নাইট টেম্পোলারদের কথা পর্ব ২

560

পতন

১১৭৮-এর ব্যাট্‌ল অফ দ্য হর্নস অফ হাত্তিন যা ক্রুসেডের একটি সন্ধিক্ষণ হিসেবে চিহ্নিত।
দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ক্রুসেডের ফলাফল পরিবর্তিত হতে শুরু করে। সালাদিনের  মত যোগ্য ও বলিষ্ঠ নেতার নেতৃত্বে মুসলিমরা আরও ঐক্যবদ্ধ হয় এবং খ্রিস্টান অঞ্চলের মধ্যে অন্তর্কোন্দল দেখা দেয়। নাইট টেম্পলাররা মেঝেমধ্যেই অন্য দুটি প্রধান খ্রিস্টান যাজকসম্প্রদায়ের সাথে বিবাদে লিপ্ত হত। অন্য দুটি অর্ডার হল  নাইট হসপিটালার  এবং  টিউটোনীয় নাইট। দেশব্যাপী বিবাদের কারণে খ্রিস্টানরা অনেকাংশে দুর্বল হয়ে পড়ে। বেশ কয়েকটি যুদ্ধে টেম্পলাররা হেরে যায়। অবশেষে হাত্তিনের যুদ্ধে  পরাজয়ের মাধ্যমে ১১৮৭ খ্রিস্টাব্দে জেরুজালেম পুনরায় সালাউদ্দিনের মুসলিম বাহিনীর দখলে আসে। টেম্পলারদের কোন সাহায্য ছাড়া ক্রুসেডাররা  ১২২৯  খ্রিস্টাব্দে স্বল্প সময়ের জেরুজালেম পুনরুদ্ধার করে। ১২৪৪  খ্রিস্টাব্দে  খোয়ারিজমীয় তুর্কীরা  আবার জেরুজালেম দখল করে নেয় এবং এর পর  ১৯১৭  সাল পর্যন্ত অঞ্চলটি মুসলিমদের দখলে থাকে।  ১৯১৭  সালে ব্রিটিশরা  অটোমান তুর্কীদের  কাছ থেকে জেরুজালেম দখল করে।

টেম্পলাররা তাদের সদর দফতর উত্তরের শহরগুলোতে সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিল। প্রথমে  আক্কা  শহরে সদর দফতর স্থাপন করে। প্রায় এক শতাব্দীকাল এখানে থাকার পর  ১২৯১  সালে এই শহরও মুসলিমদের অধিকারে আসে। অগত্যা টেম্পলাররা তাদের শেষ আশ্রয়স্থলে এসে ঠেকে। তাদের শেষ আশ্রয়স্থল ছিল  টারটোসা (বর্তমান সিরিয়া) এবং  আটলিট। তখন তাদের উপকূলবর্তী সদর দফতর ছিল কেবল একটি, সাইপ্রাসের লিমাসলে। এছাড়া টারটোসা সমুদ্র উপকূল থেকে খানিক দূরের আরওয়াদ দ্বীপে তাদের একটি ক্ষুদেকায় সেনানিবাস ছিল। ১৩০০  সালের দিকে তারা  মোঙ্গলদের  সাথে মিলে কিছু যুদ্ধ করার চেষ্টা করেছিল যা ছিল ফ্রাঙ্কো-মোঙ্গল মৈত্রীর একটি অংশ। এর মধ্যে আরওয়াদ দ্বীপে আগ্রাসী বাহিনী প্রেরণ। ১৩০২ বা ১৩০৩ সালে টেম্পলাররা তাদের এই শেষ আশ্রয়স্থলটিও হারায়। পবিত্র ভূমিতে এটিই চিল তাদের সর্বশেষ আশ্রয়স্থল।

