মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয়, তাদের ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া, গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণে পিছিয়ে পড়া- এ তিন কারণে বাংলাদেশ ভূ-রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জে পড়েছে বলে মত দিয়েছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা।
তারা বলছেন, মিয়ানমার-বাংলাদেশ, ভারত-বাংলাদেশ, চীন-বাংলাদেশ এবং রাশিয়া-বাংলাদেশের মধ্যে দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেদিক বিবেচনায় বাংলাদেশ বর্তমানে একটা স্পর্শকাতর অবস্থানে রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হলেও ভূ-রাজনৈতিক, ভূ-কৌশলগত দিক থেকে বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়ার শঙ্কা রয়েছে।
মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের বিষয়ে শুরু থেকেই রাশিয়া বিষয়টিকে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের ‘অভ্যন্তরীণ সংকট’ বলে অভিহিত করেছে। একই সুরে সুর মিলিয়েছে বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন সহযোগী চীনও। তবে চীনের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমার সরকারের নীতিকে প্রভাবিত করার আশ্বাস দেয়া হয়েছে বাংলাদেশকে।
প্রতিবেশী ভারত প্রথমে মিয়ানমারের পক্ষে অবস্থান নিলেও বাংলাদেশের কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় তাদের অবস্থান পরিবর্তন হয়েছে। গত সপ্তাহে ঢাকা সফরকালে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ মিয়ানমার সরকারের উদ্দেশ্যে বলেছে, পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়া ও পুনর্বাসন করা হবে দীর্ঘমেয়াদী সমাধান।
এদিকে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সফরে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি জানিয়েছেন, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, রোহিঙ্গা ইস্যুর মূলে রয়েছে ভূ-রাজনৈতিক, ভূ-কৌশল ও ভূ-অর্থনৈতিক কারণ। এ কৌশলের অংশ হিসেবে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে গভীর সমুদ্র বন্দর হতে যাচ্ছে। পাকিস্তানে গভীর সমুদ্র বন্দর হয়েছে আবার ভারতে গভীর সমুদ্র বন্দর আছে। গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়ে যাচ্ছে, যা অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন বলেন, আমরা একটা ঝুঁকিপূর্ণ চ্যালেঞ্জিং পজিশনে আছি। মিয়ানমারের যে অবস্থান সেটা আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ, ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এবং চীনের জন্যও। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের নিয়ে যে ঘটনা ঘটেছে, সে ঘটনায় নিশ্চুপ থাকার সুযোগ নেই। বাংলাদেশে রোহিঙ্গারা চলে এসেছে, তাদের ফেরত পাঠাতে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টির কোনো বিকল্প নেই।
‘উভয় সংকটে পড়েছে বাংলাদেশ। একদিকে বাংলাদেশের সঙ্গে যেমন মিয়ানমারের সম্পর্কটা গুরুত্বপূর্ণ, একই সঙ্গে রোহিঙ্গাদের মানবিক বিপর্যয়ও গুরুত্বপূর্ণ। সে কারণে বাংলাদেশ এ দুটি ক্ষেত্রে সতর্কতার সঙ্গে বিশ্বে উপস্থাপন করেছে। বাংলাদেশের সমস্যা এবং রোহিঙ্গাদের সমস্যা একাকার হয়ে গেছে। বাংলাদেশের অবস্থানের পেছনে কূটনৈতিক একটা ইতিবাচক দিক আছে। সাময়িকভাবে মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের জায়গায় একটা চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে, এ সংকট মোকাবেলার মাধ্যমে বাংলাদেশের আরও শক্তিশালী অবস্থানে যাওয়ার সুযোগ আছে।’
