সোলমনের মন্দির এবং খ্রিস্টের দরিদ্র সহযোগী-সৈনিকবৃন্দ (Poor Fellow-Soldiers of Christ and of the Temple of Solomon) সাধারণ মানুষের কাছে নাইট টেম্পলার নামে পরিচিত। এছাড়া একে অর্ডার অফ দ্য টেম্প্ল-ও বলা হয়ে থাকে। খ্রিস্টান সামরিক যাজক সম্প্রদায়গুলোর (অর্ডার) মধ্যে এটিই সবচেয়ে বিখ্যাত এবং পরিচিত। মধ্য যুগে প্রায় দুই শতক ব্যাপী এই সংগঠনের অস্তিত্ব বিরাজমান ছিল। ১০৯৬ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ক্রুসেডের পরই এর সৃষ্টি হয় যার উদ্দেশ্যে ছিল জেরুজালেমে আগত বিপুল সংখ্যক ইউরোপীয় তীর্থযাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। জেরুজালেম মুসলিমদের দখলে চলে যাওয়ার পরই এই নিরাপত্তার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।
টেম্পোলারদের সিলমোহর। একই ঘোড়ায় বসা দুই জন নাইটের ছবিসংবলিত বিখ্যাত চিত্রসহ যা তাদের আদি দারিদ্র্যের চিহ্ন বহন করে।
১১২৯ খ্রিস্টাব্দে চার্চ এই সংগঠনকে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদন দান করে। এর পর থেকে যাজক সম্প্রদায়টি গোটা ইউরোপের সবচেয়ে জনপ্রিয় দাতব্য প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। এর সদস্য সংখ্যা এবং একই সাথে ক্ষমতা বিপুল হারে বাড়তে থাকে। স্বতন্ত্র ধরণের লাল ক্রস সংবলিত আলখাল্লা পরিধান করার কারণে যে কোন টেম্পলার নাইটকে সহজেই চিহ্নিত করা যায়। তারা ছিল ক্রুসেডের সময়কার সর্বোৎকৃষ্ট অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত, সর্বোচ্চ মানের প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত এবং সর্বোচ্চ শৃঙ্খলাবিশিষ্ট যোদ্ধা দল। এই যাজক সম্প্রদায়ের সদস্যদের মধ্যে যারা যোদ্ধা ছিল না তারা সমগ্র খ্রিস্টান রাজত্ব জুড়ে এক সুবৃহৎ অর্থনৈতিক অবকাঠামো নির্মাণ করেছিল। অর্থ উপার্জনের নব্য নতুন সব উপায় উদ্ভাবনের জন্য তারা বিখ্যাত।
টেম্পোলারদের প্রথম সদর দপ্তর। ফিলিস্তিনির আল আকসা মসজিদ
তাদের এই সব কাজকর্ম ছিল প্রাচীনতম ব্যাংকি ব্যবসার নমুনা। তারা ইউরোপ এবং পবিত্র ভূমি জুড়ে প্রচুর দুর্গ তৈরি করেছিল।
টেম্পলারদের সাফল্য ক্রুসেডের সময় অনেকাংশেই সাধারণ ক্রুসেডারদের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল। খ্রিস্টানরা যখন পবিত্র ভূমির কর্তৃত্ব হারায় এবং ক্রুসেডাররা নির্মমভাবে পরাজিত হয় তখনই এই যোদ্ধা যাজক সম্প্রদায়ের প্রতি সমর্থন অনেকাংশে কমে আসে। টেম্পলারদের গোপন সূচনা অনুষ্ঠান অনেকের মনে সন্দেহের উদ্রেক করে যাদের মধ্যে ফ্রান্সের রাজা ফিলিপ ৪-ও ছিলেন। ফিলিপ ৪ তদানীন্তন পোপ ক্লিমেন্ট ৫-কে