বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে কত না বিচিত্র ধরনের শিল্প একদা চর্চিত হতো এবং এখনো হয় কিছু কিছু। কিন্তু তার খবর আমাদের মতো শহুরে কিংবা নাগরিক মানুষের কাছে কতটুকু আর পৌঁছায়! প্রান্তজনের শিল্প কখনো কখনো আমরা নাগরিক পরিসরে আলোচিত হতে দেখি বটে কিন্তু এর একটা অংশ ক্রমশ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে- এই সত্য অস্বীকার করা মুশকিল। এমন একটি বিলুপ্ত-প্রায় শিল্প হলো ভেড়ার লোমের কম্বল ।
বইপুস্তক ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে, প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতায় পশুর লোমের প্রচলন ছিল। প্রাচীন সাহিত্যিকসূত্র ঋগ্বেদ-এ এই শিল্পের অর্থাৎ পশম বা লোম দিয়ে বস্ত্রবয়ন এবং সেই বস্ত্র ধৌতকরনের উল্লেখ আছে। তবে বর্তমান বংলাদেশ ভূখন্ডে খুব বেশি মানুষ ভেড়ার লোমকেন্দ্রিক এই বয়নশিল্পের সাথে জড়িত ছিল বলে মনে হয় না। প্রধানত গারলী সম্প্রদায়ের মানুষ এই কাজের সাথে যুক্ত ছিল বলে জানা যায়। তারা নিজেদের উত্তর ভারত থেকে আগত বলে পরিচিয় দিতো। বাংলাদেশের কিছু কিছু অঞ্চলে এই সম্প্রদায়ের মানুষ বাস করতো এবং তারাই প্রধানত ভেড়ার লোম সংগ্রহ করে তা থেকে সুতা তৈরি করে প্রাচীন তাঁতযন্ত্র ব্যবহার করে কম্বল জাতীয় মোটা বস্ত্র তৈরি করতো।
১৯২৯ সালে বঙ্গীয় শিল্প বিভাগের প্রতিবেদনে রাজশাহী, নোয়াখালী, নদীয়া এবং বর্ধমান জেলায় এই কাজের প্রচলন ছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বিশেষ করে, রাজশাহীর কেশবপুর-ভেড়ীপাড়া অঞ্চলে অন্তত বারো-পনেরোটি পরিবার এই কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিল বলে ১৯২৯ সালের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু তারপর?
খোঁজ-খবর করে জানা গেল, এখন রাজশাহী শহরের ভেড়ীপাড়ায় ভেড়ার লোম দিয়ে কম্বল বানানোর কারিগরদের কোনো নিশানা খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে ২০০৮ সালের মার্চ মাসের শেষে যখন আমরা চাঁপাইনবাবগঞ্জে ভেড়ার লোমের শিল্পের খোঁজখবর করতে যাই, তখন সেখানে কয়েক ঘর মানুষ ভেড়ার লোমের কম্বল তৈরির সাথে জড়িত ছিলেন। কিন্তু ২০১৭ সালের শেষার্ধে যখন আমরা পুরনো নোটখাতার পাতা থেকে আমাদের লোকজশিল্পের গল্প খোঁজার চেষ্টা করছি, তখন, পুনরায় তাদের খোঁজখবর করতে গিয়ে জানা গেল, জীবন ও জীবিকার তাগিদে বছর পাঁচেক আগে তারা তাদের পেশা পরিবর্তন করেছেন! এ সংবাদ আমাদের খুব বেশি খুশি করতে পারলো না।