আবারো প্রশ্নবিদ্ধ মান্নান খান

1019

আবারো প্রশ্নবিদ্ধ আব্দুল মান্নান খান। আর এবার তার সাথ অভিযুক্ত ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ নেতা নাসির উদ্দিন আহমেদ ঝিলু। আর অভিযোগ করেছে পরিবেশবাদী সংগঠনেরা। ঢাকার ফুসফুস হিসেবে খ্যাত প্রায় ২০০ বছরের পুরনো রমনা উদ্যানের জন্য বিষফোড়া হয়ে উঠেছে ইউরো আসিয়ানো নামের একটি রেস্তোরাঁ।

পরিবেশবিদদের আপত্তি সত্ত্বেও সামান্য কিছু অর্থের জন্য নগর গণপূর্ত বিভাগ রমনার বড় একটি অংশ লিজ দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটির কাছে। কিন্তু অভিযোগ পাওয়া গেছে, দরপত্রের শর্ত ভঙ্গ করে রেস্তোরাঁর মালিক কয়েক গুণ বেশি জায়গা দখল করেছেন। ফলে উদ্যানের উল্লেখযোগ্য একটি অংশের গাছপালা হুমকির মুখে পড়েছে। এমনকি পার্কের সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য নির্মিত ছাতাগুলোও রেস্তোরাঁ কর্তৃপক্ষ দখল করেছে। এ কারণে নগর গণপূর্ত বিভাগ চিঠি দিয়ে দখলে নেওয়া ওই বাড়তি জায়গা ছেড়ে দিতে বললেও দখলদাররা তা কানে তোলেনি।

জানা যায়, ২০১২ সালে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নাসির উদ্দিন আহমেদ তৎকালীন গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আব্দুল মান্নান খানের কল্যাণে রমনা রেস্তোরাঁ বাগিয়ে নেন। রেস্তোরাঁটি পেতে তখনকার যুবলীগসহ ক্ষমতাসীন দলের অনেক প্রভাবশালী টেন্ডারে অংশ নিলেও গণপূর্ত অধিদপ্তর মান্নান খানের নির্দেশের বাইরে যাওয়ার সাহস পায়নি। ফলে দুই কোটি ৮২ লাখ টাকা ভাড়ার বিনিময়ে পাঁচ বছরের জন্য রেস্তোরাঁটি ঝিলুকে দেওয়া হয়। এর নতুন নামকরণ করা হয় ইউরো আসিয়ানো। রেস্তোরাঁটি উদ্বোধন করেন মান্নান খান নিজেই। উদ্বোধনী ফলকে তাঁর নাম রয়েছে। রেস্তোরাঁ উদ্বোধনের তারিখ ১২ সেপ্টেম্বর।

ইউরো আসিয়ানোয় কর্মরত একাধিক কর্মচারী জানান, আওয়ামী লীগ নেতা জিলুর আগে একটি গ্রুপ ১৭ বছর রেস্তোরাঁটি দখলে রেখেছিল। এর মধ্যে আছেন মনির, মন্টু, শাহাদাৎ, ওবায়েদ প্রমুখ। তাঁরা গণপূর্তকে কোনো ভাড়া দিতেন না। উপরন্তু রিট করে দীর্ঘ সময় রেস্তোরাঁ দখলে রেখে কোটি কোটি টাকা আয় করেন তাঁরা। ২০১০ সালের দিকে অনেক চেষ্টার পর দখলদারদের উচ্ছেদ করা সম্ভব হয়। এরপর নগর গণপূর্ত বিভাগ পরিবেশের কথা চিন্তা করে আর কাউকে রেস্তোরাঁটি ভাড়া না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এ উদ্যোগকে সবাই সাধুবাদ জানায়। এভাবে দুই বছর কাটার পর সেখানে নজর পড়ে মান্নান খানের। একটি সাজানো টেন্ডারে তাঁর এলাকার লোক এবং ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নাসির উদ্দিন আহমেদ জিলুকে রেস্তোরাঁটি লিজ দেওয়া হয়। তিনি ২০১২ সালের ১২ আগস্ট থেকে ২০১৭ সালের ১১ আগস্ট পর্যন্ত সেটি পরিচালনার ক্ষমতা পেয়েছেন। বর্তমানে প্রতিদিন সেখানে আট-দশটি পার্টি, রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হচ্ছে। প্রতিদিন উদ্যানে ঢুকছে শত শত গাড়ি। ফলে সবুজ উদ্যানের স্বাভাবিক পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

অন্য খবর  মুকসুদপুর ইউনিয়ন নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদের ফরম তুললেন গিয়াস উদ্দিন সোহাগ

তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে নাসির উদ্দিন আহমেদ ঝিলু বলেন, ‘রেস্তোরাঁটি নিতে আমি কোনো তদবির করিনি। ৭৫ জন প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারিয়ে বেশি টাকার দর দিয়ে লিজ পেয়েছি। তবে ব্যবসায় নেমে দেখছি লোকসান হচ্ছে। এ বিষয়ে গণপূর্তকে একাধিক চিঠিও দিয়েছি।’

