এমন সংকট কখনও দেখে নি তাঁত শিল্প

220

দোহার নবাবগঞ্জে তাঁত শিল্প তথা লুঙ্গি শিল্পের সংকট প্রায় তিন দশক ধরে। গত শতকের নব্বইর দশকে দেশে পাওয়ারলুমের উত্থানে হস্তচালিত তাঁত প্রথম হুমকি পায়। ২০০০ সালের পর গণহারে দোহার-নবাবগঞ্জে তাঁত বন্ধ হতে থাকে। তাঁতীরা ভিন্ন ভিন্ন পেশা নিতে থাকে। তারপরও টিকে ছিল ধুকে ধুকে হলেও। কিন্তু এখনকার মত অস্তিত্ব সংকট দেখেনি আগে। করোনার আগেও মনে হচ্ছিল এই শিল্প আরও অন্তত বারো-পনের বছর টিকে থাকবে। কিন্তু বর্তমান সুতোর মূল্যের উর্দ্ধগতি ও মন্দা বাজারের কারণে দোহার-নবাবগঞ্জের তাঁতীরা  শিল্পের শেষ দেখে ফেলেছেন কিনা সেটিই ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

চলতি সংকটের শুরু করোনার প্রথম ঢেউয়ের পর ২০২১ সালের শুরু থেকে। করোনায় তুলার আমদানী বন্ধ থাকায় সুতোর দাম বাড়তে থাকে। তখন ব্যাপারটি গ্রহণযোগ্য ছিল। কিন্তু তারপর যখন আমদানী-রপ্তানী স্বাভাবিক হয়ে আসে তারপরও আর কখনওই সুতোর দাম কমে নি, বরং লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। শুধু ২০২২ সালের রমাজনের আগে থেকে দুই মাসের মধ্যে একেক পিস কাপড়ে সুতোর খরচ বেড়েছে ১০০ টাকার মত।

সংকট শুধু হস্তচালিত তাঁত শিল্প দেখছে না, দেশের বৃহৎ পাওয়ারলুম তথা গার্মেন্টস শিল্পও সংকটে। এই সময় বেড়েছে সুতির সকল ধরণের কাপড়ের দাম। একারণে টেক্সটাইল শিল্প আর গার্মেন্টস শিল্প মুখোমুখি অবস্থানে দাড়িয়েছে, যদিও একই মালিকের অধীনে দুই ধরণের শিল্পই দেখা যায়। পোশাক শিল্প মালিকদের অভিযোগ, চাহিদা বাড়ায় ইচ্ছে করে সুতার দাম বাড়িয়ে দিয়েছে বস্ত্রকল মালিকরা। আর বস্ত্রকল মালিকেরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ায় তারাও বাড়িয়েছেন। 

২০২০ সালের নভেম্বরে ৩০ কাউন্টের সুতোর দাম ছিল প্রতি কেজি ২ ডলার ৮০ সেন্ট। তিন মাস পর ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সেটি হয় ৩ ডলার ৭০ সেন্ট। দোহার-নবাবগঞ্জে ৩০ কাউন্টের সুতোর কাজ হয় না, বর্তমানে শুধু ৮৪ কাউন্টের সুতো ব্যবহার করা হয় হস্তচালিত তাঁতে, পাওয়ালুমে ৬০, ৭০ কাউন্টের ব্যবহার আছে। কিন্তু মূল্য বৃদ্ধির হার বোঝার জন্য প্রাপ্ত তথ্য দেয়া হল।

২০২১ এর আগস্টেও এক মাসের ব্যবধানে বস্ত্রকল মালিকরা প্রতি কেজি সুতার দাম ৭০ সেন্ট থেকে ১ ডলার পর্যন্ত বাড়িয়েছে। বিটিএমএর নেতারা জানান, ২০২০ এর ডিসেম্বর থেকে ২০২১ এর আগস্ট পর্যন্ত নয় মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে তুলার দাম বেড়েছে ৪৭ শতাংশ। তার বিপরীতে দেশের বাজারে সুতার দাম বেড়েছে ৩৭ শতাংশ।

পোশাক শিল্প মালিকদের দাবি, “চাহিদা বাড়তে থাকায় স্থানীয় স্পিনিং মিল মালিকরা অস্বাভাবিক দর বাড়িয়ে প্রচুর মুনাফা করছেন।” যদিও এমন অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে আসছিলেন টেক্সটাইল খাতের উদ্যোক্তারা। এই চিত্র আমরা দোহার-নবাবগঞ্জেও দেখছি। গতবছর সেপ্টেম্বরে সুতোর দাম কমলেও দোহারে কমতে দেখি নি। সুতোর দাম বাড়লে বেপারী পর্যায়ে বাড়ে, কিন্তু দাম কমলে বেপারীদের কাছে কমে না। জাতীয় পর্যায়ে বড় আকারের পোশাক কারখানার মালিকরা প্রতিবেশী ভারতসহ একাধিক দেশ থেকে সুতো আমদানি শুরু করেছেন। আমাদের গরীব তাঁতীরা তো আর সুতো আমদানী করতে পারেন না।

অন্য খবর  হাতে বোনা তাঁতের লুঙ্গি নিয়ে অনলাইনে নূর-আবেদিন

পোশাক শিল্প মালিক ও টেক্সটাইল মিল মালিকসূত্রে জানা গিয়েছে, দেশে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরের খবর, “গত দুই মাস ধরে পোশাক খাতে বহুল ব্যবহার হওয়া ৩০ কাউন্ট মানের ইয়ার্নের দাম ৪.২০ ডলার থেকে ৪.৩০ ডলার পর্যন্ত উঠে যায়। তবে বর্তমানে তা ৪.১০ থেকে ৪.১৫ ডলারে নেমে এসেছে। পোশাক খাত সংশ্লিষ্টরা এ দর আরো কমবে বলে আশা করছেন।”

