মুক্ত জীবন-রুদ্ধ প্রাণ,ইতিহাসের মুক্তি কোন পথে: মাহফুজ উল্লাহ

1069

ইতিহাসের সংজ্ঞা নিয়ে বিতর্কের পরিধি ব্যাপক। এ বিতর্কের কারণ বিবিধ। এক সময় পরাক্রমশালী ও বিজয়ীরা ইতিহাস লিপিবদ্ধ করতেন বলেই সেখানে নিুবর্গের বা নিচতলার মানুষের কোনো প্রবেশাধিকার ছিল না। কখনও কখনও ব্যতিক্রম ঘটলেও বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত ইতিহাস ছিল বিজয়ীর অহংকারের কাহিনী। ধীরে ধীরে এ প্রবণতায় পরিবর্তন আসতে শুরু করলেও এখনও ইতিহাসের নির্মোহ মুক্তি অনেক দূরে। কেউ কেউ মনে করেন, ইতিহাস হচ্ছে অতীতে যা ঘটেছে, যাকে উদ্ধার করা যাবে না অথবা পুরোপুরি জানা বা বোঝা যাবে না। আবার অনেকে মনে করেন, অতীতকে জানা যায় এবং ইতিহাস হচ্ছে অতীতে ঘটে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলির বিবরণ। আবার কমিউনিস্ট মতাদর্শে বিশ্বাসীরা ইতিহাসকে ব্যাখ্যা করেন শ্রেণী ও শ্রেণীসংগ্রামের আলোকে। সংজ্ঞা নিয়ে বিতর্ক যাই হোক না কেন বর্তমানে ইতিহাস যে ক্রমাগত অনুসন্ধান ও গবেষণার বিষয় সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই এবং সুলিখিত ইতিহাস সুখপাঠ্য, কৌতূহলোদ্দীপক এবং মাথা ঘামানোর বিষয়। প্রত্যেকটি সমাজে ইতিহাস জনপ্রিয় বিষয়। জনগণ বিভিন্নভাবে ইতিহাসের সঙ্গে নিজেকে সম্পর্কিত করেন। অনেকেই জানতে চান, তার পরিবার অথবা পূর্বপুরুষদের এবং যে এলাকায় তিনি বাস করেন সে এলাকার ইতিহাসের কথা। ইতিহাস জানতে মানুষ জাদুঘরে যায়, ঐতিহাসিক স্থাপনা ঘুরে দেখে। জাদুঘরে যাওয়ার বিষয়টি বাংলাদেশে অ-জনপ্রিয় হলেও পৃথিবীর অন্যান্য দেশে প্রতিদিন ব্যাপক মানুষ জাদুঘর ঘুরে দেখে। চীনে স্কুলের বিভিন্ন শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে জাদুঘরে নিয়ে যাওয়া হয় তাদের রাষ্ট্র ও সমাজের অতীতটা জানানোর জন্য। এ জাদুঘর সফরে ছাত্রছাত্রীদের নোটবই সঙ্গে রাখতে হয় জাদুঘরে সংরক্ষিত ইতিহাস টুকে আনার জন্য। কেউ কেউ ইতিহাসের অনুরাগী হয়ে ডাকটিকিট, মুদ্রা অথবা পুরনো হিসেবে পরিচিত এন্টিক সংগ্রহ করেন। উদ্দেশ্য একটাই, ইতিহাসকে জানা। বাংলাদেশে অবশ্য সাম্প্রতিক সময়ে এন্টিকস সংগ্রহের প্রবণতা বেড়েছে। অনেক উৎসাহী মানুষ ইতিহাস জানার জন্য বিভিন্ন ইতিহাস সমিতিতে যোগ দেন অথবা অতীতের নিদর্শন সংরক্ষণে আত্মনিয়োগ করেন। সাম্প্রতিক সময়ে বই, ওয়েবসাইট, চলচ্চিত্র এবং প্রামাণ্য ছবি ইতিহাস সম্পর্কে মানুষের উৎসাহেরই বহিঃপ্রকাশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বা ভিয়েতনাম যুদ্ধ সম্পর্কে বিভিন্ন প্রামাণ্য ছবি এখনও সমান জনপ্রিয়। আরব বিশ্বের নিহত নেতা সাদ্দাম হোসেন, গাদ্দাফি অথবা মিসরের পরলোকগত নেতা নাসেরের জীবন সম্পর্কে প্রামাণ্য চিত্র প্রচণ্ড উৎসাহের বিষয়। এসব ক্ষেত্রে নতুন নতুন তথ্য সংযোজিত হলে উৎসাহের পরিমাণ আরও বেড়ে যায়। গত শতাব্দীতে যখন ক্রীতদাসদের বিদ্রোহ নিয়ে ছবি ‘স্পার্টাকাস’ মুক্তি পেয়েছিল তখন এটা সারা পৃথিবীজুড়ে আলোড়ন তৈরি করেছিল। আবার