রাজধানী ঢাকার দক্ষিণ-পশ্চিমে বুড়িগঙ্গার উপকণ্ঠে কেরানীগঞ্জের জাজিরা এলাকায় পরিবেশবান্ধব আধুনিক আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর গড়ে তোলার উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। জাতির জনকের নামে প্রস্তাবিত বিমানবন্দরটি সরকার সহজে এই এলাকায় করতে পারে। এতে প্রস্তাবিত ওই বিমানবন্দরের জন্য স্থান নির্ধারণ নিয়ে যে জটিলতা রয়েছে তারও অবসান হবে। আন্তর্জাতিক মানের একটি আধুনিক বিমানবন্দর করতে যে বিপুল পরিমাণ জমির প্রয়োজন তাও রয়েছে এই এলাকায়। সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, কেরানীগঞ্জ ও সিরাজদিখান থানার সংশ্লিষ্ট মৌজাগুলোতে রয়েছে শত শত একর খাসজমি। এ ছাড়া ব্যক্তি মালিকানায় যে পরিমাণ জমি রয়েছে তাতেও জনবসতি খুবই কম। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব সুবিধার কারণে খুব সহজে জমি অধিগ্রহণ করা সম্ভব হবে। আর এতে সরকারি অর্থও খরচ হবে কম। অন্যদিকে নতুন একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণ হলে এই অঞ্চলে লাগবে আধুনিকতার ছোঁয়া। হবে নগরায়ণ। গতি আসবে এ অঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকায়। পদ্মাপার ও কেরানীগঞ্জের মানুষ প্রত্যাশাও করে তাই।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই অঞ্চলে ব্যাঙের ছাতার মতো ইটভাটা গড়ে ওঠায় পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। অন্যদিকে রয়েছে ধলেশ্বরী নদী ঘিরে একটি অপরাধীচক্রের তৎপরতা। এই অঞ্চলে একটি আধুনিক বিমানবন্দর নির্মাণ হলে এসব নেতিবাচক কর্মতৎপরতার অবসান হবে।
বেসরকারি বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, পদ্মা সেতু ও ঢাকার কাছাকাছি লাগসই কোনো একটি স্থানে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাই করে দেখা হচ্ছে। এর জন্য পদ্মা সেতু প্রকল্প এলাকায় সরেজমিনে পরিদর্শনও করেছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। ঢাকা থেকে দূরত্ব, ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগব্যবস্থা, জমির পর্যাপ্ততা, আন্তর্জাতিক রুট, সড়ক, রেল ও নদীপথে যোগাযোগব্যবস্থা, ভবিষ্যতে সম্প্রসারণের সম্ভাবনা, পুনর্বাসন, যাতায়াত খরচ ইত্যাদি বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখে পরিদর্শন করে স্থানগুলোর সম্ভাব্যতা যাচাই করা হচ্ছে। উল্লিখিত বিষয়গুলো বিবেচনায় নিলে কেরানীগঞ্জই এর জন্য উপযুক্ত বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। কেরানীগঞ্জের সঙ্গে বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু, বাবুবাজার ব্রিজ, বুড়িগঙ্গা সেতুর সংযোগ রয়েছে।