এত ঘটনার পর অবশেষে এই যাজকসম্প্রদায়ের আর্থিক সাহায্য ও পৃষ্ঠোপোষকতা কমে যেতে থাকে। ইউরোপে তারা তাদের জনপ্রিয়তা হারায়। দুই শতাব্দীর কার্যক্রমের মাধ্যমে এক সময় টেম্পলাররা ইউরোপীয়দের প্রাত্যহিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাড়ালেও সে সময়কার পরিস্থিতি চিল সম্পূর্ণ ভিন্ন ও জটিল। পুরো খ্রিস্টান রাজত্ব জুড়ে স্থাপনা এবং ভবন নির্মাণের কারণে তারা স্থানীয় পর্যায়েও সর্বত্র উপস্থিত ছিল। সামরিক পতনের পরও তাই তারা অনেক কিছুই নিয়ন্ত্রণ করত। তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল কিছু ব্যবসা এবং ব্যাংক ব্যবস্থা যা তারাই প্রতিষ্ঠা করেছিল। অনেকেই তখনও তাদের খামারে কাজ করে জীবিকা অর্জন করত। তখনও তারা কোন স্থানীয় সরকারের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য ছিলনা, তাদের ছিল একটি সংগঠিত সেনাবাহিনী যা যেকোন সীমান্ত নির্বঘ্নে অতিক্রম করতে পারত যদিও এই সেনাবাহিনীর ছিলনা কোন নির্দিষ্ট যুদ্ধক্ষেত্র। এভাবে অনেক ক্ষেত্রে তারা হয়ে দাড়িয়েছিল এক রাষ্ট্রের ভিতরে আরেক রাষ্ট্র। এভাবে নিজেদের একটি যাজককেন্দ্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বার্থও হয়তো পরিলক্ষিত হচ্ছিল ঠিক যেমনটি টিউটোনীয় নাইটরা  প্রুশিয়ার  ক্ষেত্রে করেছিল।

বন্দিদশা এবং শাস্তি
১৩০৫ খ্রিস্টাব্দে নতুন পোপ ক্লিমেন্ট ৫ টেম্পলারদের গ্র্যান্ড মাস্টার জ্যাকুয়াস ডি মলি এবং হসপিটালারদের গ্র্যান্ড মাস্টার ফল্ক ডি ভিলার্ট  উভয়ের কাছেই পত্র পাঠান আর বিষয় ছিল এই দুই যোদ্ধা যাজক সম্প্রদায়ের একীকরণ। কেউই বিষয়টি মেনে নেয়নি। কিন্তু পোপ বারবার তাদের বিশেষ অনুরোধ করতে থাকেন এবং এক পর্যায়ে উভয়কে ফ্রান্সে এসে এ ব্যাপারে আলোচনায় অংশ নিতে আমন্ত্রণ জানান। জ্যাকুয়াস ডি মলি ১৩০৭ খ্রিস্টাব্দের প্রথম দিকে উপস্থিত হলেও ফল্ক ডি ভিলার্ট  প্রান্সে পৌঁছাতে কয়েক মাস বিলম্ব করেন। এই সময়ে ক্লিমেন্ট এবং জ্যাকুয়াস ডি মলি  এক বহিষ্কৃত টেম্পলার নাইট কর্তৃক উপস্থাপিত একটি মামলা বিষয়ে আলোচনা করেন। সবাই মোটামুটি একমত হয়েছিলেন যে তার উত্থাপিত তথ্যগুলো মিথ্যা, তথাপি ক্লিমেন্ট ফ্রান্সের তৎকালীন রাজা ফিলিপ ৪-এর কাছে মামলার তদন্তের ব্যাপারে সাহায্যের আবেদন জানিয়ে একটি পত্র লিখেন। কিন্তু নিজস্ব আর্থিক সুবিধার স্বার্থে ফিলিপ টেম্পলারদের এসকল গুজব বিষয়ে তদন্তের কোন চেষ্টা করেননি। টেম্পলারদের কাচে তার অনেক ঋণ ছিল। মূলত ইংরেজদের সাথে তার যুদ্ধের কারণেই তাকে ঋণ নিতে হয়েছিল। তিনি বিভিন্ন সময় টেম্পলারদের বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়ার জন্য চার্চকে চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন, যাতে তার ঋণের বোঝা নেমে যায়।

