বাংলাদেশে নির্বাচনী ময়দানের প্রতি প্রবাসীদের মনোযোগ ক্রমেই গভীর হচ্ছে। বিশেষ করে যারা মনোনয়ন পেতে আগ্রহী, তারা ইতিমধ্যেই নানামুখী তদবির শুরু করেছেন। এ বাবদ নগদ-নারায়নেরও ছড়াছড়ি হচ্ছে। বড় দল, ছোট দল সকল স্তরেই এক ধরনের খবর আসছে যে, মোটা অংকের টাকা হলেই মনোনয়ন পাওয়া যাবে। এরপর এক ডলারে ৮৫ টাকা হারে বস্তা ভর্তি টাকা ছড়াতে হবে এলাকার প্রচারাভিযানে। এমন পরিস্থিতি মেনে নিয়েই কেউ কেউ মাঠে নেমেছেন।
এরই মধ্যে ঢাকা-১ থেকে বিএনপি’র মনোনয়ন পেতে জোর লবিং চালাচ্ছেন বলে জানা গেছে দোহারের বাশতলা গ্রামের গিয়াস আহমেদ। বিএনপি’র সাবেক আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক গিয়াস আহমেদ একসময় বর্তমান ক্ষমতাসীন দলীয় প্রার্থী হিসাবে আমেরিকায় সিনেট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দীতা করেছিলেন।
মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে প্রায় সকলেই রাজনৈতিক দলের সাথে জড়িত বহুদিন যাবত। কষ্টার্জিত অর্থ বিনিয়োগ করে নানা কর্মসূচিতেও সোচ্চার থাকেন। নেতা-নেত্রীরা যুক্তরাষ্ট্রে এলে কাজ-কর্ম ছেড়ে তাদের আতিথেয়তায় ব্যস্ত হন। ফেরার সময় লাগেজ ভর্তি উপঢৌকন, ক্ষেত্রবিশেষে ডলারের বান্ডেল দিতেও কার্পণ্য করেন না। মাঝেমধ্যেই বাংলাদেশ থেকে ফোন পেয়ে বড় বড় স্টোরে গিয়ে দামি সেন্ট অথবা আইফোন কিংবা টাই-স্যুট, কোন কোন সময় ডায়মন্ড ক্রয় করতেও দ্বিধা করেন না। এগুলো গোপন কোন বিষয় নয়। দলের লোকজনেরও জানা। অর্থাৎ বড় কিছু পাবার আশায় নিজেকে উজাড় করে দেন প্রবাসে দেশি রাজনীতির বলয়ে ঘুরপাক খাওয়া এসব নেতারা। তারপরও মনোনয়নের সময় বস্তাভর্তি টাকার প্রসঙ্গ আসে। এ নিয়ে উচ্চবাচ্য করার সাহস নেই সংশ্লিষ্টদের। কার কাছে যাবেন-এমন প্রশ্ন নিয়ে? সবখানে একই জবাব- টাকা ছাড়া নির্বাচন হবে না। মাঠের কর্মীদের কাছেও একই প্রত্যাশা।
‘বিদেশে বহু কামিয়েছেন, এখন কিছু ছাড়ুন, আমরা আপনার পক্ষেই মাঠে থাকবো-যদি দল নমিনেশন দেয়।’ অর্থাৎ নমিনেশন পাবার পরও নিস্তার নেই। ভোটের দিন পর্যন্ত টাকার ওপর ভর করেই থাকতে হবে। এমন বাস্তবতাকে মেনে নিতে পারলেই সারা জীবনের স্বপ্নপূরণ হতে পারে।
আওয়ামী লীগ থেকে নমিনেশন প্রত্যাশীদের অন্যতম হলেন জাতিসংঘে সুনামের সাথে দায়িত্ব পালনকারি রাষ্ট্রদূত ড. এ কে এ মোমেন (সিলেট), যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সভাপতি ড. সিদ্দিকুর রহমান (বগুড়া), সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা-চেয়ারম্যান নিজাম চৌধুরী (ফেনী), ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আব্দুস সামাদ আজাদ, নিউইয়র্ক মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি এডভোকেট মোর্শেদা জামান (সরিষাবাড়ি), যুক্তরাষ্ট্র পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদের সাবেক আহবায়ক ড. মহসিন আলী (রাজশাহী), বিটিআরসির সদ্য বিদায়ী চেয়ারম্যান ড. শাহজাহান মাহমুদ (রংপুর), যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মোহাম্মদ ফারুক আহমেদ (সিলেট), যুব সম্পাদক মাহবুবুর রহমান টুকু (বরগুনা), নিউইয়র্ক মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক হাজী আব্দুল কাদের মিয়া (সন্দ্বীপ) প্রমুখ।
এরমধ্যে শীর্ষ পর্যায়ের সুনজর রয়েছে ড. মোমেনের প্রতি। সিলেট-১ আসন থেকে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত অবসর নেয়ার কথা। সেই আসনে তারই ছোটভাই ঝানু এই কূটনীতিককে মনোনয়ন দেবেন বলে শোনা যাচ্ছে। ড. শাহজাহান মাহমুদের ব্যাপারেও নমনীয় ভাব রয়েছে হাই কমান্ডের। তারই দক্ষতাপূর্ণ নেতৃত্বে বাংলাদেশ মহাকাশ জয়ে সক্ষম হয়েছে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের মধ্য দিয়ে। ড. সিদ্দিক এবং নিজাম চৌধুরী যদি বগুড়া ও ফেনী এলাকার আওয়ামী লীগের সমর্থন লাভে সক্ষম হন, তাহলে ভাগ্য প্রসন্ন হতে পারে। অন্যদের ব্যাপারেও আগ্রহ রয়েছে শীর্ষ পর্যায়ের, তবে ছাড়পত্র লাগবে এলাকার সাংগঠনিক ফোরাম থেকে।
