালিয়ে আসা সরকারবিরোধী আন্দোলন।
তাই গত তিন মাসের কঠিন আন্দোলনে মান্নান এবং জেলা সভাপতি আমানউল্লাহ আমানের রহস্যময় আচরণ দলের মধ্যে সংশয় ও নানা জল্পনার জন্ম দিয়েছে। অনেকের মতে, ধানমণ্ডির বাড়িতে বসেই সময় কাটাতে পছন্দ করা আবদুল মান্নানকে হঠাৎ করেই ঢাকা জেলা বিএনপির দায়িত্ব দেয়া ঠিক হয়নি। কারণ তার নেই সাংগঠনিক দক্ষতাও। ফলে তাকে গুরুত্বপূর্ণ এই পদ দেয়ায় জেলা বিএনপির নেতাকর্মীরা হতাশ হয়েছেন।
আর আন্দোলনে রাজপথে না থাকার কারণ হিসাবে তৃণমূলের অভিযোগ ক্ষমতায় থাকাকালে গড়ে তোলা সম্পদের পাহাড় রক্ষা, পুলিশি হয়রানি ও জেল-জুলুমের ভয় এবং কোনো রকম ভূমিকা পালন ছাড়াই এমপি-মন্ত্রী হওয়া যাবে- ঢাকা জেলার নেতা এই পদাধিকার বলে। নেতাদের এমন আত্মবিশ্বাসের কারণেই সরকারবিরোধী আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে। বিএনপি নেতাকর্মীদের মতে, তৃণমূলে দুর্বার আন্দোলন গড়ে উঠলেও ঢাকা জেলা ও মহানগর বিএনপির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের গা-বাঁচিয়ে চলা ও নিষ্ক্রিয়তার কারণেই রাজধানীতে আন্দোলন জমাট বাঁধতে পারেনি।
দলের ভাইস চেয়ারম্যান ও ঢাকা জেলা বিএনপির সভাপতি ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা দুই নেত্রীর সংলাপের আলটিমেটাম দিয়ে ২০১২ সালে বিএনপি থেকে পদত্যাগ করেন। তার শূন্যস্থান পূরণের জন্য বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সাবেক প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নানকে দেয়া হয় ঢাকা জেলা বিএনপির দায়িত্ব। কিন্তু সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণের পর যোগ্যতা ও দক্ষতার পরিচয় দিতে পারেননি মান্নান। অভিযোগ আছে, আন্দোলনের সময় এলেই তিনি ধানমণ্ডির বাড়িতে লুকিয়ে থাকেন। আর হরতালের সময় তারই সমর্থকদের দিয়ে দু’চারটি ইটপাটকেল নিক্ষেপ করিয়ে তা মিডিয়ায় প্রচারের ব্যবস্থা করেন। অথচ কেন্দ্রীয় কর্মসূচিতে না গুলশান কার্যালয়ের কোনো সভায় কোথাও গত কয়েক বছরে দেখা মেলেনি মান্নানের। পাশাপাশি গত দু’বছরে ঢাকা জেলায়ও কোনো সভা-সমাবেশে তার খুব একটা দেখা মেলেনি।
বরংচ স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সময় তুখোড় ছাত্রনেতা ও জহুরুল হক হলের ভিপি আবু আশফাক সমর্থকরা আন্দোলন করেছে ঢাকা দক্ষিণে। আগামীতে সাহসী ও তারুণ্যের জনপ্রিয় নেতাদেরকে সামনে না অনেকেরই আশংকা অস্তিত্ব সঙ্গকটে পড়তে যাচ্চ বিএনপি।
মাঝে মধ্যে নিজের নির্বাচনী এলাকা দোহার-নবাবগঞ্জে গেলেও জনবিচ্ছিন্নতার কারণে নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ তেমন করেন না আব্দুল মান্নান। এড়িয়ে চন সাংবাদিকদেরও। তাছাড়া স্থানীয় নবাবগব্জ উপজেলা চেয়ারম্যান খন্দকার আশফাকের সঙ্গে দ্বন্দ্ব থাকায় নিজ এলাকায় নিজের অবস্থান তৈরি করতেও ব্যর্থ হয়েছেন আবদুল মান্নান।
