বাহ্রা-অরঙ্গবাদ বাঁধের নাম-বিতর্ক প্রসঙ্গে

1489
নদী ভাঙন রোধের দাবীতে

প্রেক্ষাপট ২০০৮ সাল। বাহ্রাঘাট থেকে পদ্মা নদীর তখনও দুরত্ব প্রায় ৩ থেকে ৪ কিলোমিটার। বাহ্রাঘাট থেকে ধুধু চরের সীমা শুরু। কখনও কখনও রিক্সা যেত আবার কখনো যেত না। বালির সাগরে রিক্সা নিয়ে যাওয়াটাও ছিল কষ্টকর। কখনও রিক্সার চাকা দেবে যেত বালিতে, ফলে চালক আর আরোহী দুই জনের জন্যই ছিল সেটা চরম ঝুকিপূর্ন যাত্রা। সেই বছর থেকেই শুরু হলো এই অঞ্চলের নদী ভাঙন।

প্রেক্ষাপট ২০১০। ২০০৮ সালে যে পদ্মা দুই থেকে ৩ কিলোমিটার দুরে ছিল সেটা আজ বাহ্রাঘাটের দ্বারপ্রান্তে। ঘাট থেকে নামলেই পদ্মা নদী। সেই ধুধু বালুর চরের কোন অস্তিত্বই আজ নেই। এক সময়ের বাহ্রা ঘাটের হাসিখুসি মানুষগুলোর চেহারায় আজ পদ্মার রুদ্ররোষের চিন্তায় শোকার্ত ছাপ।

ঐদিকে এই অঞ্চলের অন্যতম সমৃদ্ধ জনপদ অরঙ্গাবাদে শুরু হয়েছে পিতৃপুরুষের ভিটা হারানোর কান্না। চোখের সামনে পদ্মার গর্ভে চলে যাচ্ছে শৈশবের স্মৃতি বিজড়িত অরঙ্গাবাদ বাজার, কালী মন্দির, অরঙ্গাবাদ মাঠ। চোখের জল আর নদীর জল এক হয়ে মুছে দিচ্ছে নিজের শেষ সম্বল ভিটার স্মৃতিটুকু। জন প্রতিনিধি থেকেও নেই। পদ্মাবাধেঁর প্রতিশ্রুতি ভুলে গেছেন জন প্রতিনিধিরা। বেশ কয়েকজন মন্ত্রী আসলেন ভাঙ্গন পরিস্থিতি দেখতে। আসলেন, দেখলেন, চলে গেলেন এবং ভুলে গেলেন। উদ্বাস্তু হলো অরঙ্গাবাদ গ্রামের কয়েক হাজার পরিবার। নাড়িছাড়া হলো হাজার বিশেক মানুষ। নিজের আপন ঠিকানা ভুলে, আত্মীয়তার বন্ধন ছিঁড়ে চলে গেলেন বিভিন্ন জন বিভিন্ন স্থানে। এ যে যুদ্ধের চেয়েও ভয়ানক পরিস্থিতি। যুদ্ধেতো যাই হোক ঠিকানা থাকে আর এখানে যে নেই নিজের সাকিন, নিজের ভূমি, নিজের হারানো সব স্মৃতি।

আছিফুর রহমান
আছিফুর রহমান

প্রেক্ষাপট ২০১৩ সাল। পদ্মা ভাঙ্গন খুবই খারাপ ও নাজুক অবস্থায় চলে এসেছে। বাহ্রা গ্রামের একাংশ ভেঙ্গে গেছে। হুমকির মুখে বাহ্রাঘাট। ইতিমধ্যে মানচিত্র থেকে মুছে ইতিহাসের পাতার স্থান নিয়েছে সমৃদ্ধ জনপদ অরঙ্গাবাদ। তারও আগেই গিয়েছে ইব্রাহীমপুর। ভেঙ্গে গেছে পানকুন্ড গ্রামের অধিকাংশ অঞ্চল।

