স্মৃতিকথা: বন্ধুর শূন্যতায় – হামিদুর রহমান পলাশ

2080

মন আজ ‘বিয়োগান্ত’ বেদনায় মলিন।
হারিয়েছে ছন্দ, হারিয়ে সুর, তাল লয়
হারিয়েছে হৃদয়ের যত ভাব ভালবাসা
হারিয়েছে সুখ স্বপ্ন, হারিয়েছে আশা।
আজ কোন সুসংবাদ নেই
আছে দুঃসংবাদ।
প্রেম কিছুটা মধুর, কিছুটা বেদনা বিধুর।
কিছুটা কাল্পনিক,কিছুটা বাস্তব।
কিছুটা হতাশার, কিছুটা আশার।
এগুলো নিয়েই তো জীবন।

তারপরও বন্ধুর শূন্যতা মাঝে মাঝে মনকে-
নাড়া দেয় অব্যক্ত বেদনায়……………….।

সেদিন আকাশে শ্রাবণের মেঘ ছিল, ছিল নাকো চাঁদ! জীবনের প্রথম প্রবাস গমন, সাময়িক কিছু আনন্দ থাকলেও বেদনার যেন কোনও কমতি ছিল না। তখন শীতকাল। প্রচণ্ড শীত কুয়াশার চাদর দিয়ে ডেকে রেখেছিল গোটা পৃথিবীটাকে। আকাশের সূর্যের সঙ্গে সেদিন পৃথিবীর কোনও মিলন ঘটেনি। ঠিক ওদের মানসিক অবস্থা আর আমার মানসিক অবস্থার মধ্যে কোনও দূরত্ব ছিল না। বিদায় যে বড় কঠিন, বড় নির্মম সেদিন তা অনুভব করেছিলাম হাড়ে হাড়ে। দেশপ্রেম কি, বন্ধুত্ব কি, আত্মার সম্পর্ক কি? ভালবাসা কি? ভালবাসার রূপ, রঙ, গন্ধ, বর্ণ সবকিছু সেদিন মন অনুভব করেছিল একান্ত করে। সেদিন অনেকেই বোবা কান্নায় কেঁদেছিল। সবচেয়ে বড় একা হয়ে গিয়েছিল আমার সন্তান আমার দ্বিতীয় আত্মা। সে আমার কোলে আমার গলা ধরে সবার দিকে ফেলফেল করে তাকিয়ে থেকে মাঝে মাঝে আমার গালে চুমু দিচ্ছিল। আর আমি যেন অনেকটা বোবা পাথর হয়ে গিয়েছিলাম। সেদিন বিদায়ের বাঁশির সকরুণ সুর আজও আমাকে নীরবে কাঁদায়। আমি হারিয়ে যেতে থাকি ভাবনার অতল গভীরে। আমার স্মৃতিমাখা সে দিনগুলো যেন আজও স্মৃতি হয়ে ভেসে বেড়ায় মনের জানালায়। তবে সেদিন সাময়িক সময়ের জন্য হলেও আনন্দ পেয়েছিলাম এই ভেবে যে, একটু সুখের আশায়, একটু শান্তির অন্মেষনে মা-বাবা ভাই-বোন, স্ত্রী-সন্তানের মুখে হাসি ফোটাতে পারব।

আমার ঢাকার কর্মব্যস্ত জীবন কেটেছে বেশিটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসীন হলে। ছুটি কাটাতে যখন গ্রামের বাড়ীতে আসতাম তখন গ্রামের পুরনো বন্ধুদের নিয়ে চলে যেতাম পদ্মার তীরে। সেখানে আড্ডা চলত মাঝ রাত পর্যন্ত। জানি না আজ আর সে আড্ডা জমে কিনা, আমার জানা নেই হয়তোবা জমে নয়তোবা নয়। হয়তোবা বন্ধুরা আমার শূন্যতা অনুভব করে, নয়তো নয়! কিন্তু আমি আজও অতীতের সেই সোনাঝরা দিনগুলো হৃদয়ের ক্যানভাস থেকে কিছুতেই মুছতে পারিনি। সবাই হয়তো ভুলে গেছে, কেননা বড় বড় আনন্দ উৎসবের দিনগুলোতে তারা কেউ একটা এসএমএস দিয়েও মনে করে না। প্রথম প্রথম দেশের বন্ধুদের প্রচুর চিঠি লিখতাম। কিন্তু কখনো উত্তর পায়নি। এখন অনেকটা কমিয়ে দিয়েছি তাদের কাজ থেকে সাড়া না পেয়ে। তারপরও অতীত স্বপ্নকে লালন করি সযতনে বুকের গভীরে।

অন্য খবর  মিজানুর রহমান শমশেরীর দুটি কবিতা

স্বপ্নই সবাইকে বাঁচিয়ে রাখে প্রবাসের আত্মীয় পরিজনহীন একাকী পরিবেশে। স্বপ্ন! স্বপ্ন সবাই দেখে,কেউ জেগে কেউবা ঘুমিয়ে। ঘুমের মাঝে স্বপ্ন সবার কাছেই আসে। আমার কাছে প্রতি রাতেই আসে। বিচ্ছিন্ন খন্ড খন্ড স্বপ্ন। স্বপ্নতো আর সাজিয়ে গুছিয়ে ধারাবাহিক ভাবে আসে না। যে রাতে আমি স্বপ্ন দেখিনা, সে রাতটা আমি ধরে নেই আমার বিনিদ্র রজনী কেটেছে । ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখিনি সে আমার জীবনে কখনো ঘটেনি। ঘুম বিশেষজ্ঞদের মতে, স্বপ্নের একটা সময় সীমা আছে সেটা কখনো দীর্ঘ সময় ধরে চলতে পারে না। কিন্তু আমার স্বপ্ন গুলি অনেক দীর্ঘ হয়, অন্তত আমার কাছে সেটা মনে হয়।আমার স্বপ্ন আমার বাস্তব চিত্রের সাথে মিলে মিশে আমাকে কঠিন ভাবে ফিরিয়ে নিয়ে যায় ফেলে আসা অতীতে।