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, কেরানীগঞ্জ-জাজিরা ও সিরাজদিখানচরসহ বিশাল চরাঞ্চলে গড়ে উঠতে পারে এই আধুনিক বিমানবন্দর। এর জন্য মাওয়া থেকে এই এলাকায় করা যেতে পারে একাধিক সড়ক। জাজিরা, চান্দেরচর, বাউচর, ধলপুরচর, চর পানিয়া, বালুচর, সাপেরচর ও চর সংঘাদি মৌজা এলাকায় আড়াই হাজার একরের বেশি বিস্তীর্ণ খাসজমি পড়ে রয়েছে। এ ছাড়া সিরাজদিখান ও বালুচর ইউনিয়ন এলাকার জমির মূল্য যথেষ্ট কম। খাসকান্দী মৌজায় প্রতি শতাংশ নাল জমি ৭০ হাজার ৬৫২ টাকা, বাড়ির জমি ৭৩ হাজার ৫১২ টাকা, চান্দেরচর মৌজার নাল জমি ৩৪ হাজার ৮০৯ টাকা আর বাড়ির জমি ৭৮ হাজার ৬৮ টাকা, পাইনাচর মৌজায় নাল জমি ৬৫ হাজার ৪৮০ টাকা, আর বাড়ির জমি এক লাখ ৬৯ হাজার ২৮২ টাকা। নদ-নদীর বাইরে এই এলাকার কয়েকটি মৌজায় খাসজমির পরিমাণ এক শ একর। এর অধিকাংশ অস্থায়ী বন্দোবস্তের আওতায় রয়েছে।
সরেজমিনে এসব এলাকা ঘুরে জানা গেছে, পানগাঁও পোর্ট, তেগুরিয়া স্টেডিয়াম, চার লেনের সড়ক, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্ধিতকরণ ক্যাম্পাস, র্যাব সদর দপ্তর ও পাশ দিয়ে নারায়ণগঞ্জ থেকে পদ্মা সেতুতে যুক্ত হওয়া রেলপথ নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া এরই মধ্যে এই এলাকায় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) আবাসন প্রকল্প ছাড়াও প্রিয়প্রাঙ্গন, বসুন্ধরা, সাউথ টাউন আবাসিক প্রকল্প ও আমিন মোহাম্মদ গ্রুপের আবাসিক প্রকল্প গড়ে উঠেছে। রয়েছে ‘ডিসি প্রকল্প’ নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠিত আবাসিক প্রকল্প। সব মিলিয়ে এলাকাটি ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে বিশাল সম্ভাবনা। যে স্থানটিতে বিমানবন্দর গড়ে উঠতে পারে ওই এলাকার উত্তর-পশ্চিমে রয়েছে ঢাকা-মাওয়ার চার লেনের সড়ক। দক্ষিণে রয়েছে বালুচর বাজার ও ধলেশ্বরী নদী। পূর্ব পাশে রয়েছে জাজিরা ক্লাব ও বুড়িগঙ্গা এবং ধলেশ্বরী নদীর মোহনা। রাজধানীর জিরো পয়েন্ট থেকে এখানকার দূরত্ব ১৫-২০ কিলোমিটার। আর শান্তিনগর থেকে ঝিলমিল প্রকল্পে রাজউকের পরিকল্পনায় থাকা ফ্লাইওভার নির্মাণ হলে সেখানে পৌঁছাতে সময় লাগবে মাত্র ২০-২৫ মিনিট।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, ওই এলাকার খাসজমিতে বিভিন্ন প্রভাবশালী গড়ে তুলেছেন দেড় শতাধিক ইটভাটা। এতে করে ওই এলাকা ও আশপাশের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। এ ছাড়া ধলেশ্বরী নদী এলাকা রাতের বেলা হয়ে ওঠে অপরাধীদের অভয়ারণ্য। গত কয়েক বছরে বেশ কয়টি লাশ পাওয়া গেছে এই এলাকায়। আর প্রতিদিনই ঘটছে চুরি-ডাকাতির ঘটনা। সংশ্লিষ্টরাসহ এলাকাবাসী আশা করছেন, পরিবেশবান্ধব আধুনিক একটি বিমানবন্দর নির্মাণ করা গেলে এ এলাকায় ব্যাপক উন্নয়নের ছোঁয়া লাগবে। এতে করে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন হবে।