কূটনৈতিক এ বিশ্লেষক বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত বা চীনের অবস্থান আন্তর্জাতিকভাবে সমালোচিত হচ্ছে। বাংলাদেশও স্পর্শকাতর অবস্থানে আছে। বাংলাদেশের মানুষ রোহিঙ্গা ইস্যুকে আবেগ দিয়ে দেখছে। আবেগ অবশ্যই থাকবে, কিন্তু রাষ্ট্রের জন্য আমাদের নিজস্ব যে ভূ-রাজনৈতিক, ভূ-কৌশলগত এবং অর্থনৈতিক যে দিকগুলো আছে তা বিবেচনা করতে হবে। বাংলাদেশ অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে এগোচ্ছে। মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্ককে আমরা হাইলাইট করছি। এ পরিস্থিতির ভালো-মন্দ দুটো দিকই আছে। বিশ্বব্যাপী আমাদের ভাবমূর্তি অনেক উজ্জ্বল হয়েছে। মানবিক সাহায্যের জন্য আমরা যে ধরনের হাত বাড়িয়ে দিয়েছি তাতে বোঝা যায় রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের বিষয়ে দেশের জনগণের মধ্যে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি আছে। আবার ভারত ও চীনের সঙ্গে দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্কের জায়গাটিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি বলেন, রাখাইনে পোর্ট (বন্দর) হওয়ায় অবশ্যই তা বাংলাদেশের পোর্টগুলোতে প্রভাব ফেলবে। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে আমরা পিছিয়ে পড়ব। আমরা বসে থাকলেও, কেউ তো আর বসে থাকবে না। সোনাদীয়া গভীর সমুদ্র বন্দর, মংলা গভীর সমুদ্র বন্দর, এগুলো যত দেরি হবে, ততই আমরা পিছিয়ে যাব। আমাদের গভীর সমুদ্র বন্দরের গুরুত্ব হয়ত থাকবে, কিন্তু এখান থেকে যতটা বেনিফিটেড হওয়ার কথা, সেটা নাও হতে পারি। যখন একাধিক পোর্ট হবে তখন অনেক প্রতিযোগিতামূলক বাজার তৈরি হবে।
‘কৌশলগত দিক থেকে, অর্থনৈতিক সম্ভাবনার দিক থেকে যত দেরি হবে ততই আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হব। যারা এখানে বিনিয়োগ করবেন, তারা এখান থেকে সর্বোচ্চ মুনাফা নেয়ার চেষ্টা করবেন। আমরা যেভাবে কালক্ষেপণ করছি তাতে আমাদের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে’- যোগ করেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, বাংলাদেশের প্রয়োজনেই গভীর সমুদ্র বন্দর দরকার। চীন যদি মিয়ানমারে গভীর সমুদ্র বন্দর করে সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে হয়ত চীনের আগ্রহ কমে যাবে। সেক্ষেত্রে অন্য জায়গা থেকে হয়ত অর্থ সংগ্রহ করতে হবে।
ভূ-রাজনৈতিক কৌশল সম্পর্কে তিনি বলেন, আগেকার দিনে জলের সঙ্গে স্থলের সম্পর্ক তৈরির একটা বিষয় ছিল। বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে সেটা হয়ত তেমন গুরুত্ব বহন করে না। আমাদের চীনের প্রয়োজন নেই। এ ধরনের নৌবন্দরের বিষয়ে গুরুত্বটা হবে অর্থনৈতিক। দিন দিন জাহাজের আয়তন বাড়ছে, বড় বড় জাহাজ তৈরি হচ্ছে এখন। বিভিন্ন দেশে পণ্য উৎপাদন হচ্ছে। ফলে জলের ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। কারণ এ পথে পণ্য পরিবহন নিরাপদ, খরচও কম। সেই হিসেবে অর্থনৈতিক বিষয়টি বড়, নিরাপত্তার বিষয়টি বর্তমান প্রযুক্তিতে খুব একটা গুরুত্ব বহন করে না।
সাবেক রাষ্ট্রদূত রাশেদ আহমেদ চৌধুরী বলেন, জাতীয় স্বার্থে আমাদের পোর্টটা (বন্দর) করতে হবে। এখন এটা আমাদের চ্যালেঞ্জ। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে এটা আমাদের করে ফেলতে হবে। ভারত, চীনের ওপর আমাদের নির্ভরতা কমাতে হবে। আমাদের কিছু কৌশলগত বিষয় আছে, আমরা মেরিটাইম ল্যান্ড বাউন্ডারি জিতেছি। এখন মধ্য আয়ের দেশ হতে হলে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে আমাদের গভীর সমুদ্র বন্দর করা দরকার।
সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যদি দেখেন তাহলে একাধিক গভীর সমুদ্র বন্দর গড়ে উঠলেও তা বাংলাদেশে কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না।