ধোয়াইর বাজারের দ্বারগোড়ায় নদী। ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে ধোয়াইর বাজারের দিকে। কিন্তু তারপরও মানুষের কোন আশা নেই। নেই নদী তীর রক্ষার কোনো প্রচেষ্টা। যাদের আর্থিক অবস্থা ভাল তারা চলে যাচ্ছেন সাভার বা গাজীপুরের দিকে। নিজের পিতৃভূমি হারিয়ে এই মানুষগুলো এখন নতুন আশ্রয়ে চলে যাচ্ছে। হারিয়ে ফেলছে দোহারের সাথে তার শেষ সম্পর্ক, শেষ যোগাযোগটুকু। যাদের আর্থিক অবস্থা খারাপ তারাও চলে যাচ্ছে দূর দূরান্তে। মানুষের সাথে মানুষের যে আত্মীক সম্পর্কটা তৈরি হযেছিল প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে, তারা আজ বিচ্ছিন্ন। এই কীর্তিনাশা, সর্বনাশা পদ্মা সেই সম্পর্ক নষ্ট করে দিয়েছিল মাত্র ২ বছরে। তারপরেও মানুষের মাঝে তৈরি হয়নি কোন সচেতনতা। মানুষ তাকিয়ে আছে আল্লাহর রহমতের দিকে। অথচ সেই রহমতের প্রত্যাশায় নেই কোন প্রচেষ্টা। এর কি আশু কোন সমাধান হবে না? এরই মাঝে চলে এসেছে আরেকটি নির্বাচন। নির্বাচন-২০১৪। পদ্মাবাধেঁর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারেননি এই অঞ্চলের সংসদ সদস্য।

অন্য খবর  তরুনদের ভাবনা: সম্মেলিত প্রয়াসেই করোনাকে মোকাবেলা করতে হবে

প্রেক্ষাপট ২০১৪। ফেসবুকে সবার সাথে সবার যোগাযোগের জন্য ২০১৩ এর প্রথম দিকে শুরু হয়েছিল ‘দোহারের আড্ডা’ নামে ছোট্ট এক ফেসবুক গ্রুপের। সেই গ্রুপ তৈরি হওয়ার কারনে কিছু মেধাবী, তরুন এবং মানবতাবাদী কিছু মানুষের সাথে পরিচয়ও হয়েছিল। সেই সময় গ্রুপের সদস্যদের মাঝে বেশ আড্ডা হতো। সেটা অনলাইনে হোক বা অফলাইনে হোক। ঢাকার রবীন্দ্র সরোবরে বা জয়পাড়ার রতন ভাস্কর্যের নিচে।

এরকম এক আড্ডায় উঠে আসে পদ্মা বাধেঁর দাবিতে কি করা যায়। সেই সময় কথা উঠলো পদ্মা বাধেঁর দাবিতে কেউ কিছু যেহেতু করছেই না তাহলে আমরা তরুন সমাজ কিছু করছি না কেন। আমার ভাগ্য ভালো সেই আড্ডায় আমি ছিলাম।

যেই কথা সেই কাজ। খোলা হলো পদ্মা বাধের দাবিতে ইভেন্ট। সারা দোহারের সব মেধাবী, শিক্ষিত তরুনেরা সেখানে জমায়েত হয়েছিল। নয়াবাড়ি থেকে জাকির হোসেন, নাহিদুল ইসলাম দ্বীপ, রাজু আহসান কুসুমহাটি থেকে আদনান দোহারী, আবু নাইম দোহারী, তৌহিদুল ইসলাম, রায়পাড়া থেকে মো: জামান, শামীম ইসলাম, আসাদুর রহমান শিপন, আমিনুল ইসলাম মানিক, বিলাসপুর থেকে তৌহিদুল ইসলাম, শেখ সম্রাট হোসেন, হেলাল আহমেদ, হাবিবুর রহমান ঠান্ডু জয়পাড়া বানাঘাটা থেকে ইমরান, সোহাগ, সাজু, মোস্তাকসহ আরো অনেক তরুন সেই দিন এসে উপস্থিত হয়েছিল। সাথে আগে থেকেই ছিল মাহমুদুল হাসান সুমন, মাসুম পারভেজ রবিন, অভিষেক পাল অন্তু, তারেক রাজিব, কামরুল ইসলাম, এডভোকেট আবু সাইদ কাঞ্চন, রাজু আহমেদ, শামীম ইসলাম সহ আরো অনেকে।

সেই দিনই আমরা দোহারের ইতিহাসে প্রথম বাধেঁর দাবিতে মিছিল করি। সেই দিনই শুরু হয়েছিল এক নতুন দিনের। দোহারের তরুন সমাজের গর্জে উঠার দিন। সেই দিন আমাদের সাথে ছিলেন ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভির সিনিয়র রিপোর্টার শিমুল বাশার ভাই। সেই দিনের পর আরো বেশ কয়েকবার আমরা গর্জে উঠেছিলাম বাধেঁর দাবিতে। তারপর আমরা বেশ কয়েকবার মানববন্ধন থেকে শুরু করে মিছিল সবই করেছি। করেছি নিজের ভিটে-মাটি বাঁচানোর তাগিদে।