বিএনপি থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে সাবেক আন্তর্জাতিক সম্পাদক গিয়াস আহমেদ (ঢাকা), সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আলহাজ্ব সোলায়মান ভূইয়া (ফেনী), সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা কামাল পাশা বাবুল (সন্দ্বীপ), ফ্লোরিডা বিএনপির সভাপতি দিনাজ খান (বিক্রমপুর), তারেক পরিষদ আন্তর্জাতিক কমিটির চেয়ারপার্সন ও যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক আকতার হোসেন বাদল (চাঁদপুর), সাবেক ছাত্রনেতা ও যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির সক্রিয় নেতা পারভেজ সাজ্জাদ (চট্টগ্রাম), জাসাসের কেন্দ্রীয় কমিটির আন্তর্জাতিক সম্পাদক ও যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক গোলাম ফারুক শাহীন (বরিশাল), বিএনপি নেতা আবুল হাশেম বুলবুল ( ফেনী) অন্যতম।
উল্লেখ্য, ৫ বছর আগে থেকে যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির কোন কমিটি না থাকায় সকলেই সাবেক পরিচয়ে কর্মকাণ্ড চালাচ্ছেন। তারা নিজ নিজ এলাকায় সভা-সমাবেশের সমন্বয় করছেন। সাংগঠনিক নেটওয়ার্কেও সক্রিয় রয়েছেন। হাইকমান্ডের বিভক্ত অংশে যোগাযোগ রাখছেন। কেউ কেউ মাঝেমধ্যে লন্ডনে যাতায়াতও করছেন। মনোনয়ন পেলে সরাসরি এলাকায় গিয়ে মাঠে নামবেন বলেও তাদের প্রস্তুতি রয়েছে। তবে সবটাই নির্ভর করছে দলীয় সিদ্ধান্তের ওপর।
বিএনপির কেন্দ্রীয় পর্যায়ের কোন কোন নেতা ইতিমধ্যেই তাদেরকে জানিয়ে দিয়েছেন যে, চেয়ারপার্সনের মুক্তির লক্ষ্যে মার্কিন রাজনীতিতে যারা জোরালো লবিং প্রদর্শনে সক্ষম হবেন, তাদের ভাগ্য প্রসন্ন হবে দেন-দরবার ছাড়াই। এ সংবাদ জানাজানি হবার পর সংশ্লিষ্টরা কংগ্রেসম্যান ছাড়াও রিপাবলিকান নীতি-নির্ধারক এবং ভারতে কানেকশন রয়েছে-এমন রাজনীতিক-কূটনীতিকদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ শুরু করে দিয়েছেন। খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেন-দরবারের লক্ষ্যে তারেক রহমানের তৈরি করা একটি ফাইল নিয়ে তারা দৌড়-ঝাঁপ করছেন।
এ ব্যাপারে গোপনীয়তা রক্ষা করা হচ্ছে। এ ধরনের তৎপরতা কানাডাতেও রয়েছে বলে জানা গেছে। একইসাথে তারেকের পক্ষ থেকে এসব নেতাদের আরও জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, খালেদা জিয়াকে মুক্তি না দিলে নির্বাচনে যাবার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। এমন দ্বিধা-দ্বন্দ্ব সত্বেও বিএনপির অনেকেই সর্বোচ্চ প্রস্তুতিতে রয়েছেন নির্বাচনের জন্যে। অর্থাৎ বেগম খালেদা জিয়া মুক্তি না পেলেও বিএনপি নামে কেউ যদি নির্বাচনে অংশ নেয়, তাহলে সেখান থেকেই ওই শ্রেণির রাজনীতিবিদরা অংশ নিতে কুণ্ঠাবোধ করবেন না। তারা মনে করছেন, নির্বাচিত হলে খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলন জোরদার করা সহজ হবে।
অপরদিকে, আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীরা নিজ এলাকার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করছেন সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে অর্থ-সহায়তার মাধ্যমে। মাঝেমধ্যে তারা এলাকাতেও যাচ্ছেন। একইসাথে দলীয় সভাপতির সুনজরে আসার লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড পরিচালনাও করছেন। উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী পরিবারের কাজকর্মের ওপর বিশেষ দৃষ্টি রয়েছে ডিজিটাল বাংলাদেশ’র স্বপ্নদ্রস্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের। তার ‘গুড বুকে’ যারা রয়েছেন তাদের সুপারিশ যাবে সভাপতি শেখ হাসিনার টেবিলে। এর আগে পর্যন্ত কিছুই জানা সম্ভব হবে না নমিনেশনের ব্যাপারে। সেপ্টেম্বরে সভাপতি শেখ হাসিনার জাতিসংঘ সফরের সময়েও সম্ভাব্য প্রার্থীরা শো-ডাউন করবেন বলে শোনা যাচ্ছে।
জাতীয় পার্টি, জাসদ থেকেও মনোনয়ন লাভের চেষ্টা করছেন ডজনখানেক সংগঠক। কেউ কেউ ইতিমধ্যেই বাংলাদেশে চলে গেছেন। এর মধ্যে রয়েছেন মাহবুবুর রহমান চৌধুরী, আব্দুল মোসাব্বির প্রমুখ। মৌলভীবাজারের একটি আসনের সাবেক এমপি এম এম শাহীনও এখন কুলাউড়ায় রয়েছেন মনোনয়নের প্রত্যাশায়।
বিডি প্রতিদিন