বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও আজ বুধবার পালিত হচ্ছে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব বড়দিন। খ্রিস্ট ধর্মের অনুসারীরা যিশু খ্রিস্টের এই জন্মতিথি উদযাপন করেছে নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশে খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারীর সংখ্যা খুব বেশি নয়। তারপরেও খ্রিস্টান অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে সাধারণ পরিবারগুলো কিভাবে উদযাপন করেছ এই উৎসব? সেটি দেখতে ঢাকার কাছে নবাবগঞ্জের বান্দুরায় গিয়ে দেখা যায়।
বড়দিন উপলক্ষে বাড়িতে বাড়িতে ঢোল আর গানবাজনাই জানান দিচ্ছে যে এখানকার খ্রিস্টান পরিবারগুলোতে উৎসব চলছে। তবে বড়দিন উদযাপনের সূচনা হয়েছিলো আসলে রোববার মধ্যরাতে, গীর্জা ও উপাসনালয়ে প্রার্থনার মধ্য দিয়ে।
১৭৭০ খ্রিষ্টব্দের দিকে ফাদার রাফায়েল গমেজ নামক একজন ধর্মযাজক ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে এই অঞ্চলে আগমন করেন। ১৭৭৪ খ্রিষ্টব্দে হাসনাবাদ ধর্মপল্লী প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৭৭৭ খ্রিষ্টব্দে পর্তুগীজ আমলে হাসনাবাদ পবিত্র জপমালা রাণীর নামে প্রথম গীর্জার ঘরটি নির্মিত হয়। যার বেদীর অংশটুকু ছিল পাকা িএবং বাকী অংশ কাঁচা। এর চাল শন ও হোগলার ছাউনি এবং বেড়া ছিল বাাঁশের। পরবর্তী সময়ে ১৮৮৮ খ্রিষ্টাব্দে মাননীয় ফাদার ব্রিটোর সময়ে বর্তমান পাকা গীর্জাটি নির্মিত হয়।
বান্দুরার হাসনাবাদ গীর্জার ফাদার ম্যাক্সওয়েল আলেকজান্ডার টমাস বলছেন, এবারের বড়দিনে তার গীর্জায় প্রার্থনায় অংশ নিয়েছে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের প্রায় আড়াই হাজার মানুষ।
তিনি বলেন, “এবার খুব শান্তিপূর্ণ ভাবে অনুষ্ঠান করছি। সবাই মিলে কীর্তন করেছি। নাচ গান করেছি। শান্তিপূর্ণভাবে জীবন যাপন করতে চাই সেজন্য প্রার্থনা করেছি।”
তথ্য অনুযায়ী এই বান্দুরা এলাকায় সাতটি গ্রামে সাড়ে তিন হাজার খ্রিস্টান রয়েছে। এছাড়া মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর থেকে শুরু করে নবাবগঞ্জের বিভিন্ন জায়গায় প্রায় ১৮টি গ্রাম রয়েছে খ্রিস্টানদের।
খ্রিস্টান একটি পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলার সময় পরিবারটির একজন সদস্য রাজু গোমেজ বলেন, সকালে গীর্জা থেকে এসে কেক ও পিঠা খাই। আত্মীয়স্বজন আসে এবং তাদের নিয়ে খুব মজা হয়।
তিনি বলেন, “ঘর সুন্দর করে সাজাই, ক্রিসমাস ট্রি সাজাই, আত্মীয়স্বজন সবাই একসাথে হয়ে উৎসব পালন করি।”
উৎসবের এ আমেজ দেখা যাচ্ছিলো প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই,অনেককেই দেখা গেছে নতুন জামা কাপড় পরে প্রতিবেশীদের বাড়ি যাচ্ছেন, কেউবা উৎসব করছেন নিজ বাড়ির আঙ্গিনাতেই। রাস্তার পাশে অনেকে পসরা সাজিয়েছেন মেলার মতো করে।
এ আনন্দ উদযাপন যাতে নির্বিঘ্নেই হয় সেজন্য প্রশাসন ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনী সক্রিয় রয়েছে। বড়দিনের আগের দিন গীর্জায় গীর্জায় সাংসদ সালমান এফ রহমানের পক্ষ থেকে ফুল, কেক ও শুভেচ্ছা বিনিময় করা হয়েছে।