দোহারের ইতিহাসে সম্ভবত আমাদের এই আন্দোলন সর্ব প্রথম টিভিতে লাইভ সম্প্রচার হয়েছে। যা আমরা করেছিলাম দোহার-নবাবগঞ্জ সোশ্যাল মুভমেন্টের ছায়ায় দাড়িয়ে। সেদিন আমাদের এই তরুনদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল দোহারের সর্বসাধারন মানুষ। মানুষের প্রাণের দাবিতে সেদিন আমাদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল মেঘুলা-মালিকান্দা গ্রামবাসী। আমাদের পাশে এসে দাড়িয়েছিলেন উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মাসুদ পারভেজ, বর্তমান নারিশা ইউনিয়ন চেয়ারম্যান সালাউদ্দিন দ্বরানীসহ সচেতন রাজনীতিবিদরা। সেইদিন তারা একই পতাকার তলে এসে দাড়িয়েছিলেন সাধারন মানুষ হয়ে।

অন্য খবর  ডিসেম্বরে বাংলা সাজে পতাকায়

প্রেক্ষাপট ২০১৬। অবশেষে ১১ বছর পর সালমান এফ রহমান আসলেন দোহারে। সালমান এফ রহমানের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে শুরু হলো পদ্মা বাঁধের কাজ। তিনি নিজে দায়িত্ব নিয়ে শুরু করলেন এই বাধেঁর কাজ। বেশ কয়েকজন মন্ত্রীকে ঢাকা থেকে নিয়ে আসলেন এই বাধেঁর কাজ দ্রুত যেন শুরু হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে। পরিকল্পনা মন্ত্রী মোস্তফা কামালকে কে নিয়ে হেলিকপ্টার ও টাগবোটে ঘুরে বেড়ালেন  মেঘুলা থেকে অরঙ্গাবাদ পর্যন্ত। সরেজমিনে দেখলেন পরিস্থিতি। দোহারে নিয়ে আসলেন পানি সম্পদ মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদকে। অবশেষে সালমান এফ রহমানের প্রতক্ষ্য চাপে শুরু হলো পদ্মা বাঁধের প্রাথমিক কাজ। ২১৭ কোটি টাকার বাজেট নিয়ে শুরু হলো দোহার বাঁচানোর পদ্মা বাধেঁর কাজ।

প্রেক্ষাপট ২০১৭। পদ্মা বাধেঁর প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ হয়েছে। শেষ হয়েছে বস্তা ফেলার কাজ। পদ্মা বাঁধ সংলগ্ন অঞ্চল ধারণ করেছে অসাধারণ সৌন্দর্য। পাড় থেকে পদ্মার বুকে সূর্যের ডুবে যাওয়া দেখতে দোহার-নবাবগঞ্জ থেকে ছুটে আসছে হাজারো ভ্রমণপিপাসু। কিন্তু এই ঘাটের নতুন করে নামকরণ নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন খেলা। বেশ কয়েকভাগে বিভক্ত হয়েছে এই অঞ্চলের কিছু মানুষ। ফেসবুকে চলছে তুমুল প্রচার। এক ভাগ এর নামকরণ করতে চাচ্ছে মৈনটের অনুকরণে “মিনি পতেঙ্গা”। কেউ চাচ্ছে এর নাম হোক “নয়াবাড়ি রিভারভিউ”। কেউ দিচ্ছে “বাহ্রাপোর্ট”।

কিন্তু কেউ মনে রাখছে না অরঙ্গাবাদের ১০ হাজার মানুষের চোখের পানির মূল্য। কেউ ভাবছে না পদ্মায় বিলীন হয়ে যাওয়া বাহ্রা-নয়াডাঙ্গি-ধোয়াইর গ্রামের ভাঙন কবলিত মানুষগুলোর চোখের পানিকে। হয়তো একদিন এই নামকরণের আড়ালে হারিয়ে যাবে অরঙ্গবাদ গ্রামের পাঠাবলির মেলার আনন্দগুলোর গল্প। হারিয়ে যাবে অরঙ্গবাদের বাবুর বাড়ির ইতিহাস। হারিয়ে যাবে হয়তো অরঙ্গাবাদ মাঠের ফুটবল খেলার স্মৃতি। সেই সাথে হারিয়ে যাবে এই অঞ্চলের মানুষগুলোর স্মৃতি, যারা সব হারিয়ে আজ সাভার, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দা তাদের সাথে এই অঞ্চলের শেষ সম্পর্কটুকু।

তাই বলতে চাই, শুধু অনুকরণ নয়। এই অঞ্চলের মানুষের চোখের পানি আর আত্মত্যাগের মূল্যও দেয়া হোক। নাম নিয়ে কোন বিভেদ, দলাদলি না হোক।

আছিফুর রহমান, ছাত্র, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

আপনার মতামত দিন