কর্মব্যস্ততার এই প্রবাসে মানুষের জীবনে অবসরের বড় অভাব। তবুও প্রতিদিন জীবনের এই পথ চলতে গিয়ে ২৪ ঘন্টার মধ্যে কোনো না কোনো সময় মন ছুটে যায় কোনো স্মৃতির পাতায়, যা সীমাবদ্ধ থাকে না কোনো একটি মধুর বা বেদনাবিধুর স্মৃতিতে। কোন দিবস এলে সেটা আরো ভারাক্রান্ত করে এ হৃদয়কে। আসলে আমাদের জীবনে এমন পূর্ণ অবসর নেই তাই চিন্তাধারাগুলো এখন আর একটি জায়গায় সীমাবদ্ধ থাকে না। এক বর্ষণমুখর দিনে সোনার হরিনের আশায় দেশ ত্যাগ করি। এই প্রবাসে যখন কোন দিবসের অবসরের স্বাদ নিতে চাই তখনই ফেলে আসা অতীতের কিছু মুখ ভেসে ওঠে স্মৃতির আয়নায়। একদিন যার কথা শুনতে চাইনি, আজ তাদের মধুর স্মৃতি বেশী মনে পড়ে। পড়ন্ত বিকেলে যখন আরব সাগরের তীরে গিয়ে দাঁড়াই, রাতের আঁধারে যখন ছোটখাটো অবসরগুলো কাটে তখন সেই সুখস্মৃতিগুলোই যেন স্থান করে নেয় সমস্ত মনজুড়ে। মনেপড়ে, সেই অগোছালো জীবনে ছিলো না কোন স্থিরতা। পরিচিত হলো দুটো মন সময়ের পথ ধরে এগিয়ে চললো তারই ধারাবাহিকতা। ওই মধুর স্মৃতি, সে আসবে বলে কত স্বপ্ন এঁকেছি জীবনের বাঁকে বাঁকে। এখনও যেন সেই স্বপ্নের রাজ্যে আছি।

অন্য খবর  সুদান: সভ্য মানুষ চিরতরে মুছে দিল প্রকৃতির এক নিযুত বয়সী প্রাণ

মাঝে মাঝে ভিড় করে স্কুল কলেজের ফেলে আসা সেই দিনগুলো এবং আরও কতস্মৃতি। কিন্তু সব স্মৃতিকে ভাসিয়ে সামনে চলে আসে বন্ধু দিবসের আনন্দের স্মৃতি। প্রবাস জীবনের কর্মব্যস্তার মাঝে শুরু হল নতুন এক পথচলা। এখনও যেন স্বাপ্নিক চোখে ভেসে আসে নানা রঙের রাঙ্গায়িত স্বপ্নের সেই দিনগুলো যা কোন দিবস আসলে দিয়ে যায় মৃদু আনন্দের ছোঁয়া। অবসরের মুহূর্তে ভেসে চলি ফেলে আসা সেই দিনগুলোতে।

প্রবাস জীবনের অনেকগুলো বছর পেরিয়ে যখন দেখি পেছনের দিনগুলো ধূসর ধূসর, আর সেই ধূসরতার শরীর থেকে হঠাৎ হঠাৎ কোনও ভুলে যাওয়া অতীত স্বপ্ন আচমকা সামনে এসে দাঁড়ায় বা কোনও স্মৃতি টুপ করে ঢুকে পড়ে আমার প্রবাসী একাকী নির্জন ঘরে, আমাকে কাঁপায়, আমাকে কাঁদায়। যে স্বপ্নগুলো অনেককাল মৃত, যে স্বপ্নগুলোকে এখন আর স্বপ্ন বলে চেনা যায় না, মাকড়শার জাল সরিয়ে ধুলোর আস্তর ভেঙ্গে কি লাভ সেগুলোকে নরম আঙুলে তুলে এনে। জানি সব, তবুও আমার প্রবাসের জীবন আমাকে বারবার পেছনে ফিরিয়ে নিয়ে যায়, আমি আমার অতীত জুড়ে মোহগ্রস্থের মতো এখনো হাঁটি। দুঃস্বপ্নের রাতের মতো এক একটি রাত আমাকে ঘোর বিষাদে আচ্ছন্ন করে রাখে এখনও। সন্ধ্যা রাতের তারা হয়তো আর আলো জ্বালবে না হৃদয় নিকুঞ্জে। পাল তোলা নৌকা আর বয়ে চলবে না জীবন গঙ্গায় ।আস্তে আস্তে জীবন ধাবিত হচ্ছে অজানা গন্তব্যের দিকে। তারপরও বন্ধত্বের উশূন্যতা ভুলে থাকা যায় না।

(চলবে)

আপনার মতামত দিন