দোহার-নবাবগঞ্জ থেকে ক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে গোলা

383

গ্রামাঞ্চলে ডোল বা গোলা খুব পরিচিত একটি জিনিস। বাশ দিয়ে তৈরি এই ধান সংরক্ষণের বিশাল পাত্রটি চেনে না এমন মানুষ গ্রামে খুঁজে পাওয়া যাবে না।

সারা বছরের ধান সংরক্ষণ করতে এ পাত্র যুগ যুগ ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ধানের মৌসুমে ধান কেটে শুকিয়ে গোলাজাত করা হয়। প্রয়োজনের সময় গোলা থেকে ধান নিয়ে আবার রোদে শুকিয়ে ধান চুরানো (মিলিং) করা হয়।

দেশের মানুষের প্রধান খাদ্য ভাত। ধান মিলিং করে ঘরের গোলা থেকে অপেক্ষাকৃত ছোট পাত্রে চাউল রাখা হয়। সেই পাত্র থেকে চাউল নিয়ে প্রতি বেলায় ভাত রান্না করা হয়। গোলা ভর্তি ধান না থাকলে এক সময় গ্রামের গৃহস্থরা সেই বাড়ীতে ছেলেমেয়েদের বিয়ে পর্যন্ত দিত না। এই কথা এখনো মানুষের মুখে মুখে।

গোলা ভর্তি করে ধান রেখে সেই গোলার মুখ বন্ধ করে রাখা হয়, যাতে ধান নষ্ট না হয়। এক সময় বর্তমানের মত সমাজ ব্যবস্থা উন্নত ছিল না। তখন চোর ডাকাতের ভয়ে গোলার ধানের মধ্যে স্বর্ন ও টাকা পয়সা গোলার ভেতর সংরক্ষণ করে রাখত। মানুষ প্রয়োজনের সময় গোলা বা ডোল থেকে ধান নিয়ে মিলিং করে পরিবারের ভাত রান্নার জন্য জমা করে রাখত। আবার টাকার প্রয়োজন হলে গোলা থেকে ধান নিয়ে বিক্রি করত।

গোলা বা ডোল ঠিক একই জিনিস নয়। গোলা অপেক্ষাকৃত মজবুত, দীর্ঘদিন ব্যবহার করা যায়। বাঁশের নিল দিয়ে গোলা তৈরী করা হয়। এই গোলাকে স্থান ভেদে কাইজ্জ্যাও বলা হয়। আর ডোল তৈরী করা হয় বাঁশের বুকের বা ভেতরের অংশ দিয়ে। বাশের ভেতরের দিকটা নরম হওয়ায় অপেক্ষাকৃত কম মজবুত। ডোলের স্থায়িত্বও কম। কিন্তু ডোল সহজে বহনযোগ্য।

অন্য খবর  দোহারে ভুমি অফিসসহ তিন সরকারী অফিসে চুরি

 গোলা যেহেতু অপেক্ষাকৃত মজবুত সেহেতু এটা ভারী। বহনও একটু পরিশ্রমের ব্যাপার এবং কষ্টসাধ্য। গোলা বা ডোল বিভিন্ন সাইজের হয়ে থাকে। ২০, ৩০, ৫০, ৬০ এমনকি শত আড়ি ধান সংরক্ষণ করার মত। 

গৃহস্থ পরিবারের প্রয়োজন অনুসারে ডোল/গোলা তৈরী করা হয়। যার যত বড় প্রয়োজন, যেন তার প্রয়োজন মত গোলা বা ডোল কিনতে পারে। তবে গোলা/ডোলে ধান সংরক্ষণ করলে ইঁদুর ধান নষ্ট করে বেশী। গ্রামের প্রত্যেক বাড়ী ঘরে সব সময় ইঁদুরের উৎপাত থাকে। ইঁদুরের অন্যতম প্রধান খাদ্য ধান। তাই গোলায় ধান রাখলে ইঁদুর অধিকাংশ খেয়ে কিংবা নষ্ট করে এই কারণে সম্প্রতি বাঁশের ডোল/গোলার ব্যবহার কমে গেছে।

বাঁশের তৈরী ডোল, গোলা কিংবা কাইজ্জ্যার স্থান দখল করে নিয়েছে স্থায়ী পাকা অথবা টিনের গোলা। এই গোলা ঘরের বাইরে রাখা যায় বলে ঘরের জায়গা নষ্ট হয় কম। বাঁশের তৈরী ডোল/গোলা ঘরের বাইরে রাখা যায় না। ধানের গোলা বাইরে রাখলে চুরি হয়ে যাওয়ার আশংকা থাকে।

টিনের গোলানিরাপদ হওয়ায় টাকা বেশী খরচ হলেও অপেক্ষাকৃত গৃহস্থ কৃষক পরিবার টিনের অথবা পাকা গোলা ঘরের বাইরে স্থাপন করা করে।টিনের গোলার ধান ইঁদুরের নষ্ট করারও আশংকা কম থাকে, তাই নিরাপদ। টিনের গোলায় রাখা ধান চুরানোর সময় তেমন রোদেও শুকাতে হয় না। এসব কারনে বাঁশের তৈরী ডোল/গোলার ব্যবহার ইদানিং কমে যাচ্ছে।

অন্য খবর  জমি সংক্রান্ত বিরোধে দোহারে যুবক খুন

 এছাড়া বাঁশ ক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে। আর পাওয়া গেলেও দাম অতাধিক চড়া। সম্প্রতি বেশীরভাগ বাঁশ কিংবা গ্রামে বিত্তশালীদের পাকা স্থাপনা বহুতল ভবন নির্মানে সহায়ক সামগ্রী হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বিত্তশালীরা চড়া দামে বাঁশ কিনে নিয়ে যাচ্ছে নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে। আর বাঁশের আবাদও কমে যাচ্ছে। উৎপাদন কমে যাওয়ায়,চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় বাঁশের দাম বেড়ে যাচ্ছে। গোলা/ডোল তৈরীর প্রধান উপকরন বাঁশের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। তাই বর্ধিত মূল্যে উৎপাদিত গোলা/ডোল বিক্রি করতে হচ্ছে। তাছাড়া স্থায়িত্ব কম হওয়ায় অনেকে টিনের গোলা তৈরী করার ফলে বাঁশের তৈরী গোলা/ডোলের চাহিদা কমে গেছে। চাহিদা কমে যাওয়ায় গোলা/ডোল তৈরীর কারিগরগনও তাদের বংশীয় পেশা ছেড়ে দিচ্ছেন। পেশার পরিরর্তন করে অন্য পেশায় চলে গেছে। এ পেশার কারিগরও এখন বলতে গেলে নেই। তাছাড়া এ পেশা মৌসুমী হওযায় অনেকের পেশার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। নতুন প্রজম্ম এ পেশায় আসতে তেমন আগ্রহীও নয়। তাছাড়া অনেকে পরিশ্রমের ভয়েও গোলা/ডোল কিংকা কাইজ্জ্যা তৈরীর পেশায় আসতে চাচ্ছে না।

 সর্বপরি গোলা/ডোলের ব্যবহার এখন বলতে গেলে নেই। নতুন প্রজম্ম হয়তো এই গোলা ও ডোল চিনবে না। আর কোন স্থানে তৈরী এসব জিনিস দেখলে হয়তো নতুন প্রজম্ম কৗতুহলের সাথে জিজ্ঞেসা করবে এটা কি কাজে ব্যবহৃত হয়!

আপনার মতামত দিন