ছবি তুলেন ক্যান? ছবি তুইলা কি ঐবো? কত ছবি তুললো আর মন্ত্রীরা কত ওয়াদা দিয়া গেলো। গাঙ্গে নাকি বান দিয়া দিবো। কই কি হইছে? কিছুই হয়নাই। হ হইছে আমদের সর্বনাস হইছে পদ্মায় বাপ-দাদার ভিটা গিলা ফালাইছে। আর ফিরা পামু না। আপনেরা তো ভোট নিবার সময় কন পাশ করলেই গাঙ্গে বান দিমু পাশ করলে আমাগো কতা মনেও করেন না। ঠিক এ ভাবেই কথা গুলো বলছিলেন দোহার উপজেলার ধোইয়ার গ্রামের জহুরা বেগম। বয়স ৮০ শেষ ৮১ এ পা রাখলেন এ বছর। তিনি এমন ভাবে কথা গুলো বলতে ছিলেন মনে হয় সব দোষই আমার।
দীর্ঘ দুই যুগের অব্যাহত ভাঙনে কালক্রমে মানবিক বিপর্য়য় নেমে এসেছে দোহার ও নবাবগঞ্জ উপজেলার নয়াবাড়ী ও জয়কৃপুর ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম। পদ্মা নদীর অব্যাহত ভাঙন দোহার-নবাবগঞ্জ-মানিকগঞ্জ রক্ষা বেড়ীবাঁধের ধোয়াইর বাজার সংলগ্ন দেওয়ান বাড়ীর মোড়ের অংশে ভাঙন দেখা দেয়ায় তাদের বসত ভিটা ভাঙন ঝুঁকিতে রয়েছে। পদ্মার ভয়াবহ ভাঙ্গনের শিকার প্রায় ১৫০০ পরিবারের এখনও আশ্রয়ের ব্যবস্থা গ্রহন করেনি সরকার। প্রতি বছরই নদীর তীরবর্তী গ্রামের পর গ্রাম ভেঙে চলেছে। শতশত পরিবার হচ্ছে গৃহহারা। ভাঙন এলাকা পরিদর্শনে এসে জন প্রতিনিধিরা ভাঙন কবলিতদের জন্য আবাসন ব্যবস্থার প্রতিশ্রুতি দিলেও তা বাস্তবায়িত আজও বাস্তবায়িত হয়নি।
জানা গেছে, এ বছর বর্ষার শুরুতেই বিভিন্ন দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারনে পদ্মার সেই ভয়াবহ ভাঙ্গন আবারও আগ্রাসী রূপ নিয়েছে। এরই মধ্যে গত এক মাসে প্রায় ৩০টি পরিবার তাদের ভিটে মাটি হারিয়েছে। এছাড়া দোহার-নবাবগঞ্জ-মানিকগঞ্জ (কাশিয়াখালী বাঁধ) বেড়ীবাঁধের ধোয়াইর বাজার সংলগ্ন দেওয়ান বাড়ীর মোড়ের বেশির ভাগ অংশ ভেঙ্গে গেছে। ভাঙন ঝুঁকিতে রয়েছে আরো ৪-৫টি পয়েন্ট। ফলে বেড়িবাঁধের উপর দিয়ে গাড়ী চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। চরম ভোগান্তিতে পড়েছে সাধারণ জনগণ। যে কোন মুহূর্তে উত্তাল পদ্মার পানির চাপে বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে বিস্তীর্ন এলাকা প্লাবিত হওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে।
এলাকার সবচেয়ে বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাহ্রা হাবিল উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয় ভাঙ্গন থেকে মাত্র ১০০ গজ দূরে অবস্থান করছে। যে কোন সময় ভেঙ্গে যেতে পারে গুরুত্বপূর্ন এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এছাড়া স্কুল, মাদ্রাসা, কবরস্থান ও মসজিদসহ এসব এলাকার প্রায় ৩০টি প্রতিষ্ঠান ভাঙ্গনের মারাত্মক ঝূঁকির মধ্যে রয়েছে। ছোট বড় ৫টি বাজারও যে কোন সময় ভেঙ্গে নদীগর্ভে চলে যেতে পারে। স্থানীয় বাসিন্দা আনছার আলী বলেন, গত বছর ভাঙ্গন কবলিত এলাকা পরিদর্শনের সময় স্থানীয় সাংসদ ও প্রতিমন্ত্রী আব্দুল মান্নান খান সকল পরিবারকে খাস জমিতে ঘরবাড়ী তুলে দেয়ার কথা বলেছিলেন। কিন্তু তার কিছুই বাস্তবায়ন হয়নি।
