মাদকাসক্তদের উত্পাতে আশ্রয়হীন মুক্তিযোদ্ধা ফয়জল

229

জীবনের মায়া ত্যাগ করে হানাদার বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ফয়জল রহমান। দেশ আজ স্বাধীন। অথচ ফয়জল এখন বড্ড অসহায়। সাইকেল-রিকশা মেরামত করে অনেক কষ্টে সংসার চলে তার। নিজের ভিটেবাড়িটুকুও নেই। সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রে কোনোরকমে একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই হলেও মাদকাসক্তদের উত্পাতে সেখান থেকেও বিতাড়িত অসহায় এই মুক্তিযোদ্ধা। এখন উপায় কী তাহলে?

ঢাকার অদূরে দোহার বাজারে ছোট্ট একটা টং দোকান। এখানেই সাইকেল-রিকশা মেরামত করে সারাদিনে তার আয় দেড়শ’ থেকে দুইশ’ টাকা। কয়েক বছর আগে থেকে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা হিসেবে সামান্য কিছু টাকা পান। দুই ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে পরিবারের সদস্য সংখ্যা পাঁচ। সামান্য এ টাকায় সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে ফয়জলের। টাকার অভাবে সন্তানদের ঠিকমতো লেখাপড়া শেখাতে পারেননি। জীবনের শেষ সময়ে এসেও তাকে সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে হয়।

১৯৯৯ সালে দোহারের সুতারপাড়া ইউনিয়নের কাজীরচর আশ্রয়ণ প্রকল্প এলাকার অসহায় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সরকারিভাবে ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়। ফয়জলও সেখানে একটি ঘর পান। বছরচারেক কোনোরকমে সেখানে পরিবার-পরিজন নিয়ে থাকার সুযোগ হয় তার। কিন্তু মাদকাসক্ত আর বখাটেরা তার সেই আশ্রয়স্থলও কেড়ে নেয়।

ফয়জল এখন পুরোপুরি আশ্রয়হীন। ভাইয়ের জমিতে কোনোরকমে একটা টিনের ছাপরা বানিয়ে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। কীভাবে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন তা জানতে চাইলে ফয়জল বলেন, আমি তখন খুলনা গোয়ালপাড়া পাওয়ার স্টেশনের কর্মচারী। ’৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ঘুমিয়ে আছি। হঠাত্ চিত্কার শুনে ঘুম ভেঙে যায়। পরে জানতে পারি ঢাকায় পাকিস্তানি মিলিটারিরা নিরীহ বাঙালিদের ওপর অতর্কিত হামলা চালিয়েছে। নানা আশঙ্কার মধ্যে রাত পার হয়। এরপর কেটে যায় আরও কয়েকদিন। ততদিনে নির্বিচারে বহু মানুষ হত্যা করেছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী।

অন্য খবর  নবাবগঞ্জে ছাত্রলীগের শোক মিছিল ও সভা

আমি যেখানে চাকরি করতাম সেখানে কাজ করতেন কয়েকজন জাপানি কর্মকর্তা। দেশের এমন পরিস্থিতিতে ৩ এপ্রিল তারা নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। যশোর বিমানবন্দরে তাদের পৌঁছে দিয়ে আমিসহ সাতজন বাঙালি যখন কর্মস্থলে ফিরছি তখন পথে পাকিস্তানি মিলিটারিরা আমাদের আটক করে। নানারকম জেরা শেষে আমাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হয়। খুলনায় ফিরে যুদ্ধে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। এরপর হেঁটে দোহারের উদ্দেশে রওনা হই আমরা সাতজন। দু’দিন পর ফরিদপুরের এক স্কুলের কাছে পৌঁছতেই মিলিটারি বাহিনী আমাদের স্কুলের ভেতর আটক করে। পরদিন ভোরে শুরু হয় জিজ্ঞাসাবাদ। একপর্যায়ে তারা আমাদের ওপর শারীরিক নির্যাতন চালায়। আমাদের সবার শরীর থেকে তখন রক্ত ঝরছিল। দীর্ঘক্ষণ নির্যাতন ভোগ শেষে সেখান থেকে মুক্ত হয়ে কোনোমতে দোহার পৌঁছলাম।

