ইতিহাসের পাতায় বিক্রমপুরের বীরেরা

471

যুগে যুগে বহু ক্ষণজন্মা মহাপুরুষের আবির্ভাব হয়েছে বিক্রমপুরের মাটিতে। তাদের জ্ঞান ও কর্মময় জীবন শুধু বিক্রমপুরকেই নয়, গোটা বাঙালি জাতিকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করে গেছেন। প্রাচীনকালের এমন মহাপুরুষের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন রাজা শ্রীচন্দ্র, অতীশ দীপঙ্কর এবং ধর্মপাদ।

পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা অর্থাৎ তৎকালীন বঙ্গ রাজ্যের সবচেয়ে শক্তিশালী স্বাধীন রাজবংশ ছিল চন্দ্রবংশ (৯০০-১০৪৫ খ্রি.)। এ বংশের রাজারাই বিক্রমপুরে সর্বপ্রথম রাজধানী গড়ে তোলেন। চন্দ্রবংশের দ্বিতীয় রাজা শ্রীচন্দ্র (৯৩০-৯৭৫ খ্রি.) প্রথম বিক্রমপুরে রাজধানী প্রতিষ্ঠা করে রাজ্য পরিচালনা করেন। তিনি খুব শক্তিধর রাজা ছিলেন বলে জানা যায়।

শ্রীচন্দ্রের রাজ্য উত্তর-পূর্ব কামরূপ এবং উত্তরে গৌড় এ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। তার উপাধি ছিল পরমেশ্বর, পরম ভট্টারক, মহারাজধিরাজ। চন্দ্রবংশের রাজারা প্রায় দেড়শ’ বছর রাজত্ব করেন। এ বংশের রাজারা সবাই ছিলেন বৌদ্ধ। পরবর্তী রাজবংশের রাজারাও বিক্রমপুরকে রাজধানী করে রাজ্য পরিচালনা করেন।

প্রাচীন বিক্রমপুরের আরেক মহান ব্যক্তিত্ব হচ্ছেন শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্কর। চন্দ্রবংশের রাজা কল্যাণ চন্দ্রের রাজত্বকালে (৯৭৫-১০০০ খ্রি.) সর্বকালের শ্রেষ্ঠ এই বাঙালি মনীষী ৯৮২ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গের রাজধানী বিক্রমপুরের বজ্রযোগিনী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বিক্রমপুরের এই আলোকিত সন্তান অজ্ঞানতা ও অন্ধকারের জগতে উদিত হয়েছিলেন জ্ঞানের সূর্যমশাল  নিয়ে। তার প্রতিভা ও মনীষার উজ্জ্বল জ্যোতিতে প্লাবিত হয়েছিল পুরো এশিয়া-গোটা বৌদ্ধ জগৎ।

অন্য খবর  বারুয়াখালীতে আন্ত:স্কুল বিতর্ক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত

বিক্রমপুরের এই ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ জ্ঞানের ভুবনে তার অসামান্য অবদানের মাধ্যমে বাঙালি জাতিকে বিশ্ব দরবারে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করে গেছেন। এশিয়ার চোখ হিসেবে বিশ্বখ্যাত দীপঙ্কর শুধু একজন বৌদ্ধ ভিক্ষুই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একাধারে দার্শনিক, কবি, শব্দবিজ্ঞানী, সঙ্গীতজ্ঞ, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, পরিকল্পনাবিদ ও সমাজ সংস্কারক। তিনি দুই শতাধিক মৌলিক গ্রন্থ রচনা, অনুবাদ ও সম্পাদনা করেন। এ বিস্ময়কর প্রতিভার জন্য তিনি তিব্বতী উপাধি ‘অতীশ’ অর্থাৎ মহান বা শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেন।

প্রাচীন বিক্রমপুরের আরো একজন প্রাতঃস্মরণীয় মনীষী হচ্ছেন কবি-দার্শনিক ধর্মপাদ। যে ক’জন মহাপণ্ডিত বাংলা সাহিত্যের উন্মেষ ঘটিয়েছিলেন, ধর্মপাদ হচ্ছেন তাদের একজন। উল্লেখ্য, খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দী থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে রচিত বৌদ্ধ দোহ সংকলন চর্যাপদ বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন হিসেবে সর্বজনস্বীকৃত। এই গীতি পদাবলীর রচয়িতা ছিলেন সহজিয়া বৌদ্ধ চার্যরা। হাজার বছরের প্রাচীন বাংলা ভাষার একমাত্র ও আদি নিদর্শন চর্যাপদ এখন সেকালের এ অঞ্চলের ধর্মীয়, আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনাচারের প্রামাণ্য দলিল হি

সেবে নিবেচিত হচ্ছে। এই দলিল রচয়িতা ২৪ জনের অন্যতম ধাম বা ধর্ম দা’র জন্ম বিক্রমপুরের এক ব্রাহ্মণ বংশে। ঐতিহাসিক রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে ধর্মপাদ বিগ্রহ পাল নারায়ণ পালের রাজত্বকালে জীবিত ছিলেন। চর্যাপদের সর্বাধিক সংখ্যক রচয়িতা কাহ্ন বা কাহ্নপাদের শিষ্য ছিলেন। 

আপনার মতামত দিন