উৎসব আর আমেজে ঢাকার দোহার ও নবাবগঞ্জ উপজেলার আঠার গ্রামের খ্রিস্টান পল্লীর বাড়িতে বাড়িতে চলছে সাজসজ্জা। অতিথিদের নিমন্ত্রণ করা হচ্ছে মোবাইল ম্যাসেজ, কার্ডসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে। বড়দিনে শুধু খ্রিস্টান সম্প্রদায় নয়, ওইসব এলাকার হিন্দু ও মুসলিম পরিবারগুলোকেও দাওয়াত করতে ভুল করছেন না তারা। অতিথি আপ্যায়নে কোনো ত্রুটি না রাখতে বাড়ি বাড়ি তৈরি করা হচ্ছে রকমারি পিঠাপুলি। তবে বড়দিনের অনুষ্ঠানে অতিথি আপ্যায়নে কেকই প্রাধান্য দেয়া হয়। প্রতিটি বাড়ির সামনে সাজানো হচ্ছে ক্রিসমাস ট্রি। শিশুদের বন্ধু হিসেবে পরিচিত সান্তাক্লজের উপহার পেতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে শিশুরা। অপেক্ষার দিনক্ষণ শেষ হতে হাতে বেশি সময় না থাকলেও মহাব্যস্ত এ এলাকার খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের পরিবারগুলো।
সরেজমিন দেখা যায়, দোহার-নবাবগঞ্জের গ্রামের গির্জা ও উপধর্মপল্লীগুলোকে সাজানো হচ্ছে ঝলমলে আলোকসজ্জায়। দোহারের ইকরাশী উপধর্মপল্লী, নবাবগঞ্জের সোনাবাজু উপধর্মপল্লী, হাসনাবাদ জপমালা রানীর গির্জা, সাধু ফ্রান্সিস জেভিয়ার গোল্লা গির্জা, তুইতাল গির্জা।
অন্যদিকে, বড়দিন উপলক্ষে নবাবগঞ্জের বান্দুরা বাজারে তৈরি পোশাক মার্কেটগুলোতে ব্যবসায়ীদের ব্যস্ততা বেড়ে গেছে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ক্রেতাদের ভিড় জমে উঠেছে।
দোহারের ঈমামনগর গ্রামের জন গমেজ জানান, ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যে পরিবারের সবাইকে নিয়ে বড়দিন পালনের প্রস্তুতি নিয়েছি। ইতিমধ্যে নতুন পোশাক কেনা হয়ে গেছে। এলাকার হিন্দু, মুসলমানদেরও দাওয়াত করেছি।
খ্রিস্টান অধ্যুষিত বান্দুরা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান হিল্লাল মিয়া জানান, বান্দুরা ইউনিয়নে মুসলমান, হিন্দু ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের বসবাস। আমরা অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণভাবে বসবাস করছি। বড়দিন এলে এই এলাকা সব সম্প্রদায়ের মিলনমেলায় পরিণত হয়।
নবাবগঞ্জের হাসনাবাদ গির্জার প্যারিস কমিটির সহ-সভাপতি সেলেস্টিন রোজারিও জানান, নবাবগঞ্জ ও দোহারের আঠার গ্রামের খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মূল কেন্দ্র হাসনাবাদ জপমালা রানীর গির্জা। সাত গ্রামের মূল অনুষ্ঠান হাসনাবাদে হয়ে থাকে। ২৪ ডিসেম্বর রাত থেকে আমাদের ধর্মীয় আচার শুরু হবে।
হাসনাবাদ জপমালা রানীর গির্জার ফাদার ম্যাক্সওয়েল জানান, নবরাজ খ্রিস্টকে গ্রহণ করতে বড়দিনের ৯ দিন আগে থেকে নভেনা খ্রিস্ট যাগ বা পাপস্বীকার পর্ব চলছে। দোহার, নবাবগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার প্রায় তিন হাজার পরিবার উৎসব পালনের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
এ বিষয়ে নবাবগঞ্জ থানার ওসি মো. মোস্তফা কামাল বলেন, গির্জা ও এর আশপাশে সর্বাত্মক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। নিরাপত্তার স্বার্থে ইতিমধ্যে অতিরিক্ত পুলিশ সদস্য চাওয়া হয়েছে।
নবাবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মঞ্জু বলেন, বড়দিন উপলক্ষে উপজেলা প্রশাসন সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে। নিরাপত্তার দায়িত্বে পুলিশের বিশেষ টিম মাঠে থাকবে।
