দেড় বছর পর দুই মায়ের কোলে প্রকৃত সন্তানঃ ঘটনাস্থল দোহার জেনারেল হাসপাতাল

534

নিউজ৩৯♦ দেড় বছর পর সুমি জামান ও রিনি আক্তারের কোলে ফিরে এসেছে তাদের প্রকৃত সন্তান। ঢাকার দোহার জেনারেল হাসপাতালে একই দিনে প্রায় একই সময়ে একটি করে কন্যাসন্তান প্রসব করেন এ দুই নারী। কিন্তু হাসপাতালসংশ্লিষ্টদের ভুলে অপারেশন থিয়েটারেই অদল-বদল হয়ে যায় তাদের সন্তান। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় দুই পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয় নবজাতকদের। তবে ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগে আলট্রাসনোগ্রাম রিপোর্ট অনুযায়ী শিশুর ওজনে গরমিল হওয়ায় সন্দেহ জাগে সুমি জামানের মনে। এ নিয়ে দুই পরিবারের মধ্যে ব্যাপক আলাপ-আলোচনা হলেও উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে সুরাহা হয়নি। কিন্তু হাল ছাড়েননি সুমি। প্রকৃত সন্তানকে ফিরে পেতে শরণাপন্ন হন তিনি আদালতের। অবশেষে দীর্ঘ দেড় বছর আইনি লড়াইয়ে শিশুরা ফিরে যায় তাদের আসল মায়ের কোলে। ঢাকা জেলার দোহার থানার সুতারপাড়া এলাকার গৃহবধূ সুমি জামান। ২০১৩ সালের ১ নভেম্বর প্রসব বেদনা নিয়ে সন্তান প্রসবের জন্য ঢাকা জেলার জয়পাড়ায় অবস্থিত দোহার জেনারেল হাসপাতাল প্রাইভেট লিমিটেডে ভর্তি হন। একই দিনে একই এলাকার গৃহবধূ রিনি আক্তারও ওই হাসপাতালে ভর্তি হন।

সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, হাসপাতালে ভর্তির দিন সুমি জামান ও রিনি আক্তার উভয়কে একত্রে সিজারিয়ান অপারেশনের জন্য হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটার কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। অপারেশন পরিচালনা করেন ডা. দীপি বড়ুয়া। তাকে সহযোগিতা করেন ডা. জহির। ওই সময় নার্স মোফসানা ও আঁখি এবং ওটি বয় মোরাদ ছিলেন। অপারেশন সফলভাবে সম্পন্ন হওয়ার পর সুমি জামান এবং রিনি আক্তার উভয়েরই একটি করে দুটি কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণ করে।

সিআইডির ফরেনসিক বিভাগ সূত্র জানায়, পরে যখন সন্তান দুটিকে দুই পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়, তখনই সুমি জামানের মনে সন্দেহের সৃষ্টি হয় যে, এটি তার সন্তান নয়। সন্দেহের কারণ ছিল তার শিশুটির ওজন নিয়ে। কারণ, আলট্রাসনোগ্রাম রিপোর্ট অনুযায়ী সুমি জামানের গর্ভস্থ সন্তানের ওজন ছিল ২ কেজি ৭০০ গ্রাম। কিন্তু যে শিশুটিকে তাদের কাছে হস্তান্তর করা হয় তার ওজন প্রকৃতপক্ষে ৩ কেজি ৪০০ গ্রাম। কোনো উপায় না থাকায় দুই পরিবার হাসপাতাল হতে হস্তান্তর করা দুই সন্তানকে লালন-পালন করতে থাকে। সুমি জামান তার কাছে থাকা কন্যাটির নাম রাখেন রাবেয়া। অপরদিকে, রিনি আক্তার তার কাছে থাকা শিশুটির নাম দেন রুবায়দা। আলট্রাসনোগ্রামের রিপোর্ট দেখে ধীরে ধীরে সন্দেহ জন্ম নিতে থাকে রিনির মনেও। তবে এ নিয়ে তিনি কোনো ঝক্কি-ঝামেলায় যেতে চাননি।

অন্য খবর  আওয়ামীলীগের তথ্য উপ-কমিটির সদস্য নির্বাচিত হলেন জয়নাল আবেদীন 

সুমি জানান, প্রকৃত সন্তানকে না পেয়ে তার কান্না থামছিল না। তার কোলে যে সন্তান আছে তাকে কোলে নিয়ে তিনি রিনির বাসায় যান। সেখানেও কান্নায় ভেঙে পড়েন। রিনির কোলে যে সন্তান ছিল সেটিই তার সন্তান বলে দাবি করেন সুমি। কিন্তু রিনি জানান সে তো এই সন্তানই পেয়েছেন। আর তার সন্তানের ওজনের বিষয়ে আগে কোনো মেডিকেল রিপোর্ট তিনি করেনি। রিনি আক্তার বলেন, সুমি জামানের সন্দেহের পর আমারও প্রবল কষ্ট হতে থাকে। আমি যে সন্তান কোলে নিয়ে আছি সেটা আমার নয়। তবুও মাতৃস্নেহে শিশুটির বেড়ে ওঠা নিশ্চিত করি।

