অনিয়ম দুর্নীতি আর নানা অব্যবস্থাপনায় ব্যাংক খাতে চলছে হরিলুট। যাচাই-বাছাই ছাড়াই নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানে যাচ্ছে ঋণ। লাগামহীনভাবে বাড়ছে খেলাপি। ফলে নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন রাখতে গিয়ে মূলধন খেয়ে ফেলছে ব্যাংকগুলো। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর শেষে মূলধন সংকটে পড়েছে সরকারি-বেসরকারি নয় ব্যাংক। এসব ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে ১৯ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা গেছে।
বর্তমানে ব্যাংকগুলোকে ৪০০ কোটি টাকা অথবা ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের ১০ শতাংশের মধ্যে যা বেশি সেই পরিমাণ অর্থ মূলধন হিসেবে সংরক্ষণ করতে হয়। এদিকে ঝুঁকি মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ব্যাসেল-৩ নীতিমালা অনুযায়ী ব্যাংকগুলোকে ১০ শতাংশ ন্যূনতম মূলধনের পাশাপাশি দশমিক ৬২ শতাংশ হারে অতিরিক্ত মূলধন সংরক্ষণ করতে হয়। গত ডিসেম্বর শেষে ন্যূনতম মূলধন সংরক্ষণ করতে ব্যর্থ হয়েছে নয়টি ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাবে দেখা গেছে, ২০১৭ সালের ডিসেম্বর শেষে সরকারি-বেসরকারি ৯টি ব্যাংক মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে। এই ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৯ হাজার ৪৬৭ কোটি টাকা। এদের মধ্যে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ৬টি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ১৭ হাজার ৪৪২ কোটি টাকা। সবচেয়ে বেশি ঘাটতিতে রয়েছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক। এই ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতি সাত হাজার ৭৭৬ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। মূলধন ঘাটতির দিক দিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে সোনালী ব্যাংক। এই ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতি পাঁচ হাজার ৩৯৭ কোটি ২৯ লাখ টাকা। এছাড়া বেসিক ব্যাংক দুই হাজার ৬৫৬ কোটি ৩৮ লাখ টাকা, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব) ৮১৩ কোটি ৩৪ লাখ টাকা, রূপালী ব্যাংক ৬৩৭ কোটি ৬২ লাখ টাকা এবং জনতা ব্যাংকের ১৬১ কোটি ৪৮ লাখ টাকা মূলধন ঘাটতিতে রয়েছে।
বেসরকারি খাতের তিনটি ব্যাংকের মোট মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে প্রায় দুই হাজার ২৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মূলধন ঘাটতি রয়েছে আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের। ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতি এক হাজার ৪৯৫ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। ঘাটতিতে থাকা অন্য দুই ব্যাংক হলো বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক এবং নতুন প্রজন্মের ফারমার্স ব্যাংক। এর মধ্যে ফারমার্স ব্যাংক ২৮২ কোটি ৮৯ লাখ টাকা এবং বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক ২৪৫ কোটি ৫২ লাখ টাকা মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে।
জানা গেছে, সরকারি ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি তৈরি হলে বাজেট থেকে তার যোগান দিতে হয়। জনগণের করের টাকায় বিভিন্ন সময় মূলধন ঘাটতিতে পড়া ব্যাংকগুলোতে অর্থ যোগান দেয় সরকার। তবে করের টাকায় মূলধন যোগানের বরাবরই বিরোধিতা করে থাকেন অর্থনীতিবিদরা।
নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের জোগান দেয়া অর্থ ও মুনাফার একটি অংশ মূলধন হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়। কোনো ব্যাংক মূলধনে ঘাটতি রেখে তার শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দিতে পারে না।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, অনিয়ম দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনার কারণে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। নিয়ম অনুযায়ী খেলাপির বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে গিয়ে মূলধন ঘাটতি বাড়ছে। মোটকথা মূলধন চলে যাচ্ছে। সরকারি ব্যাংকগুলো এ হার বেশি।
তিনি বলেন, প্রতিবছরই বাজেট থেকে এ মূলধন জোগান দেয়। অর্থাৎ অনিয়ম-দুর্নীতি ফলে ঘাটতি হওয়া এ মূলধন পূরণে হচ্ছে জনগণের করের টাকায়। মূলধন সরবরাহের সরকারি উদ্যোগের কোনো যুক্তিযুক্ত নেই। এ উদ্যোগ রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনার অদক্ষতা এবং দুর্নীতিকে উৎসাহিত করার সামিল।
সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, সরকারি টাকা দিয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানকে মূলধন সরবরাহ করা ভুল। এ টাকা অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
মূলধন ঘটতি মেটাতে খেলাপি ঋণ আদায়ে মনোযোগ দিয়ে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর দক্ষতা বাড়ানোর পরামর্শ দেন তিনি। পাশাপাশি খেলাপিঋণ কমাতে ব্যর্থ হলে এসব ব্যাংকের কার্যক্রম সংকুচিত করে সরকারি অর্থ অপচয় রোধ করা প্রয়োজন বলে মনে করেন সাবেক এ গভর্নর।
বাংলাদেশ ব্যাংক অনুযায়ী, ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকগুলোর মূলধন সংরক্ষণের আবশ্যিকতা ছিল ৯০ হাজার ১৫৪ কোটি টাকা। ব্যাংকগুলো সংরক্ষণ করেছে ৯৪ হাজার ৫৬১ কোটি টাকা। অনেক ব্যাংক প্রয়োজনের তুলনায় বেশি মূলধন সংরক্ষণ করেছে। ফলে ৯টি ব্যাংক মূলধন ঘাটতিতে থাকলেও সামগ্রিকভাবে চার হাজার ৪০৬ কোটি টাকা মূলধন উদ্বৃত্ত রয়েছে ব্যাংক খাতে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকখাতে বিতরণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে সাত লাখ ৯৮ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৭৪ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা, যা ডিসেম্বর’১৬ শেষে ছিল ৬২ হাজার ১৭২ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১২ হাজার ১৩১ কোটি টাকা। আলোচিত সময়ে আট ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৩৭৫ কোটি ৪৮ লাখ টাকা।