জাতীয় নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতায় ঢাকার দোহার উপজেলায় তিনজন নিহত হওয়ার দুই বছর নয় মাস চলছে। কিন্তু এত দিনেও এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এ কারণে বাদীপক্ষ হতাশ।
এদিকে আসামিরা জামিনে মুক্ত হয়ে বাদীপক্ষকে মামলা তুলে নেওয়ার জন্য হুমকি দিচ্ছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ঢাকা-১ (নবাবগঞ্জ-দোহার) আসনে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পরদিন আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির (জাপা) প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে তিনজন নিহত হন। পরদিন ৭ জানুয়ারি নিহত মকসুদ খন্দকারের ছেলে মোতালেব খন্দকার বাদী হয়ে ৫৬ জনের নাম উল্লেখ করে দোহার থানায় মামলা করেন। প্রায় আট মাস পর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। কিন্তু তাতে নারাজি দেয় বাদীপক্ষ। পরে তদন্তভার দেওয়া হয় সিআইডিকে।
নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আব্দুল মান্নান খান। জাতীয় পার্টির প্রার্থী ছিলেন সালমা ইসলাম। তাঁর পক্ষে কাজ করেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও বিলাসপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন মোল্লা। আর আব্দুল মান্নান খানের পক্ষে কাজ করেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি হুকুম আলী চোকদার। নির্বাচনে আব্দুল মান্নান খান পরাজিত হন। এর জেরে ভোটের পরদিন আলাউদ্দিন মোল্লা ও হুকুম আলী চোকদারের সমর্থকদের মধ্যে বাগ্বিতণ্ডা হয়। পরে দুই পক্ষের সংঘর্ষ হয়। এ সময় ইউপি চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন মোল্লার ভাগনে হাজারবিঘা গ্রামের মকবুল হোসেন (৩৫) এবং একই গ্রামের মকসুদ খন্দকার (৫৫) ও তাঁর ছেলে মাসুদ খন্দকার (২৮) নিহত হন। মকবুল উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ছিলেন।
নিহত ব্যক্তিদের প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্প্রতি কথা বলে জানা গেছে, সালমা ইসলাম সাংসদ নির্বাচিত হওয়ার পর মকসুদের পরিবারকে চার লাখ টাকা এবং মকবুলের পরিবারকে দুই লাখ টাকা সহায়তা দেন।
মকবুলের মামা ইউপি চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন মোল্লা বলেন, ‘প্রায় তিন বছর অইয়া গেল। এখনো তদন্ত প্রতিবেদনই দিবার পারল না। আমি যারপরনাই হতাশ।’
মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির পরিদর্শক মাসুদ করিম সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জ বদলি হয়ে গেছেন। জানতে চাইলে তিনি বলেন, তদন্তকাজ প্রায় শেষ। এখন শুধু নাম-ঠিকানা মিলিয়ে নিয়ে জমা দিতে হবে।
নিহত মকবুলের দুই ছেলে মো. সামিউল আলিম (৬) ও মো. রাতুল (৩)। সামিউল নার্সারিতে পড়ে। রাতুল এখনো পড়ালেখা শুরু করেনি। ২ ও ৩ সেপ্টেম্বর এই প্রতিবেদক হাজারবিঘা গ্রামে গেলে এই শিশুদের মা শামিমা আক্তার বলেন, ‘বাচ্চাদের তো মানুষ করতে হবে। এ কারণে স্বামীর বাড়িতেই আছি।’ মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে তিনি কিছু জানেন না।
মকবুলের বাড়ি থেকে একটু সামনেই নিহত মকসুদ খন্দকারের বাড়ি। সেখানে গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। দরজায় তালা ঝুলছে। একজন প্রতিবেশী বলেন, মকসুদের স্ত্রী পাশের গ্রামে গেছেন। এরপর কথা হয় মকসুদের ছোট ভাই দেলোয়ার খন্দকারের সঙ্গে। তিনি বলেন, এত দিনে মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা না দেওয়ায় তাঁরা হতাশ। আসামিরা প্রায় সবাই জামিনে মুক্ত। তাঁরা মামলা তুলে নেওয়ার জন্য হুমকি দিচ্ছেন।
মুঠোফোনে তিনজন আসামির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাঁরা এ বিষয়ে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। হুকুম আলী চোকদার ও রাশেদ চোকদারকেও বাড়িতে গিয়ে পাওয়া যায়নি।
মামলার বাদী মোতালেব খন্দকার বলেন, মাঝে মাঝে আসামি ও তাঁদের পক্ষের লোকেরা হুমকি-ধমকি দেন। কেন নারাজি দেওয়া হয়েছিল, জানতে চাইলে নিহত মকসুদের ভাই আনোয়ার খন্দকার বলেন, তদন্ত প্রতিবেদনে এলাকার কিছু নিরীহ মানুষের নাম এসেছিল। মানুষ যেন অযথা হয়রানির শিকার না হয়, সে জন্য নারাজি দেওয়া হয়েছিল।
জেলা সিআইডির পুলিশ সুপার আবু সুফিয়ান বলেন, ‘এ মামলায় এর আগে ডিবি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছিল। বাদীপক্ষ নারাজি দেওয়ায় পরে সিআইডিতে আসে। এখন কোনো আসামি বাদ পড়বে না। তদন্তে যাঁদের যুক্ত করা প্রয়োজন শুধু তাঁদেরই যুক্ত করা হবে। আশা করছি, এক মাসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া যাবে।’