অমর সাহিত্য ড্রাকুলা

381

পৃথিবীর ইতুহাসে যে কয়টি সাহিত্য কর্ম মানুষের মনে চির জীবনের জন্য স্থান করে নিয়েছে তার মধ্যে বিখ্যাত আইরিস সাহিত্যিক ব্রাম স্টোকারের ড্রাকুলা অন্যতম। ১৮৯৭ সালের মে মাসে প্রকাশিত এই উপন্যাসের প্রধান খলচরিত্র ভ্যাম্পায়ার কাউন্ট ড্রাকুলা। আর্চিবল্ড কনস্টেবল অ্যান্ড কোম্পানি এই উপন্যাসের প্রথম প্রকাশক। সর্বকালের সেরা এই ভয়াল উপন্যাসের পরিচিতি থাকছে আজ আপনাদের জন্য।
ড্রাকুলা উপন্যাসটি সাহিত্যের একাধিক বর্গের অন্তর্ভুক্ত। এগুলি হল ভ্যাম্পায়ার সাহিত্য, ভৌতিক সাহিত্য, গথিক উপন্যাস ও আক্রমণ সাহিত্য। গঠনগতভাবে এটি একটি পত্রোপন্যাস যা একাধিক চিঠি, দিনলিপি, জাহাজের নথি ইত্যাদির আকারে রচিত। সাহিত্য সমালোচকেরা এই উপন্যাসে ভিক্টোরিয়ান সংস্কৃতিতে নারীর স্থান, প্রথাগত ও রক্ষণশীল যৌনতা, অভিনিবেশ, সাম্রাজ্যবাদ, উত্তরসাম্রাজ্যবাদ ও লোককথা ইত্যাদি নানা উপাদান পরীক্ষা করে দেখেছেন। স্টোকার ভ্যাম্পায়ারের আবিষ্কর্তা না হলেও, বিংশ ও একবিংশ শতাব্দীর একাধিক নাট্য, চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন সংস্করণে ভ্যাম্পায়ারের যে জনপ্রিয়তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তার জন্য এই উপন্যাসখানিই এককভাবে দায়ী।

কাহিনি-সারাংশ

উপন্যাসের চরিত্র সম্পর্কে স্টোকারের স্বহস্তলিখিত নোট।

এই উপন্যাসখানি প্রধানত বিভিন্ন বর্ণনাকারীর দিনলিপি ও চিঠিপত্রের আকারে লিখিত। এই বর্ণনাকারীরা উপন্যাসের প্রধান চরিত্রও বটে। যে ঘটনাগুলি উপন্যাসের কোনো চরিত্রই সরাসরি প্রত্যক্ষ করেনি, সেগুলি স্টোকার বর্ণনা করেছেন সংবাদপত্র প্রতিবেদনের আকারে। কাহিনির শুরুতেই সদ্য পাস করা ইংরেজ আইনজীবী জোনাথান জার্কার প্রথমে ট্রেন ও পরে ঘোড়ার গাড়িতে চেপে ট্রানসিলভ্যানিয়া, বুকোভ্যানিও ও মলডাভিয়ার সীমান্তপ্রদেশে অবস্থিত ক্যাপারথিয়ান পর্বতমালায় কাউন্ট ড্রাকুলার নির্জন পোড়ো দুর্গের পথে যাত্রা করছেন। তাঁর এই যাত্রার উদ্দেশ্য হার্কারের নিয়োগকর্তা ইংল্যান্ডের এক্সেটরের পিটার হকিনসের একটি রিয়্যাল এস্টেট চুক্তি বিষয়ে ড্রাকুলাকে আইনি সহায়তা প্রদান। প্রথমে ড্রাকুলার রাজকীয় চালচলনে বিমোহিত হলেও ক্রমে হার্কার বুঝতে পারেন যে তিনি আসলে এই দুর্গে বন্দী হয়ে পড়েছেন। ড্রাকুলার নৈশজীবনের বিভিন্ন বীভৎস দৃশ্যও তাঁর নজরে আসে। ড্রাকুলা তাঁকে রাত্রে তাঁর কক্ষের বাইরে যেতে নিষেধ করেছিলেন। তা সত্ত্বেও এক রাত্রে তিনি কক্ষের বাইরে বেরিয়ে তিন লাস্যময়ী স্ত্রী ভ্যাম্পায়ারের খপ্পরে পড়েন। এরা ছিল ড্রাকুলার বউ। শেষ মুহুর্তে কাউন্ট তাঁকে রক্ষা করেন। প্রয়োজনীয় আইনি সাহায্য ও ইংল্যান্ড ও লন্ডন সম্পর্কে সম্পূর্ণ জ্ঞানলাভ করার পূর্বে কাউন্ট তাঁকে হত্যা করতে চাইছিলেন না। তাঁর পরিকল্পনা ছিল লন্ডনের লক্ষ মানুষের মধ্যে গিয়ে উপস্থিত হওয়া। হার্কার কোনো মতে প্রাণ হাতে করে দুর্গ থেকে পালিয়ে আসেন।