কিন্তু আর না কমে অক্টোবরে আবারও বেড়েছে, এক সপ্তাহের ব্যবধানে বাজারে পাউন্ড প্রতি সুতার দাম বেড়েছে প্রায় ১৫ টাকা। একবস্তা সুতা কিনতে ১৪ থেকে ১৫ হাজার টাকা বেশি গুণতে হচ্ছে । এই সময়ে দাম এলাকায় প্রতি সপ্তাহেই বাড়তে থাকে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে দাম বাড়ে পাউন্ড প্রতি ৪ থেকে ১০ টাকা।

দোহার-নবাবগঞ্জের পরিস্থিতি:

করোনার প্রথম ঢেউয়ের পর থেকেই সুতোর মূল্য ক্রমাগত বাড়তে থাকে, বাড়তে থাকে দোহার-নবাবগঞ্জের স্থানীয় বাজারে। এক মুঠো ৮৪ কাউন্টের সাদা সুতোর দাম ছিল ৪০ টাকা, সেটি এখন ৬১ টাকা, রঙ্গিন সুতো যেগুলোর দাম ছিল ৫৮ টাকা সেগুলো এখন ৭৯ থেকে ৮১ টাকা! ২০২০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত প্রতি ভিমে লুঙ্গির পাইকারি মূল্য বেড়েছে সানাভেদে ৪০০ টাকা থেকে ৯০০ টাকা পর্যন্ত!

এমনিতেই তাঁতের লুঙ্গির মূল্যের কারণে পাওয়ারলুমের বানানো লুঙ্গির সাথে টেক্কা দিয়ে টিকে থাকতে পারছে না, তার উপর এই মূল্য বৃদ্ধি তাঁতীদের ভয়াবহ সংকটে ফেলেছে। অনেকেই তাঁত বন্ধ রেখেছেন। যে বাড়ীতে পাঁচটি তাঁত আছে তারা দুটো বা তিনটি বন্ধ রেখেছে, যার বাড়ীতে দুটো আছে সে একটি বন্ধ রেখে অন্যটা চালাচ্ছেন। যার বিকল্প সুযোগ আছে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। এক সময় তাঁতের শব্দে মুখরিত থাকতে যে দোহার-নবাবগঞ্জ সেই তাঁত এখন হারিকেন দিয়ে খুঁজতে হয়। জয়পাড়া-রোহিতপুরি লুঙ্গির খ্যাতির বাইরে  মালিকান্দা স্বতন্ত্র ডিজাইন ও কোয়ালিটি দিয়ে নিজস্ব আলাদা পরিচয় তৈরি করেছিল সেই মালিকান্দায় এখন হাতে গোনা চার-পাঁচ বাড়িতে তাঁত চলছে! 

অন্য খবর  দোহারের জয়পাড়ার লুঙ্গি বিদেশেও এখন রফতানি

সুতো শুকানো হচ্ছে

সুতোর দাম কমলেও স্থানীয় বাজারে কমে না: সুতোর দামের উর্ধগতির মাঝে কখনও কখনও দাম কমেও, এক নাগাড়ে কখনও বাড়ে না, মাঝে মাঝে কমেও। কিন্তু কখনও স্থানীয় বাজারে সুতোর দাম কমতে দেখা যায় নি।

২০২২ সালে মে মাসে এক সপ্তাহের ব্যবধানে সুতার দাম বেড়েছে পাউন্ডে ১০ টাকা। এরপর জুন মাসে এসে ক্রমাগত দাম বাড়তে থাকা সুতোর মূল্য কমার খবর আসে। ৮০ কাউন্টের সুতা বাজারে বেচাকেনা হচ্ছে ৩৪০৩৬০ টাকা দরে। একই কাউন্টের সুতা কয়েক দিন আগেও বাজারে বেচাকেনা হয়েছে ৩৫০৩৭০ টাকা দরে। পাউন্ডপ্রতি দাম কমেছে ১০ টাকা।

এরপর চলতি জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহেই মূল্য আরও কমল, ৮০ কাউন্টের সুতা বেচাকেনা হচ্ছে ৩৩০-৩৫০ টাকা, যা এক মাস আগে বিক্রি হয়েছিল ৩৪০-৩৬০ টাকা দরে। দাম কমেছে পাউন্ডপ্রতি ১০ টাকা। 

সূত্র: দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড

আশার ব্যাপার হল গত এক মাসে দুইবার সুতোর দাম কমেছে, জুনে ও জুলাইর প্রথম সপ্তাহে। তবে স্থানীয় বাজারে সুতোর মূল্য না কমলে এটিকে সুখবর বলা যায় না। কারণ অতীতেও জাতীয় পর্যায়ে দাম কমেছে, স্থানীয় বাজারে বেপারিরা সুতোর দাম কমান নি। আমরা চাই দাম কমার ধারা নিয়মিত হয়ে মূল্য স্বাভাবিক হোক। তাহলে তাঁত শিল্প বাঁচবে, তাতীরা তাঁত চালাতে পারবে, সুতোর ব্যবসাও টিকে থাকবে। নয়তো শুরুতে যে শেষ দেখার আশংকা প্রকাশ করা হয়েছে সেটিই বাস্তব হয়ে দাঁড়াতে পারে।

বি.দ্র: লিংক করা লেখাগুলোতে টাচ/ক্লিক করলে সংবাদ সূত্র দেখা যাবে।

আপনার মতামত দিন