‘আমার ঘরের পাশে গাছ আছে এক/ তাতে বাসা বেঁধেছিল পাখি প্রসূতিকালে/ ডিম ফুটে ছানা হল, ছানাদের ডানা হলো/ ডানা মেলে উড়ে গেল বাসাটা ফেলে’/…গানের এই পঙ্ক্তিগুলো শিল্পী মৌসুমি ভৌমিকের। এটি গানের একটি অংশ হলেও একটি বাড়ি কিন্তু এ রকমই এখন। একটি নয়, অনেকগুলো গাছ আছে সেই বাড়িটির ঘরের পাশে। আর সেই গাছগুলোতে অনেকগুলো পাখির বাসা। খড়কুটোতে পাখিরাই তা বুনে নিয়েছে।
সেসব বাসায় তারা ডিম পেড়েছে, ডিমে তা দিয়েছে। একদিন ডিম ফুটে ছানা হয়েছে। মা সেই ছানাদের বিপদ-আপদ থেকে আগলে রাখছে। দূর মাঠ থেকে, জলাভূমি থেকে ঠোঁটে করে বয়ে নিয়ে আসছে মাছ। অপেক্ষা-কাতর ছানাদের মুখে তুলে দিচ্ছে আহার। দেখতে দেখতে ছানারা বড় হয়ে উঠছে। গাছের ডালে ডালে উড়ছে, ফিরে আসছে। পাশেই বসে থাকা মা ছানাদের এই দুষ্টুমিপনায় আহ্লাদে ডানা ঝাড়ছে।
মৌলভীবাজার সদর উপজেলার একাটুনা ইউনিয়নের মল্লিকসরাই গ্রামের আরশদ মিয়ার বাড়িটি এখন এ রকমই। পাখিদের নিরাপদ প্রজননক্ষেত্র, ঠিকানা। শত শত বক পাখি আর পানকৌড়ি ওই বাড়ির গাছে গাছে বাসা বুনেছে। কোনো ভয়ভীতি নেই, ইচ্ছা হলেই উড়ছে। বাচ্চাদের ফেলে রেখে তো আর অনেক দূর যাওয়া যায় না, কাছেপিঠে ঘুরে আবার ফিরে আসছে। এখানে পাখিরা মানুষের প্রতিবেশী নয়, পাখিরই প্রতিবেশী যেন বাড়ির মানুষ।
বাড়িটিতে ঢোকার মুখে পাখি-সাম্রাজ্যের কিছুই টের পাওয়া যায় না। কখনো হয়তো এক-দুটি বক পাখি, নয়তো দু–একটি পানকৌড়ির উড়ে যাওয়া চোখে পড়তে পারে। এই বাড়ির এক তরুণ আবদুর রশীদ যখন তাঁদের ঘরের পশ্চিম পাশে নিয়ে গেলেন, তখনই পাখিদের দেখা মিলল। বাড়িটিতে একতলা, দোতলা ঘর কয়েকটি। লম্বা উঠান। অনেক মানুষ। বাড়িজুড়ে মানুষের চলাচল, হইচই—সবই আছে। পাখিরাও আছে তাদের মতো।
বাড়ির পশ্চিম অংশে একটি পুকুরপাড়ের বাঁশঝাড়, আমগাছ, তেঁতুলগাছসহ বুনো গাছজুড়ে শুধু সাদা সাদা বক বসে আছে। কোনোটা হঠাৎ দুই ডানা মেলে উড়াল দিচ্ছে, পুকুরের ওপর এক-দুই পাক খেয়ে আবার আগের জায়গাতেই ফিরছে। কোনোটি অনেকটা ময়ূরের মতো পালক ফুলিয়ে বাসার কাছে বসেছে। ছানারা কিচিরমিচির করছে এখানে-ওখানে। তিনটি বাঁশঝাড়, কয়েকটি আমগাছ, কাঁঠাল ও তেঁতুলগাছে বেশ কটি বক পাখির বাসা।