টেম্পলারদের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন। ১৩০৭ খ্রিস্টাব্দের ১৩ অক্টোবর রাজা ফিলিপ ৪ ফ্রান্সের বিপুল সংখ্যক টেম্পলারদের আটক করে তাদের উপর নির্যাতন চালান। অনেককে পুড়িয়ে মারা হয়। ১৩১২ খ্রিস্টাব্দে পোপ ক্লিমেন্ট রাজা ফিলিপের অব্যাহত চাপে পড়ে অবশেষে নাইট টেম্পলার সংগঠনটিকে চিরতরে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। এর অব্যবহিত পরেই ইউরোপের বিপুল সংখ্যক অবকাঠামো নিরুদ্দেশ হয়ে যায় যা অনেক কিংবদন্তী এবং গল্পের জন্ম দেয়। এ কারণে আধুনিক কল্পকাহিনীতেও টেম্পলারদের সরব উপস্থিতি লক্ষ করা যায়।
ইতিহাস
উত্থান
নাইট টেম্পলারদের প্রথম সদর দফতর, জেরুজালেমের আল আকসা মসজিদ-এর টেম্প্ল মাউন্ট। ক্রুসেডাররা এই মন্দিরকে সোলমনের মন্দির বলত কারণ প্রাচীন সেই মন্দিরের উপরই এটি নির্মিত হয়েছিল। এই টেম্প্ল শব্দ থেকেই তারা তাদের নামের টেম্পলার অংশটি নিয়েছিল।
প্রথম ক্রুসেডের শেষে ১০৯৯ খ্রিস্টাব্দে জেরুজালেম ক্রিস্টানদের অধিকারে আসে। এরপর প্রচুর ইউরোপীয় তীর্থযাত্রী নিয়মিত এই পবিত্র ভূমিতে গিয়ে উপাসনা করত। শহরটিতে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকলেও অবশিষ্ট বহিঃস্থ অংশে তা ছিল না। উপকূল রেখা থেকে পবিত্র ভূমির উদ্দেশ্যে জাফা যাবার পথে প্রচুর তীর্থযাত্রী ডাকাত দলের আক্রমণের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করত। মাঝে মাঝে এই সংখ্যা একবারে একশ ছাড়িয়ে যেত।
১১১৯ খ্রিস্টাব্দের দিকে দুজন যুদ্ধপ্রবীণ, ফ্রান্সের রাজা নাইট Hugues de Payens এবং তার আত্মীয় Godfrey de Saint-Omer, এই তীর্থযাত্রীদের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য একটি যোদ্ধা যাজকসম্প্রদায় গড়ে তোলার প্রস্তাব পেশ করে। জেরুজালেমের তৎকালীন রাজা বাল্ডউইন ২ তাদের এই প্রস্তাব অনুমোদন করে এবং জেরুজালেমের ক্রিস্টানের অধিকৃত আল আকসা মসজিদের অভ্যন্তরে অবস্থিত টেম্পল মাউন্টে তাদের জন্য একটি সদর দফতরের ব্যবস্থা করে দেয়। টেম্পল মাউন্ট তথা মন্দির পর্বতটির এক অতীন্দ্রিয় বিশেষত্ব ছিল, কারণ বিশ্বাসমতে এটি সোলমনের মন্দিরের ধ্বংসস্তূপের উপর অবস্থিত ছিল। ক্রুসেডাররা তাই আল আকসা মসজিদকে সোলমনের মন্দির বলে ডাকতো এবং এই স্থানের নাম হতেই নাইট টেম্পলাররা তাদের নামের সোলমনের মন্দির এবং খ্রিস্টের দরিদ্র সহযোগী-সৈনিকবৃন্দ (টেম্পলার নাইট) অংশটি নিয়েছিল। মাত্র নয়জন নাইটের মাধ্যমে গঠিত এই যাজকসম্প্রদায়কে প্রথমত শুধুমাত্র দানের অর্থের উপর নির্ভর করতে হত। তাদের আর্থিক অবস্থা ছিল খুব খারাপ। তাদের প্রতীকে একই ঘোড়ার উপর দুজন নাইটকে বসে থাকতে দেখা যায় যা তাদের এই দারিদ্র্যের পরিচয় বহন করে।
খুব বেশিদিন নাইট টেম্পলারদেরকে এই হতদরিদ্র অবস্থায় থাকতে হয়নি। অচিরেই তারা একজন প্রভাবশালী ধনী পৃষ্ঠপোষক লাভ করে। তিনি হলেন ক্লেইভক্সের বার্নার্ড যিনি চার্চ গোষ্ঠীতে বিশেষ প্রভাবের অধিকারী ছিলেন এবং নাইট টেম্পলারের প্রতিষ্ঠাতা একজন নাইটের ভাতিজা ছিলেন। তিনি নাইট টেম্পলারদের পক্ষে শক্তিশালী লেখা লিখতে থাকেন এবং বিভিন্ন মহলে তাদের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বক্তৃতা করতে থাকেন। তার এসব কার্যক্রমের ফলশ্রুতিতেই ১১২৯ সালে কাউন্সিল অফ ট্রয়েসে খ্রিস্টান চার্চ নাইট টেম্পলারদেরকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি প্রদান করে। চার্চের এই স্বীকৃতি লাভের কারণে টেম্পলাররা সমগ্র ইউরোপ জুড়ে খ্রিস্টান দাতব্য কার্যক্রমের প্রধান লক্ষ্যে পরিণত হয়। যেসব ব্যক্তি ও ধনী পরিবার পবিত্র ভূমি রক্ষার যুদ্ধে শরীক হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করত তারা অর্থ, জমি, ব্যবসা এবং মহান রক্ত বহনকারী ছেলেদের সরবরাহ করার মাধ্যমে এই যুদ্ধে অংশ নেয়। টেম্পলারদের পক্ষে আরেকটি প্রধান আনুক্যে প্রদর্শিত হয় ১১৩৯ খ্রিস্টাব্দে। এই বছর পোপ ইনোসেন্ট ২ Omne Datum Optimum নামক আজ্ঞাপত্রের মাধ্যমে এই যাজকসম্প্রদায়কে স্থানীয় আইন ও নিয়মনীতি থেকে অব্যাহতি দেয়। এর অর্থ ছিল, নাইট টেম্পলাররা সীমানা নির্বিশেষে যেকোন স্থানে বা দেশে ভ্রমণ করতে পারবে, তাদের কোন কর প্রদান করতে হবেনা এবং একমাত্র পোপের আইন ব্যাতীত অন্য কারো আইন বা শাসনের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করতে তারা বাধ্য থাকবে না।
টেম্পোলারদের পতাকা
“একজন টেম্পলার নাইট সত্যিকার অর্ধেই ভয়হীন, এবং সকল দিকই নিরাপদ, কারণ তার আত্মা বিশ্বাসের ঢালের মাধ্যমে রক্ষিত, ঠিক যেমন তার দেহ রক্ষিত ইস্পাতের ঢালের মাধ্যমে। এভাবে সে দুই ঢালের মাধ্যমে রক্ষিত হয়, এবং এ কারণে মানুষ বা শয়তান কাওকে ভয় করার কারণ আর অবশিষ্ট থাকেনা।”
বার্নার্ড দ্য ক্লেইভক্স, ১১৩৫ খ্রিস্টাব্দ, De Laude Novae Militae – নতুন নাইটহুডের প্রশংসায়।
পরিষ্কার অভিযান এবং বিপুল পরিমাণ ধন-সম্পত্তি কারণে এই যাজকসম্প্রদায় খুব দ্রুত বিকশিত হয়। ক্রুসেডের অধিকাংশ যুদ্ধেই তখন টেম্পলার নাইটদেরকে অগ্রসর বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করা শুরু হয়। কারণ যুদ্ধবাজ উঁচুমানের ঘোড়ায় চড়ে তারা সহজেই প্রতিপক্ষ শক্তির সামনের সারির ব্যুহ ভেদ করতে পারতো এবং প্রথম সারির পতন ঘটাতে তারা ছিল পটু। তাদের অন্যতম প্রধান বিজয় ছিল ১১৭৭ খ্রিস্টাব্দের মন্টগিসার্ডের যুদ্ধে। এই যুদ্ধে মাত্র ৫০০ জন টেম্পলার নাইটের সহযোগিতায় খ্রিস্টান বাহিনী মুসলিম সেনানায়ক সালাদিনের ২৬,০০০ সৈন্যের বাহিনীকে পরাস্ত করতে সক্ষম হয়েছিল।