এদিকে বিএনপির আমলে এমপি-মন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার সঙ্গে দ্বন্দ্ব থাকায় এলাকায় কোনো উন্নয়ন করতে পারেননি মান্নান। নাজমুল হুদা নিজ উদ্যোগে উন্নয়ন করতে গেলেও ইগো প্রবলেমের কারণে তাকে তা করতে দেননি তিনি। এসব নানামুখী কারণে এলাকার লোকজনকে নিয়ে সরকারবিরোধী শক্ত আন্দোলন গড়ে তোলা মান্নানের পক্ষে সম্ভব হয়নি। তাই আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে তার কাছ থেকে বিএনপির প্রাপ্তি প্রায় শূন্য। কেবল নিজ এলাকায় নয়, বিএনপির চরম সংকটকালে গুলশান অফিস বা দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় নয়াপল্টনেও কখনও দেখা যায়নি আয়েশি এ নেতাকে। বিএনপির এই বিলাসী নেতা সম্পর্কে বেশিরভাগ নেতাকর্মীর ধারণা হল- ক্ষমতায় থাকাকালীন যে পরিমাণ অর্থ-সম্পদ করেছেন তা রক্ষা করতে হলে আন্দোলন কর্মসূচি থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে হবে এটাই স্বাভাবিক। কারণ মাঠে নামলেই সরকারের কোপানলে পড়ে অবৈধ পথে অর্জিত সম্পদ হাতছাড়া হতে পারে- এমন আতংক রয়েছে তার মধ্যে। তাই দলের অবস্থা যাই হোক না কেন, সম্পদ রক্ষায় নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখাই শ্রেয় বলে মনে করে দলের দুঃসময়ে চুপ থাকেন মান্নান।
এছাড়া বিএনপি ক্ষমতায় এলে তার জন্য মন্ত্রিত্ব নিশ্চিত বলেও তিনি মনে করেন। আর সে কারণেই কোনো রকম ঝুঁকি না নিয়ে ঢাকার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ জেলার সর্বোচ্চ পদে বহাল তবিয়তে থাকার কৌশল নিয়েছেন তিনি।
এ ব্যাপারে নিউজ৩৯ এর পক্ষ থেকে তাকে ফোন দেয়া হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
তবে নিউজ৩৯ এর সাথে ফোনালাপে ব্যাঃ নাজমুল হুদা বলেন, সময়ই বলে দেবে কি করতে হবে। আর কোনটা সঠিক আর কোনটা ভূল। তবে আমাদেরকে তো দলে এক পাশে করে রেখে দেয়া হয়েছে। তাই দলে থাকলেও বিএনএফ কে নিয়ে সামনে এগিয়ে যাবো জাতীয়তাবাদী শক্তিকে এগিয়ে নিতে। তবে নেত্রীর প্রয়োজন হলে সাড়া দেব।
এদিকে ঢাকা জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আমান উল্লাহ আমানের অবস্থাও প্রায় একই রকম। বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দরাজ গলায় কড়া বক্তব্য দিলেও এখন তিনি চুপ। মিছিল-মিটিং-আন্দোলনে ডাকসুর সাবেক এই ভিপিকে আর দেখা যায় না। সম্প্রতি এক অবরোধ কর্মসূচিতে কয়েকটি মিডিয়া ডেকে নিয়ে সাভারের আমিন বাজারে ১৫ মিনিটের পিকেটিংই ঢাকা জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদকের এবারের আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। অনেকের মতে, পুলিশের বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে আমানের রয়েছে আত্মীয়তার সম্পর্ক। তারা তাকে দূরে সরে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। আবার কারও কারও মতে সরকারের সঙ্গে লিয়াজোঁ করেই চুপ রয়েছেন আমান।
আর এ কারণেই ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের কয়েকদিন আগে হাওয়া হয়ে যান আমান। একটি সূত্রের মতে, নির্বাচনের দু’দিন আগেই তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়েছিলেন। অনেকের মতে, সরকারের সঙ্গে আঁতাত করেই তিনি আত্মগোপনে যান। অবশ্য বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কাছেও এখন আমানের আর সেই কদর নেই। আমানকে তিনি চিনে ফেলেছেন। পদ যা দেয়ার তাও আগেই দিয়ে ফেলেছেন। কৌশলগত কারণে পদে রাখা হলেও দলে আর তার ভবিষ্যৎও নেই। কারণ দুর্নীতির কারণে বিএনপির যেসব নেতা আলোচিত আমানের নাম তাদের সবার আগে। আর ক্ষমতায় গেলেও বিএনপির দুর্নীতিবিরোধী অবস্থান স্পষ্ট করেই বিশ্ব সম্প্রদায়কে রাজি করাতে হবে। সব মিলিয়ে আমানের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।