এর কিছুকাল পরেই ডিমিটার নামে একটি রাশিয়ান জাহাজ ভারনা থেকে নোঙর তুলে ইংল্যান্ডের হুইটবির উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে এক ভয়ানক ঝড়ের কবলে পড়ে। জাহাজের নাবিকেরা সকলেই নিখোঁজ হয়ে যায়। ধরে নেওয়া হয় যে তারা সকলেই মারা পড়েছে। কেবলমাত্র জাহাজের হালের সঙ্গে বাঁধা অবস্থায় ক্যাপ্টেনের মৃতদেহ পাওয়া যায়। ক্যাপ্টেনের নথি থেকে জানা যায় যে যাত্রাকালে জাহাজে কিছু অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল। তারপর থেকেই জাহাজের মাঝিমাল্লারা একে একে নিখোঁজ হয়ে যেতে থাকে। মনে করা হতে থাকে জাহাজে কোনো অশুভ শক্তির আবির্ভাব ঘটেছে। জাহাজ থেকে একটি বিরাট কুকুরের আকৃতিবিশিষ্ট জানোয়ারকে লাফিয়ে সমুদ্রতীরে নেমে যেতেও দেখা গিয়েছিল। জাহাজের মালের তালিকায় ছিল ট্রানসিলভ্যানিয়া থেকে আসা রুপালি বালি ও “মৌলড” (“mould”) বা গুঁড়ো মাটি।

অন্য খবর  ইতিহাসের সফল নারী শাসক

এরপরই ড্রাকুলা হার্কারের প্রণয়ী উইলহেমিনা “মিনা” মুরে ও তাঁর বান্ধবী লুসি ওয়েস্টেনরার সন্ধান পান। একই দিনে লুসি ড. জন সিউয়ার্ড, কুয়েন্সি মরিস ও মাননীয় আর্থার হোমউডের কাছ থেকে বিবাহের প্রস্তাব পান। লুসি সিউয়ার্ড ও মরিসের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে হোমউডের প্রস্তাবটি গ্রহণ করেন। এতে অবশ্য কোনো বন্ধুবিচ্ছেদ ঘটে না। সকলের মধ্যেই বন্ধুত্বসম্পর্ক বজায় থাকে। ইতিমধ্যে ড্রাকুলা ও সিউয়ার্ডের রোগী রেনফিল্ডের সাক্ষাৎ ঘটে। রেনফিল্ড লোকটা ছিল পাগল। সে ছোটো থেকে বড়ো আকারের নানারকম পোকামাকড়, মাকড়সা, পাখি আর অন্যান্য জন্তু খেয়ে বেড়াতো তাদের “জীবনীশক্তি” শুষে নেওয়ার জন্য। রেনফিল্ড গতিবিধি অনুধাবনকারীর কাজ করে। সে ড্রাকুলার নৈকট্য অনুধাবন করে সেই অনুযায়ী সূত্র যোগাতো।

http://upload.wikimedia.org/wikipedia/commons/thumb/3/34/Bram_Stoker_1906.jpg/200px-Bram_Stoker_1906.jpg

ব্রাম স্টোকার

হঠাৎ করে লুসি সন্দেহজনকভাবে শুকিয়ে যেতে শুরু করে। তাঁর সকল পাণিপ্রার্থীরা চিন্তিত হয়ে পড়েন। সিউয়ার্ড আমস্টারডামে তাঁর বৃদ্ধ শিক্ষক অধ্যাপক আব্রাহাম ভ্যান হেলসিংকে ডেকে আনান। ভ্যান হেলসিং দেখামাত্র লুসির এই অবস্থার কারণটি বুঝতে পারেন। কিন্তু তিনি কাউকে কিছু বলতে অস্বীকার করেন। কারণ তিনি জানতেন, ভ্যাম্পায়ারের কথা বললে তাঁর প্রতি সিউয়ার্ডের যে আস্থা আছে তা নষ্ট হয়ে যাবে। ভ্যান হেলসিং বিভিন্ন রকম ভাবে ব্লাড ট্রান্সফিউসন করে তাকে সারাবার চেষ্টা করেন। কিন্তু তা ব্যর্থ হয়। সিউয়ার্ডকে একটি চিঠিতে লুসির উপর নজর রাখার নির্দেশ দিয়ে ভ্যান হেলসিং এক রাত্রিতে আমস্টারডামের উদ্দেশ্যে রওনা হন। চিঠিটি ভুল ঠিকানায় গিয়ে পড়ে। সেই রাতেই লুসি আর তাঁর মা-কে একটি নেকড়ে আক্রমণ করে। দুর্বল হৃদয়ের মিসেস ওয়েস্টেনরা ভয়েই মারা যান এবং লুসিও তার অনতিবিলম্বে মারা যান। উল্লেখ্য, ওই নেকড়েটিকে লন্ডনের চিড়িয়াখানা থেকে ড্রাকুলাই ছেড়ে দিয়েছিলেন কিছু কাজ হাসিলের জন্য।