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ বিডিআর ক্যাম্প আর হর্টিকালচার সেন্টার পেরিয়ে মহানন্দা নদীর তীরের নয়াগোলা নামক ছোট্ট গ্রামটির একটি বাড়িতে প্রায় নয় বছর আগে দেখা এক সত্তোরোর্ধ বৃদ্ধের চেহারায় চোখ আটকে রইলো আমাদের। দৃশ্যের পর দৃশ্য ভেসে এলো। ‘এটাকে লরদ কহে’ কম্বল বোনার তাঁতের কোন যন্ত্রাংশের কী নাম সেটা জানতে চাইলে তবারক আলী বলতে শুরু করেছিলেন এভাবেই। তারপর জমে ওঠে গল্প। সুতার পর সুতা সাজিয়ে যেমন একখানা পুরো কম্বল তৈরি হয়, তেমনি তবারক আলীর গল্পের পর গল্প থেকে এই পুরো গ্রামের একটা মৌখিক ইতিহাসের ধারণা/ অবকাঠামো বুঝতে পেরেছিলাম আমরা। সেই গল্পে আছে ১৯৪৭ সালের দেশভাগ, দেশান্তর আর জীবন ও জীবিকার প্রশ্ন। মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুরের বরোজ গ্রামের মোহাম্মদ আলী ছিলেন খলিফা (দর্জি)। একই এলাকার গারলীপাড়ার অন্য ধর্মাবলম্বী ‘গারলী’ সম্প্রদায়ের লোকজন ভেড়ার লোমের কম্বল তৈরি করতো। মোহাম্মদ আলীর ছেলে ফজলুর রহমান এই গারলীদের কাছ থেকে কম্বল তৈরি করা শেখেন তার প্রথম জীবনে। দেশ বিভাগের কিছু আগে/পরে জঙ্গিপুরের বাপ-দাদার ভিটা ছেড়ে ফজলুর রহমান ভাগ্নে মওলানা নূর মোহাম্মদের পরিবারকে সাথে নিয়ে অন্য অনেকের সাথে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের চাঁপাইনবাবগঞ্জের নয়াগোলা গ্রামে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেন। নতুন জায়গায় এসে জীবিকার প্রয়োজনেই গারলী সম্প্রদায়ের কাছ থেকে শিখে আসা কাজ আঁকড়ে ধরেন ফজলুর রহমান এবং তার ভাগ্নে নূর মোহাম্মদ। পরবর্তীকালে, এই নূর মোহাম্মদের ছেলে হাসমত উল্লা ও সালামত উল্লা এবং একরামুল হক এর ছেলে আবদুল খালেকের পরিবার দীর্ঘদিন ভেড়ার লোমের কম্বল তৈরির কাজে যুক্ত ছিলেন। বিভিন্ন আকারের কম্বল, আসন, জায়নামাজ ইত্যাদি তৈরি করে জীবিকা নির্বাহের চেষ্টা করেছেন তারা দিনের পর দিন। বিপণনের জন্য যোগাযোগ করেছিলেন ঢাকার বিভিন্ন বুটিকশপে, রংপুর আর রাজশাহীর সিল্ক ফ্যাক্টরীগুলোতে- যারা সিল্কের কাপড়ের ব্লক প্রিন্টের কাজ করতে এক সময় ভেড়ার লোমের ছোট ছোট আসন ব্যবহার করতো। কিন্তু হতাশাই বেড়েছে দিনে দিনে।
জীবন ও জীবিকার প্রশ্নে উল্লেখযোগ্য কোন পরিবর্তন আসেনি ভেড়ার লোমের কম্বল তৈরির কারিগর পরিবারগুলোতে। নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ার জন্য বাংলাদেশের স্থানীয়ভাবে এই কম্বলের চাহিদা তৈরি হয়নি কখনো। তাই এর স্থানীয় বাজারও তৈরি হয়নি। এমনকি, খুব বেশি মানুষ জানেও না যে বাংলাদেশে ভেড়ার লোম দিয়ে কম্বল তৈরি হয়। কোন প্রতিষ্ঠান এই শিল্পের উন্নয়নে পৃষ্ঠপোষকতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে- এমন সংবাদ জানা যায় না। এইসব কারণে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভেড়ার লোমের শিল্পকে এখন বলা যেতে পারে একটি বিলুপ্ত-প্রায় শিল্প। খুব সম্ভবত কিছুদিন পর এটা ‘বিলুপ্ত শিল্প’ হয়ে যাবে। তখন এর নিশানা মিলবে শুধু ইতিহাসের পাতায় কিংবা কোনো জাদুঘরে।
লেখা: যথাশিল্প
রচনাসূত্র: https://www.facebook.com/jothashilpa/posts/1371666966289258
আলোকচিত্র: ওয়াহেদ আশরাফ রনি, নয়াগোলা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ২০০৮