আবুল বাশার, নিউজ৩৯ : কমরেড মুজাফফর আহমেদ ছিলেন কবি নজরুলের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ প্রিয়ভাজন। থাকতেন একই ভাড়া বাসায়। কলকতার তালতলা লেনের ৩/৪ সি বাড়িতে। ১৯২১ সনের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহের মাঝামাঝি একদিন সকালে কবি নজরুল মুজাফফর আহমেদকে ডেকে একটা কবিতা শুনান। ‘বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত আমি সেদিন হবো শান্ত’। পৃথিবীর ইতিহাসে নজরুলের মতো কোনো কবি এতোটা দ্রোহের সাথে বিদ্রোহ করতে পারেন নাই। নজরুল ছিলেন দ্রোহের কবি প্রেমের কবি বেদনার কবি সাম্যের কবি জাগ্রত কবি। বিদ্রোহী কবিতার প্রথম শ্রোতায়ও দাবিধার কমরেড মুজাফফর আহমেদ। তখন নজরুলের বয়স ছিলো সবে মাত্র বাইশ বছর জন্ম সন অনুযায়ী (১৮৯৯, ২২ই মে)।
বিদ্রোহী কবিতার প্রকাশ নিয়ে বিতর্ক থাকলেও নজরুল গবেষকরা সবাই মোটামুটি একমত মুজাফফর আহমেদের কথায়। “বিদ্রোহী প্রথম ১৯২১ সালে ৬ই জানুয়ারি সাপ্তাহিক ‘বিজলী’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। বিদ্রোহী প্রথম ছাপানোর মর্যাদা বিজলীরই প্রাপ্য।” বিদ্রোহী কবিতা এতোটাই পাঠক প্রিয়তা পায় এবং আলোড়ন সৃষ্টি করে যে একই সপ্তাহে বিজলীর দ্বিতীয় সংস্করণ বের করেন। অনকের মতে একই দিনে। ‘বিদ্রোহী’ প্রকাশকালীন ‘বিজলী’র সম্পাদনা করতেন নলিনীকান্ত সরকার। ধারণা করা হয় প্রায় ২৯ হাজার কপি বিক্রি হয় ‘বিজলী’র। এটা তৎকালীন সময়ের জন্য বিরল ঘটনা। এরপর মাসিক ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকার কার্তিক সংখ্যায়, তবে কার্তিক সংখ্যার কার্তিকের পরিবর্তে বাংলা ১৩২৮ সালের মাঘ মাসে বের হয়। একই বছর ‘মাসিক প্রবাসী’ ও ‘মাসিক বসুমতী’তে প্রকাশ করেন। এবং পরের বছর ১৩২৯ সনে ‘মাসিক সাধনা’য় প্রকাশ হয়। নজরুলের সম্পাদনা ধুমকেতুতেও প্রকাশ করেন। (অনেকের দ্বিমত প্রথম প্রকাশ হয় মোসলেম ভারতে। উল্লেখ্য যে প্রথম দেওয়া হয় ‘মোসলেম ভারত’ সাপ্তাহিক পত্রিকায়। প্রকাশ করতে বিলম্বিত করায়। এর আগেই ‘বিজলী’তে ছাপা হয়)।
নজরুলের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অগ্নিবীণা’ প্রকাশিত হয় কলকাতার আর্য পাবলিকিসিং হাউস থেকে ১৯২২ সনে। যার প্রচ্ছদ পরিকল্পনা করেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর (রবিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাই)। অংকন করেছিলেন বিখ্যাত চিত্র শিল্পী বীরেশ্বর সেন। মাত্র ১২টি কবিতা ছিলো অগ্নিবীণায় যার ঐসময় বাজারমূল্য ছিলো ৩ টাকা। সেখানে স্থান পায় “বিদ্রোহী” কবিতাটি। অগ্নিবীণার বিদ্রোহ শুধু বাংলা সাহিত্যেই নয় বরং ইতিহাস সৃষ্টি করেছে বিশ্ব সাহিত্য অঙ্গনেও। তখনকার প্রবীণ প্রতিষ্ঠািত সাহিত্যিকরাও একজন নবীন কবিকে নিয়ে আবেগ প্রকাশ করেছেন পত্রিকায় প্রবন্ধ লেখেছেনে। এই তালিকায় অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত থেকে প্রেমেন্দ্র মিত্ররাও রয়েছেন। কবি নজরুল নিজ কন্ঠে পাঠ করে শুনিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। এর পর থেকেই নজরুল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চেনাজানা তৈরী হয়।
তবে সমালোচনা থেকেও বাদ পড়েনি নজরুল। মাত্র বাইশ বছরের একজন ছন্নছাড়া বাউণ্ডুলে কবি। মননে মানসিকতায় যিনি বিদ্রোহী। কবিতায় যা ফুটিয়ে তুলেছেন, “ভ্যূলোক দ্যুলোক গোলক ভেধিয়া খোদার আসন আরোশ ছেদিয়া উঠিয়াছি চিরবিস্ময় আমি বিশ্ব বিধাতৃর!”
নজরুলের ‘বিদ্রোহী’কে নিয়ে অনেক প্রসিদ্ধ কবি ব্যাঙ্গ করে লেখেন ব্যাঙ্গাত্মক কবিতা। যোগনন্দ দাস, সজনী কান্ত, গোলাম মস্তফাও বাদ যায়নি এই লিষ্টে থেকে। কবি যোগনন্দ দাস লেখেন “আমি বীর/ আমি দূর্জন, দূর্ধর্ষ, রুদ্রদীপ্ত শির/ আমি বীর। সজনীকান্ত লেখেন, “আমি ব্যাঙ/ লম্বা আমারই ঠ্যাং, আমি ব্যাঙ।” গোলাম মস্তফা লেখেন “ওগো বিদ্রোহী বীর/সংযত কর, সংহত কর, উন্নত তব শীর।”
এযুগেও বিদ্রোহীদের নিয়ে ব্যাঙ্গ হয়। নজরুলের বিদ্রোহীর মতোই বিদ্রোহ ছড়িয়ে থাক তাবত দুনিয়ার আনাচে-কানাচে। বৃটিশ ঔপনিবেশি- কতাকে নজরুল বৃদ্ধা আঙুলি দেখিয়ে ছুটে চলেছেন “মহা বিশ্বের মহা আকাশ ফাড়ি।” প্রবল প্রতাপশালী বৃটিশ শাসক একজন বাইশ বছরের তরুণ কবির কবিতা সয্য করতে না পেরে নিষিদ্ধের জন্য সুপারিশ করেছেন। এই কবিতাটির জন্য বৃটিশ সরকার রোশানলে পরলেও শেষ পর্যন্ত বায়জাপ্ত করেন নি। তবে কবির অন্য আরো পাঁচটি বই বায়জাপ্ত করেছিলেন। তারপরও বন্ধ ছিলো না নজরুলের কবিতা। নিরানব্বই বছরেও থেমে নেই কবির ‘বিদ্রোহী’, নতুন রূপে ফিরে আসে বৃটিশের জুলুম। আসে না শুধু নজরুল, আসে সাহিত্য পুরুষ্কার পেতে পা-চা-টা কবিরা। নজরুলের মতো কেউ বলতে পারবে না, “আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল, আমি দলে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল।” ২০২১শে নজরুলের “বিদ্রোহী”র শতবছর পুর্তিতে বিদ্রোহ হোক বাংলা সাহিত্যের।
সূত্র : কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতি কথা, কমরেড মুজাফফর আহমেদ। এবং নজরুলের ভিবিন্ন গবেষণা প্রবন্ধ।