যুক্তরাষ্ট্রে কালো দাসদের জীবন ও বেড়ে ওঠা সম্পর্কে অ্যালেক্স হ্যালির বই ‘রুটস’ যখন প্রকাশিত হয় তখন সেটাও ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। আর এ বইয়ের ভিত্তিতে যে টেলিফিল্ম তৈরি হয়েছিল তার জনপ্রিয়তা ছিল ঈর্ষণীয়। প্রাচীন গ্রিকরা মনে করতেন, ইতিহাস হচ্ছে ঘটনাবলির গুদাম- যেসব উদাহরণ আমাদের ভবিষ্যৎ কর্মকাণ্ডকে নিয়ন্ত্রণ করবে। ইতিহাস গুরুত্বপূর্ণ কারণ অতীতের ভালো, মন্দ, খারাপ সবকিছুই আমাদের ইতিহাস। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে ইতিহাসের অনুসন্ধান থেমে থাকে না বা আইন করে ইতিহাসের বিভিন্ন পাঠকে বন্ধ করা যায় না। বিশ্বায়নের ক্রমবর্ধমান বিস্তৃতির ফলে ইতিহাস সম্পর্কে প্রতিদিন মানুষের অনুসন্ধিৎসা বাড়ছে এবং ইতিহাসের নব নব উদঘাটিত তথ্য সবাইকে চমকে দিচ্ছে। ইতিহাস সম্পর্কে কোনো উপলব্ধি বা গবেষণাই চূড়ান্ত নয়। কিন্তু অনেকে মনে করেন ইতিহাস স্থির হয়ে গেছে- যেটা ঘটেছে বাংলাদেশের অনেক বুদ্ধিজীবীদের ক্ষেত্রে। মানুষের জানার বা গবেষণার পদ্ধতি যত অগ্রসর হচ্ছে ইতিহাসের চেহারাও ততটা পাল্টে যাচ্ছে। এক সময় মনে করা হতো হযরত ওসমান (রা.) এর শাসনামলে পবিত্র কোরআনের যে ভাষ্য তৈরি হয়েছিল সেটা হয়তো প্রথম লেখা কোরআন শরিফ। কিন্তু কয়েক মাস আগে বিলেতে আবিষ্কৃত হাতে লেখা পাতা থেকে দেখা যায় হযরত আবু বকর (রা.)-এর আমলে কোরআন শরিফ প্রথম লিপিবদ্ধ হয়েছিল। ইহুদিরা তাদের নবীর কথা জানার জন্য যে অনুসন্ধান চালায় তাতে প্রায়ই নতুন নতুন তথ্য উঠে আসে। কয়েক দশক আগে যিশুখ্রিস্টের মানবিক রিপু নিয়ে যে ছবি তৈরি হয়েছিল সেটা নিয়ে বিতর্ক হলেও নির্মাতারা দাবি করেছিলেন এর মধ্যে সত্যতা আছে। সাম্প্রতিক সময়ে প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার ফলে মিসর বা ইংল্যান্ডে অতীত সম্পর্কে নতুন নতুন তথ্য বেরিয়ে আসছে। ইতিহাসের তথ্য কখনও কখনও গ্রহণ করা অনেকের পক্ষেই কষ্টকর হয়। যারা অতীতকে নিজের কল্পনার রঙে রাঙিয়ে রেখেছেন তাদের জন্য কষ্টটা বেশি। বাংলাদেশে ইতিহাস বা ইতিহাস চর্চা যথেষ্ট স্পর্শকাতর বিষয়। অথচ পাকিস্তান বা ভারতে পরিস্থিতিটা ভিন্ন। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ সম্পর্কে স্ট্যানলি উলপার্ট এর লেখা বই যখন প্রথম প্রকাশিত হয় তখন সেই বই পাকিস্তানে নিষিদ্ধ হয়েছিল। কারণ বইতে বলা হয়েছিল বিলেতে ব্যারিস্টারি পড়ার সময় জিন্নাহ মদ্যপান করেছেন এবং শূকরের মাংস খেয়েছেন। পাকিস্তানি শাসক বিশেষ করে জিয়াউল হকের জন্য এ ছিল এক বিরাট ধাক্কা। একটি মুসলিম রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা কী করে মদ্যপান করতে পারেন? এ কারণেই বইটি পাকিস্তানে নিষিদ্ধ হয়েছিল। সরকার বদলের পর অবশ্য সেই নিষেধাজ্ঞা উঠে যায়। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর ব্যক্তিজীবন অর্থাৎ লেডি মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে কম লেখালেখি হয়নি। তাতে অবশ্য ভারত সরকার বা কংগ্রেস খড়গ হস্তে তথ্য ফাঁসকারীদের তাড়া করেনি। আর লোকমুখে নেহেরু সম্পর্কে যেসব তথ্য ক্রমপ্রচারিত সেগুলো না হয় অনুল্লেখই থাকল। গান্ধীর কামনা-বাসনা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে প্রচুর লেখালেখি হয়েছে। অতি সম্প্রতি প্রকাশিত একটি বইয়ে বলা হয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকায় বসবাসের সময় গান্ধী ছিলেন ইংরেজদের পদলেহী। বিশিষ্ট ভারতীয় লেখিকা অরুন্ধতী রায় এ বক্তব্যকে সমর্থন করেছেন; কিন্তু তাকে জেলে যেতে হয়নি। ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস আরও চমকপ্রদ। এক সময় মনে করা হতো মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস ছাড়া অন্যরা ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেননি। অথচ অন্যরা, বিশেষ করে বামপন্থীরা লড়াই করেছেন, অসংখ্য মানুষ প্রাণ দিয়েছেন, কৃষক-শ্রমিকরা অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছেন তার সবকিছুই এক সময় মুসলিম লীগ বা কংগ্রেসী ভাবধারায় বিশ্বাসী ঐতিহাসিকদের কারণে চাপা পড়ে গিয়েছিল। সৌভাগ্যের বিষয় সেখানে চিন্তার ও বিশ্বাসের জগতের দাসত্ব থেকে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির ঐতিহাসিকরা মুক্তি পেয়েছেন এবং ভারতের ব্রিটিশবিরোধী অন্দোলন বা গণতান্ত্রিক আন্দোলন সম্পর্কে নতুন নতুন তথ্য সামনে আসছে। বলা হচ্ছে, দিল্লি ও লাহরের মহাফেজখানায় এখনও যেসব তথ্য অব্যবহৃত আছে তা ব্যবহৃত হলে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং বিংশ শতাব্দীর ভারতের জনজীবন সম্পর্কে নতুন তথ্য সামনে আসবে। সেটা হয়তো হবে অপ্রীতিকর কিংবা গৌরবের। যাই হোক, তাতে লজ্জিত হওয়ার কিছু থাকবে না। নবাব সিরাজউদ্দৌলা সম্পর্কে এখনও নতুন নতুন তথ্য প্রকাশিত হচ্ছে এবং ঐতিহাসিকরা সেটা গ্রহণ করছেন। ইতিহাসের বিষয়বস্তু নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থানটা ভিন্ন। অনেক বিষয়কে এখানে এমনভাবে স্পর্শকাতর করে তোলা হয়েছে যে অনেকেই অনেক কিছু নিয়ে প্রশ্ন তুলতে ভয় পান। এ ভয় বিরোধী হলেই আক্রমণের শিকার হওয়ার ভয়। হাল আমলে এর সঙ্গে যুক্ত হতে যাচ্ছে আইনের সাজা। দেখা যাচ্ছে শিগগিরই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতকরণ অপরাধ আইন অনুমোদিত হয়ে যাবে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির প্রতিরোধে যে খসড়া আইন করা হয়েছে তাতে স্পর্শকাতর এ অভিযোগে যে কেউ থানায় মামলা করতে পারবেন। আইনে পাঁচ বছরের জেল ছাড়াও কোটি টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান থাকছে। এছাড়া সংক্ষিপ্ত ও নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অভিযোগের অনুসন্ধান, তদন্ত এবং বিচারের নির্দেশনা রয়েছে। এখানে যে প্রশ্নটি অত্যন্ত জরুরি তা হচ্ছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্য ও পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস কি রচিত হয়েছে? এ প্রশ্নের অত্যন্ত সহজ জবাব হচ্ছে- না। কিছুদিন আগে প্রফেসর রেহমান সোবহান তার একটি বইয়ের প্রকাশনা উৎসবে মন্তব্য করেছিলেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নির্দিষ্ট ইতিহাস এখনও রচিত হয়নি। কথাটি নির্মম সত্য এ কারণে যে, আবেগ দিয়ে উপন্যাস লেখা যায়, ইতিহাস নয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও তৎপরবর্তী ঘটনাবলি সম্পর্কে দেশে ও বিদেশে বেশকিছু বই প্রকাশিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ অবসানের পরপর ভারতীয় লেখক ও জেনারেলদের লেখা যেসব বই প্রকাশিত হয়েছিল তা এখন বাজারে পাওয়া যায় না। সেসব বইতে অবাক করার মতো অনেক তথ্য আছে যেগুলো এখন পর্যন্ত কেউ আপত্তি করেননি। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও সমসাময়িক ঘটনাবলি সম্পর্কে ইংরেজিতে লেখা যেসব বই প্রকাশিত হয়েছে তা নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। বিজ্ঞজনরা মনে করেন, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ইংরেজি বই পড়তে উৎসাহবোধ করেন না বলেই ওসব বইয়ের বিষয়বস্তু সম্পর্কে মাথা ঘামানোর কিছু নেই। কিন্তু গোল বাধে তখন যখন প্রায় অভিন্ন তথ্যের ভিত্তিতে বাংলায় লেখা বই প্রকাশিত হয়। তখন বইয়ের বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা হয় না, আক্রমণের শিকার হন ব্যক্তি লেখক। সমাজের অনেক দায়িত্বশীল ব্যক্তি এমন ভাষায় ওইসব লেখকদের আক্রমণ করেন যা শুধু দুঃখজনক নয়, নিন্দনীয়ও বটে। এ আক্রমণের সময় ইতিহাসের অধ্যাপকরা কখনও যুক্তি দিয়ে এসব বক্তব্যকে খণ্ডন করেন না। রাজনীতি ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ইতিহাস কীভাবে বিবৃত হবে তা বলা কঠিন। এক সময় বলা হতো আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। এখন সেই মামলার অন্যতম আসামি এবং জাতীয় সংসদের সাবেক ডেপুটি স্পিকার শওকত আলীসহ অন্যরা বলেছেন, সত্য মামলা আগরতলা। প্রশ্ন হচ্ছে, জনগণ কি রাজনৈতিক স্লোগান গ্রহণ করবে, না ইতিহাসের তথ্যকে গ্রহণ করবে? সংবাদপত্রের খবরে আরও বলা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধে বীর শহীদদের সংখ্যা, স্বাধীনতার ঘোষণা ও ঘোষণাপত্র, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদানসহ বিভিন্ন বিষয়ে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ দলের কয়েক নেতার সাম্প্রতিক বক্তব্য আইনটির খসড়া তৈরির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, একটি রাজনৈতিক দলের প্রধানের বক্তব্য নতুন আইন তৈরিতে সরকারকে প্রলুব্ধ করে। বর্তমান বিশ্বে এমন আচরণ শোভন নয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের এবং লাঞ্ছিত নারীদের সংখ্যা নিয়ে কোনো প্রশ্ন উত্থাপিত হলে শহীদদের আত্মত্যাগ এবং নারীদের লাঞ্ছনার ইতিহাস মিথ্যা হয়ে যাবে না। কদিন আগে সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে লাঞ্ছিত নারীদের সংখ্যা দু’লাখ নয় আরও