সিআইডির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, একপর্যায়ে সুমির দাবির পরিপ্রেক্ষিতে রিনিও কিছুটা সদয় হন। এই অবস্থায় দুই পরিবারই ডিএনএ পরীক্ষার কথাটি বিবেচনায় নিয়ে আসেন। কারণ, একমাত্র ডিএনএ পরীক্ষাই বলে দিতে পারে কোন শিশুটি কার গর্ভজাত সন্তান। তখন সুমি বিভিন্ন হাসপাতালে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য আবেদন জানালে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আদালতের আদেশের কথা জানান। এভাবে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে, সবার সঙ্গে পরামর্শ করে অবশেষে তারা ২০১৪ সালের ১০ ডিসেম্বর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আমলী আদালত নং-৪, ঢাকা আদালতে একটি মামলা করেন। মামলাটি ৩৮০/৪০৬/৪১৭/৩৪ দণ্ডবিধি মোতাবেক সিআর মামলা নং- ২০৯/২০১৪ রুজু হয়।

মামলার পরিপ্রেক্ষিতে তদন্তকারী কর্মকর্তা মো. আবু বক্কর সিদ্দিক আদালতে ডিএনএ পরীক্ষার করার আবেদন জানান। সুমি জামান, রিনি আক্তার ও দুই নবজাতকের ডিএনএ পরীক্ষার নির্দেশ দেন আদালত। ১০ মার্চ দোহার থানা পুলিশ এই চারজনের ফরেনসিক ডিএনএ নিয়ে ল্যাবরেটরি অব বাংলাদেশ পুলিশ, সিআইডিতে উপস্থিত হন। ল্যাবরেটরিতে দুজন সাক্ষীর উপস্থিতিতে এবং তাদের লিখিত সম্মতির ভিত্তিতে উপরোক্ত চারজনের রক্তের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। সুমি জামান ও কন্যাসন্তান রাবেয়া, রিনি আক্তার ও কন্যাসন্তান রুবাইদার প্রত্যেকের ডিএনএ প্রোফাইল তৈরি করা হয়।

অন্য খবর  দোহারে নারীর মরদেহ উদ্ধার

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) বিশেষ পুলিশ সুপার (ফরেনসিক অ্যান্ড ল্যাব) শেখ মোহাম্মদ রেজাউল হায়দার যুগান্তরকে বলেন, প্রথমে রাবেয়ার ডিএনএ প্রোফাইলের সঙ্গে সুমি জামানের ডিএনএ প্রোফাইল বিশ্লেষণ করা হয়। এ থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, রাবেয়া, সুমি জামানের সন্তান নয়। একইভাবে রিনি আক্তার এবং রুবায়দার ডিএনএ প্রোফাইল বিশ্লেষণ করে প্রমাণিত হয় যে, রুবায়দাও রিনি আক্তারের সন্তান নয়।

সিআইডির ল্যাবের উচ্চপ্রযুক্তি ও ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ রেজাউল হায়দার বলেন, আমরা সুমি জামানের ডিএনএ প্রোফাইলের সঙ্গে রুবায়দার ডিএনএ প্রোফাইল বিশ্লেষণ করি। এই বিশ্লেষণের ফলাফলে দেখা যায় যে, প্রকৃতপক্ষে সুমি জামানই রুবায়দার মা। তারপর রিনি আক্তার এবং রাবেয়ার ডিএনএ প্রোফাইল তুলনা করে প্রমাণ হয় যে, রিনি আক্তারই রাবেয়ার প্রকৃত মা। এভাবে ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমেই সুমি জামানের সন্দেহ সত্য বলে প্রমাণিত হয়। ডিএনএ পরীক্ষার ফলেই সুমি জামান এবং রিনি আক্তার তাদের প্রকৃত সন্তানকে ফেরত পান।

সিআইডির ল্যাব সূত্র জানায়, ডিঅক্সিরাইবো নিউক্লিক এসিড (ডিএনএ) প্রোফাইলিংয়ের মাধ্যমে হাসপাতালে বদলে যাওয়া শিশুদের মাতৃত্ব নির্ণয় করা হয়। এরপর সিআইডির কর্মকর্তারা সম্প্রতি আদালতের আদেশে সুমি ও রিনির কাছে প্রকৃত সন্তানদের ফেরত দেয়া হয়।

সিআইডির কর্মকর্তাদের সামনে সুমি জামান জানান, আমি শুরু থেকেই সন্দেহ করছিলাম, আমাকে যে সন্তান দেয়া হয়েছে তা আমার নয়। কারণ, আলট্রাসনোগ্রাম প্রতিবেদনে আমার সন্তানের ওজন ছিল ২ কেজি ৭০০ গ্রাম। আর হাসপাতাল থেকে যে সন্তান আমাকে দেয়া হয়েছিল তার ওজন ছিল ৩ কেজি ৪০০ গ্রাম। সুমির দাবির পরিপ্রেক্ষিতে রিনিও ডিএনএ পরীক্ষায় রাজি হন। তিনি বলেন, আমিও চেয়েছি প্রকৃত সন্তানের মাঝে সুখ খুঁজে পেতে। সুমি জামান ও রিনি আক্তার উভয়ই জানান, সফল এ ডিএনএ পরীক্ষার পর তারা দুজন এখন ভালো বন্ধুও।

আপনার মতামত দিন