এই যাজকসম্প্রদায়ের মূল উদ্দেশ্যে সামরিক হলেও খুব কম সংখ্যক নাইটই সামনের কাতারে থেকে যুদ্ধে অংশ নিতো। অবশিষ্ট নাইটরা সমর্থক এবং সহযোগী শক্তি হিসেবে কাজ করত। তাদের কাজ ছিল যোদ্ধা টেম্পলারদেরকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে সহায়তা করা এবং আর্থিক অবকাঠামো নির্মাণ করে বাহিনীকে সচল রাখা। ব্যক্তিগতভাবে সব নাইট দরিদ্র হলেও দানের বাইরে তাদেরকে প্রভূত অর্থ-সম্পদের নিয়ন্ত্রণের অধিকার দেয়া হয়েছিল। যেকোন মহৎ ব্যক্তি, যে ক্রুসেডে অংশ নিতে ইচ্ছুক ছিল কিন্তু কোন কারণে সরাসরি যুদ্ধে পারঙ্গম ছিলনা, সে তার সকল সম্পত্তি টেম্পলারদের হাতে তুলে দিয়ে এই যাজকসম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হতে পারতো। ইউরোপ এবং আশেপাশের এলাকা জুড়ে এভাবে বিপুল সম্পত্তি জড়ো করার পর টেম্পলাররা পবিত্র ভূমির তীর্থযাত্রীদেরকে ঋণপত্র প্রদান শুরু করে। তীর্থযাত্রীরা পবিত্র ভূমির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করার আগে তাদের যাবতীয় অর্থ-সম্পদ স্থানীয় টেম্পলারদের কাছে জমা করতো। স্থানীয় টেম্পলাররা তাকে গুপ্তভাবে সংকেতায়িত একটি দলিল হস্তান্তর করতো যাতে তার জমা করা সম্পদের পরিমাণ লেখা আছে। পবিত্র ভূমিতে পৌঁছে এই দলিল দেখালেই সেখানকার টেম্পলারদের কাছ থেকে সে তার অর্থ ফেরত পেয়ে যেতো। এই নতুন উদ্ভাবনটিই প্রথম চেক তথা হুণ্ডির ব্যবহার হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। এই পদ্ধতি তীর্থযাত্রীদেরকে অনেক স্বচ্ছন্দ এবং নিরাপদ করেছিল। কারণ ডাকাতদের হাতে কাগজটি পড়লেও তারা তার মর্ম উদ্ধার করতে না পারায় কোন সম্পত্তি হস্তগত করতে পারতো না। এছাড়া এই কাজ করে টেম্পলারদের আর্থিক অবস্থাও বিশেষ উন্নত হয়েছিল।
এরকম মিশ্র দান এবং ব্যবসায়িক চুক্তির মাধ্যমে টেম্পলাররা সমগ্র খ্রিস্টান রাজত্বে একটি দৃঢ় আর্থিক নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা করেছিল। ইউরোপ এবং মধ্য প্রাচ্যে তারা প্রচুর অর্থ ও জমি লাভ করেছিল। এছাড়া তারা খামার ও আঙুরের ক্ষেত ক্রয় ও চাষাবাদ, চার্চ এবং দুর্গ নির্মাণ, বাণিজ্যিক পণ্য উৎপাদন, আমদানি ও রপ্তানী ইত্যাদি নানা ধরণের কাজ করত। তাদের নিজস্ব নৌ বাহিনী ছিল। এমনকি একসময় তারা সমগ্র সাইপ্রাস দ্বীপের মালিকানা অর্জন করেছিল। বিতর্ক থাকা সত্ত্বেও টেম্পলারদেরকেই পৃথিবীর প্রথম বহুজাতিক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়।