তাঁদের ধর্ম ভিন্ন, পেশাও। সমবয়সী নন। জাতি-গোত্র আলাদা। কিন্তু আছে মনের মিল। তাই বন্ধুর মতো একসঙ্গে আড্ডা দেন। হইহল্লা করেন। বিশেষ করে ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোতে একে অন্যের বাড়িতে আমন্ত্রিত হন। খুব মজা করেন। সামাজিক-ধর্মীয় সম্প্রীতির এই চিত্র ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলার বান্দুরা ও আশপাশের গ্রামে দেখা গেছে।
১৬ ডিসেম্বরের ঘটনা। তখন সকাল ১০টা বাজে। বান্দুরা বাসস্ট্যান্ডের কাছে বান্দুরা ডেকোরেটরের সামনে কয়েকজন দাঁড়িয়ে খোশগল্প করছিলেন। এর মধ্যে পুরোনো বান্দুরা গ্রামের আবুল খায়ের খোকা একটি বরফকলের মালিক। কিছুটা চুপচাপ ধরনের। আড্ডার মধ্যমণি দিলীপ গমেজ। হাস্যরস ছড়াচ্ছিলেন। তিনি বান্দুরা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য। বাড়ি আড্ডাস্থল থেকে মাত্র কয়েক শ গজ দূরে। মোলাসিকান্দা গ্রামে। দুর্গাচরণ হালদার ফ্লাস্ক থেকে কাপে রং-চা ঢেলে একে একে সবার হাতে তুলে দেন। তিনি এই ডেকোরেটরের কর্ণধার। বাড়ি নতুন বান্দুরা গ্রামে। দীর্ঘদেহী হাসনাবাদ গ্রামের পিটার বিকাশ গমেজ নামকরা বাবুর্চি। দীর্ঘদিন সৌদি আরব ও কুয়েতে ছিলেন।
এক প্রশ্নের জবাবে আবুল খায়ের খোকা বলেন, ‘আমার জন্ম মুসলিম পরিবারে হলেও বড় হয়েছি খ্রিষ্টান ও হিন্দুদের সঙ্গে মিলেমিশে। আপনি খোঁজ নিলে দেখবেন, বান্দুরা ও এর আশপাশের গ্রামগুলোতে হিন্দু, মুসলিম ও খ্রিষ্টানরা মিলেমিশে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করে। ধর্ম নিয়ে কোনো ধরনের বাড়াবাড়ি করে না। বরং নিজ নিজ ধর্মীয় উৎসব অন্যদের নিয়ে উদ্যাপন করে। বংশপরম্পরায় এমনটিই চলে এসেছে। আমরা শিখেছি আমাদের বড়দের কাছে। আর আমাদের সন্তানেরা শিখছে আমাদের কাছ থেকে।’
খ্রিষ্টান পরিবারে বেড়ে ওঠা দিলীপ গমেজ বলেন, ‘এই এলাকার পোলাপানরা একটাই স্বপ্ন দেখে। বড় হয়ে তারা বিদেশ যাবে। টাকা কামাই করবে। দেখা গেল, আমার এক বন্ধু হিন্দু কিংবা মুসলিম, হে কাজে গেল দুবাই। পরে আমারেও নিয়া গেল গা। এই হলো হিসাব। ধর্মটর্ম নিয়া কেউ এত মাথা ঘামায় না। পড়াশোনাও খুব একটা হয় না। তবে নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা বেশির ভাগ ঢাকায় থাকে। পড়াশোনার দিকে তাদের খুব মনোযোগ। হা হা হা…’
একজন পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু দৃষ্টিতে ধরা পড়েন। আড্ডাস্থল থেকে আঙুলের ইশারা করেন। আর হাসিতে ফেটে পড়েন। কারণটা বোঝা যায় একটু পরে। আগন্তুক সিগারেট নিয়ে এসেছেন। কে কোন ব্র্যান্ডের সিগারেট ফোঁকেন, তা তাঁর মুখস্থ। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা।
মাথা চুলকাতে চুলকাতে আসা লোকটির দিকে তাকিয়ে কিছুটা রাশভারী দুর্গাচরণ হালদারও হাসি আটকে রাখতে ব্যর্থ হন। রহস্য করে তিনি বলেন, ‘তুমি চোখের সামনে দিয়া যাও ক্যান। চুপ করে পেছনের দিকে আইস্যা খারাইতা। তাইলে কারও নজরে পড়তা না। সিগারেটও আনতে হতো না।’ তিনি বলেন দেখেন, ব্যবসাপাতি ভালো না। তারপরও এখানে প্রায় প্রতিদিনই এমন আড্ডা হয়। চা-সিগারেট চলে। এরপর যে যাঁর কাজে যান।
এরপর আবুল খায়ের খোকা হাসনাবাদ গ্রামের জপমালা রানীর গির্জা ঘুরিয়ে দেখান। মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও ১৭৭৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এই গির্জায় ঢুকতে কোনো বেগ পেতে হয়নি। বড়দিনের উৎসব সামনে রেখে গির্জার হলরুম সাজাচ্ছিলেন কয়েকজন তরুণ। গির্জার সামনে মাঠের এক কোণে একটি খড়ের ঘর। তাতে মাতা মেরি ও শিশু যিশুর মূর্তিরয়েছে। আশপাশের বাড়িগুলোর সামনে ক্রিসমাস ট্রি সাজানো হয়েছে।
বান্দুরা বাজার থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে বড় গোল্লা গ্রাম। প্রতিটি বাড়ি বড় বড় গাছপালায় ঘেরা। আধুনিক দোতলা-তিনতলা ভবন কিন্তু জনমানুষের খুব একটা দেখা মেলে না। এই গ্রামের বাসিন্দা মাইকেল গমেজ। নদীর তীরে চায়ের দোকান চালান। তিনি বলেন, এখানে খ্রিষ্টান ছাড়া অন্য কোনো সম্প্রদায়ের মানুষের ঘরবাড়ি নেই। আশপাশের হিন্দু ও মুসলিম-অধ্যুষিত গ্রাম আছে। তাঁরা শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করেন। তাঁদের গ্রামের প্রায় বাড়ির কোনো না কোনো সদস্য বিদেশে, নিদেনপক্ষে ঢাকায় থাকেন। বেশির ভাগই বাবুর্চি। তবে বড়দিন উপলক্ষে অনেকেই নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে আসেন। তখন গ্রাম বেশ জমজমাট হয়ে ওঠে। এই গ্রামে রয়েছে সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার গির্জা। গির্জাটির কিছু দূরেই দেউতলা গ্রামের একটি মসজিদ। সেখান থেকে মাইকে ভেসে আসে মাগরিবের আজান। আর দূরে কোথাও হিন্দু বাড়িগুলো থেকে ভেসে আসে উলুধ্বনি। সন্ধ্যার বাতাসে মিলেমিশে যায়।