এরপর সামছুদ্দিন খন্দকার এবং আলমগীর খানের নেতৃত্বে আমরা দোহারের বিভিন্ন স্থানে গোপনে প্রশিক্ষণ নিতে থাকি। দোহারের আবদুল হাশেম, প্রিয়া কর্মকার, রাজ্জাক খান, আফতাব উদ্দিন কাজী (সাবেক চেয়ারম্যান), খালেক, সিদ্দিক, উকিল, জলিল খান, বাশার মৃধা ও জলিল দারোগাসহ অনেকেই ছিলেন আমাদের সঙ্গে। কিছুদিনের মাথায় মানিকগঞ্জ থেকে ২নং সেক্টরের ক্যাপ্টেন হালিম চৌধুরী এসে জানান, তার ইউনিটে ৫০০ সোলজার প্রয়োজন। দোহারের বিভিন্ন এলাকা থেকে ১৫০ মুক্তিযোদ্ধা মানিকগঞ্জের শিবালয় থানার পোদ্দারবাড়ি ক্যাম্পে যাই। সেখানে ক্যাপ্টেন হালিম চৌধুরী ও ক্যাপ্টেন হায়দারের নেতৃত্বে প্রতিরোধের দুর্গ গড়ে তুলি। আমাদের সঙ্গে অন্য ইউনিটের মাধ্যমে অংশগ্রহণ করেন সাবেক গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আবদুল মান্নান খান। রাতে মানিকগঞ্জ থেকে গোয়ালন্দ পদ্মার পারে বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানিদের খোঁজে অভিযান চালাই। শত্রুপক্ষ আমাদের টার্গেট করে গোলাবর্ষণ করে। একপর্যায়ে আমরা পাকিস্তানি শত্রুবহরের একটা নৌকা আটক করি এবং সেখান থেকে ছয় থেকে সাতজন পাকিস্তানি মিলিটারিকে ব্যারাকে নিয়ে যাই। এভাবে একের পর এক পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান চলে।

অন্য খবর  আগামীর সময় পত্রিকার ৪র্থ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন

খানিকটা ক্ষোভ প্রকাশ করে ফয়জল বলেন, আমরা তো কোনো কিছুর মোহে যুদ্ধ করিনি। পাকিস্তানিদের নির্যাতন থেকে রেহাই পেয়ে সবাই একটু শান্তিতে থাকবে, স্বাধীনভাবে চলাফেরা করবে-এসব ভেবেই মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলাম। কিন্তু আজ আমি আশ্রয়হীন। স্বাধীন দেশে পরিবার-পরিজন নিয়ে থাকার জায়গাটুকুও নেই।

জানতে চাইলে সুতাপাড়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নজরুল ইসলাম বাবুল বলেন, বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। আমি দায়িত্বে থাকাকালে ফয়জলসহ বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে আশ্রয়কেন্দ্রে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম। বর্তমানে সেখানে মাদকাসক্তদের উত্পাত বেড়ে গেছে। তারপরও এসব সহ্য করে অনেক মুক্তিযোদ্ধা সেখানে রয়েছেন।

তিনি বলেন, দোহারকে মাদকমুক্ত করার জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও ইউএনওকে একাধিকবার অনুরোধ করেছি। মাঝেমধ্যে অভিযানের কারণে উত্পাত কিছুটা কমে। কিন্তু পুরোপুরি বন্ধ হচ্ছে না। এটি আসলেই উদ্বেগজনক।

দোহার উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মো. রজ্জব মোল্লা বলেন, ফয়জল রহমান একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। যতটুকু জানি তার কোনো ঘরবাড়ি নেই। একজন মুক্তিযোদ্ধার এমন দুরবস্থা মেনে নেওয়া যায় না। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ফয়জলের জন্য যা যা করণীয় তা করা হবে।

আপনার মতামত দিন