প্রখ্যাত নৈসর্গিক দ্বিজেন শর্মা বলেন, ‘দেশে আর দ্বিতীয় একটি রমনা উদ্যানের জন্ম হবে না। অথচ এর ভেতরেই রেস্তোরাঁ দিয়ে পরিবেশ ধ্বংস করা হচ্ছে। এটি বন্ধের জন্য আমরা অনেক সভা-সমাবেশ, বিক্ষোভ করেছি। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। ফলে যা হওয়ার হচ্ছে। প্রতিদিন রেস্তোরাঁয় শত শত গাড়ি, হাজার হাজার মানুষ আসছে। এতে উদ্যানের নীরবতা ভঙ্গ হচ্ছে। পাখির কলধ্বনি স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে।’

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, রেস্তোরাঁর সামনে পশ্চিম পাশে নগর গণপূর্তের রমনা শাখা-২-এর নির্মিত কয়েকটি স্থায়ী ছাতার নিচে চেয়ার-টেবিল বিছিয়ে খাদ্য পরিবেশন করা হচ্ছে। পাশে একটি বড় আমগাছের চারদিকে ছাউনি তুলে সেখানে বড় ধরনের একটি লাউঞ্জ তৈরি করা হয়েছে। সেখানে মানুষজন এসে বসছে, খাবার খাচ্ছে। ফলে প্রাচীন আমগাছটির অবস্থা মরণাপন্ন।

রমনা গণপূর্ত শাখার উপসহকারী প্রকৌশলী আলী আকবর সরকার বলেন, রেস্তোরাঁর ঠিকাদারকে ছয় হাজার ৯০০ বর্গফুট অংশ ভাড়া দেওয়া হয়েছে। এর অতিরিক্ত এক ইঞ্চি জায়গাও ব্যবহারের এখতিয়ার তাদের নেই। অথচ তারা এর পাঁচ-ছয় গুণ বেশি জায়গা দখল করে নিয়েছে। শত শত গাড়ি উদ্যানের ভেতরে আসছে, যার প্রভাব পড়ছে গাছপালার ওপর। বাড়তি জায়গা ব্যবহার না করার জন্য চিঠি দেওয়া হলেও কোনো কাজ হচ্ছে না।

অন্য খবর  চালনাই চক থেকে ছয় ডাকাত গ্রেফতার

পরিবেশবিদরা জানান, ঢাকার ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট চার্লস ডজ ১৮২২ সালে বন-জঙ্গল পরিষ্কার করে রমনা উদ্যান গড়ে তোলেন। তিনি ছিলেন আধুনিক ঢাকার স্থপতি। ১৮২৫ সালে রমনার একটি অংশে তিনি রেসকোর্স ময়দান প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে উদ্যানের সাড়ে ৬৮ একর জমির ওপর ৭১ প্রজাতির ফুল, ৩৬ প্রজাতির ফল, ৩৩ প্রজাতির ঔষধি, ৪১ প্রজাতির জলজ ও ১১ প্রজাতির অন্যান্য গাছ রয়েছে। এর বাইরেও রয়েছে অনেক দুষ্প্রাপ্য গাছ-গাছালি। এমন সব মহামূল্যবান গাছ এবং পরিবেশ রক্ষায় অচিরেই রেস্তোরাঁটি সেখান থেকে তুলে দেওয়া উচিত।

ইউরো আসিয়ানো রেস্তোরাঁর স্বত্বাধিকারী নাসির উদ্দিন আহমেদ অভিযোগ সম্পর্কে বলেন, ‘আমি সর্বোচ্চ দরদাতা হিসেবেই রেস্তোরাঁটি পাঁচ বছরের জন্য ভাড়া নিয়েছি। এ জন্য আমি তৎকালীন গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আব্দুল মান্নান খানের কোনো সহযোগিতা পাইনি। বরং তখন তিনি আমার বিরোধিতা করেছিলেন। এমনকি তিনি আমার ফাইল দেড় বছর আটকিয়ে রেখেছিলেন। এরপর অনেক দেনদরবার করে তাঁকে দিয়েই রেস্তোরাঁটি উদ্বোধন করতে হয়েছে। গণপূর্তের কোনো শর্ত ভঙ্গ করিনি।’

পরিবেশ নষ্টের ব্যাপারে ঝিলু বলেন, ‘ব্যবসায়ী হিসেবে আমি রেস্তোরাঁটি ভাড়া নিয়েছি। এখানে না হলে আরেক জায়গায় ভাড়া নিতাম। এ ক্ষেত্রে নগর গণপূর্ত বিভাগই ভালো বলতে পারবে। যদি রেস্তোরাঁর কারণে পরিবেশ নষ্ট হয়, তাহলে এর দায় তো তাদেরই। এর পরও আমি চারজন কর্মচারী দিয়ে সব সময় রেস্তোরাঁর চারপাশ পরিষ্কার করছি।’

জানা গেছে, একাধিক পরিবেশবাদী সংগঠন রমনা থেকে রেস্তোরাঁ উঠিয়ে দিতে অচিরেই আন্দোলনে নামবে। রমনাকে বাঁচানো না গেলে ঢাকাকে বাঁচানো সম্ভব নয় বলে তাদের অভিমত।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের সভাপতি আবু নাসের খান বলেন, ‘রমনার মতো একটি ঐতিহাসিক সবুজ উদ্যানকে কোনোভাবেই হোটেল-রেস্তোরাঁর মাধ্যমে ধ্বংস করা ঠিক নয়। সরকার এ ব্যাপারে পদক্ষেপ না নিলে আমরা প্রয়োজনে উচ্চ আদালতে যাব।’

আপনার মতামত দিন