বালুচর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, ‘এই অঞ্চলে যদি একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হয়, আমরা অবশ্যই স্বাগত জানাব। কারণ বিমানবন্দর হলে আমাদের এলাকা অনেক উন্নত হবে। একটি পরিবেশবান্ধব বিমানবন্দর করতে সরকার এখানে স্থানও বেছে নিতে পারবে। এর জন্য ভূমি অধিগ্রহণ ঝামেলাও কম হবে। এই এলাকায় সাধারণ মানুষের বসতি খুব কম। অথচ রয়েছে বিপুল পরিমাণ খাসজমি।’
চান্দেরচর বাজারের হার্ডওয়্যার ব্যবসায়ী আবুল হাসেম বলেন, ‘এই এলাকায় বিমানবন্দর হইলে খুব ভালো হয়। আমাদের এলাকা শহর হইয়া যাইব। এলাকার পরিবেশ ভালো হইব।’
বালুচর ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড মেম্বার (খাসকান্দি-চান্দেরচর) আলহাজ মো. আমজান হোসেন বলেন, ‘এখানে বিমানবন্দর হলে আমরা অবশ্যই স্বাগত জানাব। এ ব্যাপারে সরকারকে আমরা সব ধরনের সহযোগিতা করব। এতে যাতায়াতব্যবস্থা এবং এলাকাবাসীর সার্বিক কল্যাণ হবে।’
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, ‘কেরানীগঞ্জ অত্যন্ত সুন্দর জায়গা। চাইলে সেটি ইতালির ভেনিসের মতো সাজানো যায়। এখানে বিমানবন্দর করার সুযোগ রয়েছে, যেহেতু এখানে পর্যাপ্ত খাসজমি আছে। বিমানবন্দর নির্মাণ হলে ওই এলাকায় পর্যটক বাড়বে, জমির মূল্যও বাড়বে।’
সূত্র মতে, এর আগে সরকার মুন্সীগঞ্জের আড়িয়াল বিলে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়। ২৫ হাজার একর জমি নিয়ে বিমানবন্দরটি নির্মাণ করার কথা ছিল। এর মধ্যে ১০ হাজার একর জমিতে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণ এবং বাকি ১৫ হাজার একর জমিতে বঙ্গবন্ধু সিটি গড়ে তোলার পরিকল্পনা ছিল; কিন্তু স্থানীয়রা রাজি না হওয়ায় আড়িয়াল বিলে বিমানবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা বাদ দিয়ে বিকল্প স্থান খোঁজা শুরু হয়। এর জন্য সম্ভাব্য চারটি স্থান নির্ধারণ করা হলেও উপযুক্ততা বিবেচনায় এখনো কোনোটি চূড়ান্ত হয়নি। পদ্মার এই পারে মাওয়া অংশে এবং ওই পারে জাজিরা অংশে। ওই পারে চর জানাজাতে (শিবচর, মাদারীপুর) বিমানবন্দর নির্মাণের সম্ভাব্যতার কথা বলা হয়। তবে নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, ঢাকা থেকে অনেক দূরে বিমানবন্দর নির্মাণ করা হলে ভোগান্তিতে পড়বে যাত্রীসাধারণ।
জানতে চাইলে স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, ‘সমন্বিত পরিকল্পনায় বিমানবন্দর নির্মাণ করতে হয়। এর সঙ্গে মূল শহরের সহজ যোগাযোগব্যবস্থা থাকা জরুরি। কেরানীগঞ্জে প্রচুর খাসজমি রয়েছে এই বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানে বিমানবন্দর করতে হলে মানুষকে উচ্ছেদ করতে হবে না। আর বিমানবন্দরের পাশ দিয়ে যদি জলযান চলাচলের ব্যবস্থা রাখা যায় সেটি আরো ভালো। এখন যেই পরিস্থিতি তাতে শাহজালাল বিমানবন্দর আর রাখার সুযোগ নেই। কেরানীগঞ্জে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় একটি সুন্দর বিমানবন্দর করা যেতে পারে। এখানে সব ধরনের যোগাযোগব্যবস্থার অপার সম্ভাবনা রয়েছে।’
http://kalerkantho.com/home/printnews/611086/2018-03-09