গাছের শাখা-প্রশাখার ভাঁজে, পাতার নিচে খড়কুটো দিয়ে তৈরি করা এই বাসাগুলোতে ছানারা কখনো সরব, কখনো নিশ্চুপ। কোনোটিতে মা বক পাখি বসে ডিমে তা দিচ্ছে। কোনো বাসায় মা ছানাদের মুখে তুলে দিচ্ছে সংগ্রহ করে নিয়ে আসা খাবার। ছানারা হাঁ করছে, মা মুখের ভেতর পুরে দিচ্ছে খাবার। একইভাবে একটি তেঁতুলগাছের একটি বাসায় একটি পানকৌড়ি কোথা থেকে উড়ে এসে দু–তিনটি ছানার মুখে তুলে দিল আহার। এ আরেক সংসার। মানুষের কাছাকাছি ওটা শুধু পাখিরই জগৎ।
বাড়ির বয়সী মানুষ কুলসুম বেগম জানালেন, জ্যৈষ্ঠ মাস থেকে বাচ্চা ফোটা শুরু হয়েছে। তাঁরা পাখিদের একটুও বিরক্ত করেন না। পাখিরা আশা করে এখানে বাসা করেছে। কাউকে পাখিদের তাঁরা মারতেও দেন না।
হয়তো একদিন পাখিরা বাসা ফেলে উড়ে যাবে, সে নাহয় গেল। এ রকম তো প্রায় ১০ বছর ধরেই বাড়িটিতে পাখিরা এমন আসা-যাওয়া করছে। বৈশাখের বৃষ্টিবাদল শুরু হলেই ঝাঁকে ঝাঁকে বক, পানকৌড়ি ও কিছু অচেনা পাখি বাড়িতে আসতে থাকে। এখানে তারা বাসা তৈরি করে, ছানা ফোটায়। এরপর শীত আসার আগেই ধীরে ধীরে বাড়ি ছাড়তে থাকে।
তখন দু–চারটি বক হয়তো থাকে, অন্যরা দূরের কোনো হাওর-বাঁওড়ের দিকে চলে যায়। সকালেই এই পাখিদের হইচইটা বেশি। দুপুরে কিছুটা ঝিমানো ভাব থাকে। আবার সন্ধ্যার আগে আগে নানা জায়গা থেকে যখন দিনের লেনদেন শেষ করে ঘরে ফেরে, তখনো তাদের হল্লা-চিৎকারে বাড়ি পাখির দখলে চলে যায়।
বাড়ির আরেক বাসিন্দা মুজাহিদ আহমদ বলেন, এই পাখিরা তাঁদের বাড়ির অন্য সব প্রাণীদের মতো। গরমের সময় কিছুটা দুর্গন্ধ থাকে, তাতে একটুও বিরক্ত হন না তাঁরা। বৃষ্টি হলেই তা ধুয়েমুছে যায়। বছরে দুবার বাচ্চা দিয়ে থাকে পাখিগুলো। প্রথম দফার বাচ্চারা এখন বড় হচ্ছে।
আস্তে আস্তে উড়ে যাচ্ছে। বৃষ্টি-ঝোড়ো বাতাস হলে অনেক পাখি গাছপালার নিচে নেমে আসে। বাড়ির পেছনে, এখানে-সেখানে হাঁটাহাঁটি করে। ঝড়ে অনেক ছানা নিচে পড়ে যায়। যতটা সম্ভব তাঁরা ছানাদের বাসায় ফিরিয়ে দেন। কিছু উড়ে যায়। তাঁদের বাড়ির আশপাশের তিন-চারটি বাড়িতেও এ রকম কিছু পাখি ছানা ফোটায় এই মৌসুমে।
বনের মতো পাখিপাড়ার একটা পরিবেশ এখন গ্রামের এই অংশটিতে। কে কার প্রতিবেশী, বড় কথা নয়। তারা আছে মিলেমিশে আত্মীয় যেন।