বেশি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানি ও হিটলার অধিকৃত অঞ্চলে একজন নারীর লাঞ্ছনার চিত্রও সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে যেভাবে উঠে এসেছে তাতে মানুষের ঘৃণাই জন্মেছে, ভালোবাসা নয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে যে কোনো আলোচনাই হোক না কেন তা মুক্তিযুদ্ধের বাস্তবতা ও গৌরবকে মুছে ফেলতে পারবে না। মুক্তিযুদ্ধের নায়ক যারা তাদের সম্পর্কেও যদি সমালোচনামূলক কোনো লেখা প্রকাশিত হয় তাতেও তাদের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হবে না। ক্ষুণ্ণ হবে না বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান অথবা স্বাধীনতার সৈনিক, বাংলাদেশের আইকন জিয়াউর রহমানের মর্যাদা। তবু মনে রাখতে হবে মানুষ দেবতা নয়। নতুন চীনের স্থপতি মাও সে তুং-কে জীবিত অবস্থায় যেভাবে মূল্যায়ন করা হতো মৃত্যুর পর চীনারা সেই মূল্যায়নে পরিবর্তন এনেছে। বলা হচ্ছে তার ৭০ ভাগ ভালো ৩০ ভাগ খারাপ। ইতিহাসের এ বাস্তবতা দিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে বিচার করলে সমস্যা অনেক সহজ হবে। ইতিহাস বিকৃতকরণ আইনটি পাস হলে যে কারও মামলা করার সুযোগ যে পরিস্থিতি তৈরি করবে তা কল্পনা করা কষ্টকর। এ বিকৃতি কে ব্যাখ্যা করবেন অথবা তার ব্যাখ্যা করার মতো ক্ষমতা আছে কি-না তা প্রশ্নাতীত নয়। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে পুরো জাতি। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে অনুসন্ধিৎসু গবেষণা বা লেখার পথ বন্ধ হয়ে যাবে; কারণ গবেষণা করে কেউই পাঁচ বছরের জেল বা কোটি টাকার দণ্ড গ্রহণ করতে ঝুঁকি নেবেন না। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে অনেক স্পর্শকাতর বিষয় জড়িয়ে আছে। প্রফেসর আনিসুজ্জামান তার একটি বইয়ে লিখেছেন, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পর তারা আদিষ্ট হয়েও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের জাতির উদ্দেশে প্রদেয় বক্তৃতা লিখতে পারেননি, বক্তৃতার খসড়া এসেছিল দিল্লি থেকে। অতীতের স্পর্শকাতরতা মানুষ ব্যক্তিজীবনে গ্রহণ বা হজম করতে পারে না; কিন্তু সমাজের সেই সমস্যা নেই। নেই বলেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানিদের হাতে নিগৃহীত কোরিয়ান নারীরা প্রকাশ্যে ক্ষতিপূরণ দাবি করেছেন। আর বারাক ওবামা বলেছেন, হিরোশিমায় আণবিক বোমা বর্ষণের জন্য তিনি ক্ষমা চাইবেন না। স্বাধীনতার ৪৫ বছর পর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের স্পর্শকাতরতা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। বাংলাদেশের মানুষের কাছে মুক্তিযুদ্ধ এক তীব্র আবেগের বিষয়। এ আবেগ সংরক্ষণের জন্য যেমন আইনের প্রয়োজন নেই, তেমনি কোনো উল্টো প্রচারণার ভয় পাওয়ারও কিছু নেই। ইতিহাসকে মুক্তি দিতে হবে কূপমণ্ডূকতা থেকে, অন্ধকার থেকে নিয়ে আসতে হবে আলোয়

অন্য খবর  নিজেকে জানো

উৎস ঃ যুগান্তর

আপনার মতামত দিন