ঢাকা জেলার মতো ঢাকা মহানগর বিএনপির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের অবস্থাও তথৈবচ। মহানগর কমিটিতে আনুষ্ঠানিক পদ না থাকলেও নানা কারণেই দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ নেতা মনে করা হয়। কিন্তু সাম্প্রতিককালে সরকারবিরোধী আন্দোলনে এই নেতাকেও দেখা যায়নি। আড়ালে তিনি আন্দোলন না হওয়ার জন্য মহানগরী আহ্বায়ক সাদেক হোসেন খোকাকে দায়ী করেন। অথচ নিজে কোনো দায়িত্ব নেন না। উপরন্তু মহানগরী কমিটির বিরুদ্ধে সারাক্ষণ প্রচারণায় ব্যস্ত থাকেন। এবার আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে আব্বাসও গা-ঢাকা দেন। অনেকে মনে করেন, এ নেতাও জেল-জুলুম, পুলিশি হয়রানি এবং ক্ষমতায় থাকাকালে অবৈধ পথে অর্জিত সম্পদ রক্ষায় দলের স্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে নিরাপদ দূরত্বে রয়েছেন। আব্বাসের ঘনিষ্ঠজনরা নাকি প্রায়ই বলেন, আন্দোলন-কর্মসূচিতে মাঠে থাকুন আর না থাকুন বিএনপি ক্ষমতায় এলে তাকে (আব্বাস) মন্ত্রিত্ব না দিয়ে কোনো উপায় নেই। তাই রাজনীতিকে পুঁজি করে ধনকুবের বনে যাওয়া মির্জা আব্বাসও রাস্তায় নেমে মার খেতে রাজি নন। সে কারণেই ঢাকা মহানগরে সরকারবিরোধী আন্দোলন জমাতে পারেনি বিএনপি। দলের তৃণমূল কর্মীরা মনে করেন, এসব সুবিধাবাদী নেতার কারণেই কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে তুমুল জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল বিএনপি।
ঢাকা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক সাদেক হোসেন খোকাকে নিয়েও আছে নানা গুঞ্জন। যে মুহূর্তে আন্দোলন-সংগ্রামে মাঠে থেকে নেতৃত্ব দেয়ার কথা ঠিক সেই মুহূর্তে ‘দা-কুড়াল’-এর বক্তব্য দিয়ে আত্মগোপনে চলে যান খোকা। অবশেষে ধরা পড়েন ডিবি পুলিশের হাতে। অনেকে মনে করেন, এ ধরা পড়ার ঘটনাটাও সাজানো নাটক। আর এ ধরনের নাটকের বলি হয়েছে দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি। ঢাকা মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব আবদুল সালামও আন্দোলনের পুরো সময় ছিলে লোক-চক্ষুর অন্তরালে। আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে তিনিও চলে যান আত্মগোপনে। খালেদা জিয়ার সমাবেশগুলোতে রাজা-উজির মেরে একাকার করলেও নেতাকর্মীদের সংগঠিত করে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার ক্ষেত্রে তিনি পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছেন বলেই মনে করেন মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। এভাবে ঢাকা মহানগর ও ঢাকা জেলার শীর্ষ নেতাদের ব্যক্তিগত লাভালাভের কাছে হেরে গেছে বিএনপির আন্দোলন। তাই সরকারবিরোধী আন্দোলনে এই মুহূর্তে কাক্সিক্ষত ফল পেতে ঢাকা জেলা বিএনপির সভাপতি আবদুল মান্নানসহ অযোগ্য-অদক্ষ ও সুবিধাবাদী নেতাদের সরিয়ে পরীক্ষিত ও ত্যাগি নেতাদের হাতে দায়িত্ব দেয়ার বিষয়টি দলের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে বলে জানা গেছে।