লুসিকে কবর দেওয়া হয়। কিন্তু তারপরই সংবাদপত্রের প্রতিবেদন থেকে জানা যেতে থাকে যে রাতে একটি “ব্লুফার লেডি” (ছোটোদের বর্ণনা অনুযায়ী, অর্থাৎ “সুন্দরী নারী”) ছোটো ছেলেমেয়েদের পিছু নিচ্ছে।[৩] ভ্যান হেলসিং বুঝতে পারেন যে লুসি একটি ভ্যাম্পায়ারে পরিণত হয়েছে। তিনি সকল বৃত্তান্ত সিউয়ার্ড, লর্ড গডামিং ও মরিসের কাছে প্রকাশ করেন। তাঁদের সাহায্যে ভ্যান হেলসিং লুসিকে খুঁজে বার করেন এবং লুসির ভ্যাম্পায়ার সত্ত্বা ও আর্থারের মধ্যে একটি বিশ্রী বিবাদের পর তাঁরা লুসির হৃদপিণ্ডে শূল বিদ্ধ করেন, তার মুণ্ডচ্ছেদ করেন ও মুখে গার্লিক ঢেলে দেন।

অন্য খবর  মিজানুর রহমান শমশেরীর দুটি কবিতা

প্রায় একই সময় বুদাপেস্ট থেকে সুস্থ হয়ে ফিরে আসেন জোনাথান হার্কার। বুদাপেস্টেই মিনা তাঁর সঙ্গে যোগ দেন ও দুর্গ থেকে পালিয়ে এসে তাঁরা বিবাহ করেন। এরপর জোনাথান ও মিনা দলের সঙ্গে যোগ দেন এবং ড্রাকুলার সঙ্গে মোকাবিলার কথা ভাবতে থাকেন।

ড্রাকুলা যখন জানতে পারেন যে ভ্যান হেলসিং ও অন্যান্য তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন, তখন তিনি তাঁদের সঙ্গে দেখা করে এবং মিনাকে তিন বার দংশন করে প্রতিশোধ নেন। ড্রাকুলা মিনাকে তাঁর রক্ত পান করান। এর পরে দুজনের মধ্যে একটি অতিলৌকিক বন্ধন সৃষ্টি হয়। এর ফলে ড্রাকুলা মিনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেন। এর থেকে উদ্ধার পাওয়ার একমাত্র রাস্তা ছিল প্রথমেই ড্রাকুলাকে হত্যা করা। মিনার শিরায় ড্রাকুলার রক্ত বইতে শুরু করলে মিনা ড্রাকুলার নিয়ন্ত্রণাধীন হয়ে পড়ে। সজ্ঞান অবস্থা থেকে সে মাঝে মাঝেই অর্ধ-চৈতন্য অবস্থায় চলে যেতে থাকে, যে অবস্থায় তার সঙ্গে ড্রাকুলার টেলিপ্যাথিক যোগাযোগ স্থাপিত থাকে। কিন্তু এই সংযোগটি তাঁরা ব্যবহার করতে থাকেন ড্রাকুলার গতিবিধি অনুধাবনের জন্য। ভ্যান হেলসিং মিনাকে সম্মোহন করে ড্রাকুলা কোথায় আছে তা জেনে নিতে থাকেন। কিন্তু ড্রাকুলার দুর্গের কাছাকাছি আসার পর থেকে এই সংযোগটি দুর্বল হয়ে যেতে থাকে।

http://upload.wikimedia.org/wikipedia/commons/thumb/a/af/Vlad_Tepes_002.jpg/200px-Vlad_Tepes_002.jpg

ইতিহানে ইনিই ড্রাকুলা নামে পরিচিত। তিনি ছিলেন হাঙ্গেরীর ওয়ালচিয়া প্রদেশের রাজা।

ড্রাকুলা ট্রানসিলভ্যানিয়ায় তাঁর দুর্গে ফিরে আসেন। ভ্যান হেলসিং-এর দল তাঁর পিছু নেন। শেষে তাঁরা সূর্যাস্তের পূর্বেই তাঁর সন্ধান খুঁজে বের করে ছুরি দিয়ে তাঁর গলা কেটে ও হৃদপিণ্ডে শূলবিদ্ধ করে তাঁকে ধ্বংস করেন। ড্রাকুলার দেহ মাটির গুঁড়োয় পরিণত হয়। মিনার উপর থেকে তাঁর প্রভাব নষ্ট হয়ে যায় এবং মিনা মুক্ত হয়। শেষ যুদ্ধে জিপসিরা কুইন্সি মরিসকে ড্রাকুলাকে দুর্গে ফিরিয়ে আনার অভিযোগে ছুরি মেরে হত্যা করেন। অন্যরা জীবিত অবস্থায় ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন।

বইয়ের শেষে একটি নোটে জোনাথান ও মিনার বিবাহিত জীবন ও তাঁদের প্রথম পুত্রসন্তানের সম্পর্কে জানানো হয়। ছেলেটির নাম দলের সকল চার সদস্যের নামানুসারে রাখা হয়েছিল। কিন্তু তাকে তাঁদের আমেরিকান বন্ধু কুইন্সির নামানুসারে কুইন্সি বলেই ডাকা হত।

আপনার মতামত দিন