বাহ্রা হাবিল উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক লূৎফর রহমান বলেন, মন্ত্রী মহোদয় বার বার ওয়াদা দেয়ার পরও কেন বাধ রক্ষায় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলো না তা বুঝতে পারলাম না। আমার এই স্কুলে ২কোটি টাকার ভবন আছে। এগুলো রক্ষা করার জন্য খুব দ্রুত ব্লগ ও বালুর বস্তা ফেলা খুবই জরুরী। না হলে এলাকার একমাত্র উচ্চ বিদ্যালয়টি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে।
বিগত ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ ভাঙগনের পর দীর্ঘ ১৪ বছর পর গত বার থেকে পদ্মা নতুন করে অগ্রাসী হয়ে উঠেছে। এরই মাঝে সব হারিয়ে কেউ কেউ হয়েছেন সর্বশান্ত। চলে গেছেন এলাকা ছেড়ে অন্যত্র। যারা আবার মাটির টানে বাপ-দাদার পৈত্রিক ভিটা আঁকড়ে ধরে রাখার চেষ্টা করছে তাঁর ভাঙ-গড়ার সাথে যুদ্ধ করছে প্রতিনিয়ত। কেউ কেউ ৫/৬ বার ভাঙনের শিকার হয়ে সব হারিয়েও এলাকায় বসতি গড়ছেন মায়ার টানে। অনেকে জমি জমা ফেলে রেখে আগেই নিরাপদে চলে যাচ্ছেন। আর যাদের অন্যত্র যাওয়ার মত সুযোগ নেই তারা রাস্তার পাশে অথবা পরিত্যক্ত কোন জায়গায় খোলা আকাশের নীচে কোন রকমভাবে ঠাঁই নিয়েছেন।
ভাঙন কবলিত দুর্দশাগ্রস্থ মানুয়ের পাশে কেউ নেই। গত বছর ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রানালয়ের সচিব নদী ভাঙন এলাকা পরিদর্শনে এলে স্থাণীয় জনতা তাকে প্রায় ১ ঘন্টা অবরুদ্ধ করে রাখে পরে স্থাণীয় প্রশাসন ও ৩ দিনের সময় নিয়ে পূর্বের প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন ৩ দিনের মধ্যে বাস্তবায়ন করার আশ্বাস দিলে তাকে ছেওে দেওয়া হয়। গত বছর পদ্মা ভাঙন এলাকা পরিদর্শন করতে এসে পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমান তালুকদার বলেন বর্তমানে পদ্মা ভাঙনের তীব্রতা অনেক।
এখন পদ্মার মধ্যে টাকা ফেললে কোন লাখ হবে না। বন্যার পানি কমার পর শুল্ক মৌসুমে পদ্মা ভাঙন প্রতিরোধের জন্য বেশ কয়েকটি পয়েন্টে বাঁধ দেওয়া হবে। যার ব্যায় ধরা হয়েছে ১০০ কোটি টাকা। এ বাঁধের মাধ্যমে আমরা নির্বাচনী ওয়াদার বাস্তবায়ন করবো। এ জন্য আপনাদের ধৈর্য্য ধরতে হবে। জননেত্রী শেখ হাসিনা ২০০৮ সালের জয়পাড়া বড় মাঠ (ফুটবল খেলার মাঠ) নিবার্চনী জনসভায় ওয়াদা করেছিল পদ্মা নদী ভাঙ্গন রক্ষায় বাঁধ দেয়া হবে। সরকারের সাড়ে ৪ বছর কেটে গেলো বাঁধ এখনও দেওয়া হলো না।
দোহার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শামীমুল হক পাভেল বলেন, “ভাঙ্গনরোধের ব্যবস্থা নিতে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে বলা হয়েছে। এছাড়া সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখা হচ্ছে।” সব হারিয়ে এমন দুঃসহ যন্ত্রণা নিয়েই বেঁচে আছে নদী ভাঙন কবলিত এলাকার মানুষ। দিন গেলো বছর গেলো এ সরকারও যাওয়ার সময় কিন্তু ওয়াদা আর প্রতিশ্রুতি অন্তরে মধ্য গেথেই রয়ে গেলো বাস্তব রূপ ধারণ করলো না।