অন্য খবর  মিজানুর রহমান শমশেরীর ছড়া

অক্টোবর ১৩, ১৩০৭ রোজ শুক্রবার (যে দিনটি অনেকেই ভুল করে বিখ্যাত ফ্রাইডে দ্য থারটিন্‌থ কুসংস্কারের সাথে মিলিয়ে ফেলেন) রাজা ফিলিপ জ্যাকুয়াস ডি মলি এবং অন্যান্য ফরাসি টেম্পলারদের আটক করার নির্দেশ দেন। তাদেরে বিরুদ্ধে ধর্মদ্রোহীতা এবং উৎপথে চলার অভিযোগ আনা হয়। আটকের পর তাদেরকে বিশ্বাসঘাতকতার মিথ্যা স্বীকৃতি দেয়ার আগ পর্যন্ত নির্যাতন করা হয়। যদিও তাদের স্বীকৃতিগুলো জোরপূর্বক আদায় করা হয়েছিল, তথাপি তা প্যারিসে প্রভূত গুজবের সৃষ্টি করে। রাজা ফিলিপের আরও জোর জবরদস্তির প্রতি সাড়া দিয়ে পোপ ক্লিমেন্ট একটি আজ্ঞাপত্র ইস্যু করেন যার নাম Pastoralis Praeeminentiae। এই আজ্ঞাপত্রে সকল খ্রিস্টান রাজাকে স্থানীয় টেম্পলারদের আটক করা এবং তাদের সম্পত্তি ক্রোক করার আদেশ দেয়া হয়।

ফ্রান্সের রাজা ফিলিপ ৪ (১২৬৮ – ১৩১৪)

টেম্পলারদেরকে নির্দোষ প্রমাণের জন্য পোপের কাছে সভা আহ্বানের অনুরোধ জানানো হয়। পোপের ছাড় দেয়ার প্রেক্ষিতে এক সময় অনেক টেম্পলার ইনকুইজিশনের নির্যাতন থেকে রেহাই পায়। ইনকুইজিশন থেকে বেরিয়ে অনেক টেম্পলারই তাদের পূর্বতন স্বীকৃতি অমূলক বলে প্রত্যাহার করে। অনেকেরই নিজের স্বপক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ ছিল যা তাদেরকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারে। কিন্তু ১৩১০ ক্রিস্টাব্দে রাজা ফিলিপ আদালতে পুনরায় আপিল করার এই সুযোগ বন্ধ করে দেন। এরপর তার নির্দেশে আগের স্বীকৃতির জের ধরেই কয়েক ডজন টেম্পলার নাইটকে প্যারিসের অগ্নিখুটিতে বেঁধে পুড়িয়ে মারা হয়।

কনভেন্ট অফ দ্য অর্ডার অফ দ্য ক্রাইস্ট, পর্তুগাল। ১১৬০ সালে নাইট টেম্পলারদের আশ্রয়স্থলের সম্মানে নির্মিত। পরবর্তিতে নতুন অর্ডার অফ ক্রাইস্টের সদর দফতর হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

তার ইচ্ছা বাস্তবায়িত না হলে টেম্পলারদের বিপক্ষে সামরিক পদক্ষেপ নেয়া হবে বলে ফিলিপ পোপকে ভয় দেখান। অগত্যা পোপ ক্লিমেন্ট এই যাজকসম্প্রদায়কে চার্চের আওতা বহির্ভুক্ত তথা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। টেম্পলারদের যে মিথ্যা স্বীকারোক্তিগুলো ফ্রান্সের জনমনে গুজবের সৃষ্টি করেছিল সেগুলোকেই এর কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ১৩১২ সালে কাউন্সিল অফ ভিয়েনে পোপ বেশ কয়েকটি আজ্ঞাপত্র ইস্যু করেন যার মধ্যে ছিল, Vox in excelso যা যাজকসম্প্রদায়টিকে আনুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ করে এবং Ad providam যা টেম্পলারদের অধিকাংশ সম্পত্তি হসপিটালারদের কাছে হস্তান্তরিত করে।

অন্য খবর  স্মৃতির আড়ালে নবাবগঞ্জের সন্তান অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক

টেম্পলার যাজকসম্প্রদায়ের নেতাদের সম্মান রক্ষার্থে তাদের বয়জ্যেষ্ঠ্য গ্র্যান্ড মাস্টার জ্যাকুয়াস ডি মলি,  যিনি স্বীকারোক্তির কারণে নির্যাতিত হচ্ছিলেন, তার প্রতি যে বিচার করা হয়েছে তাকে অমূলক বলে প্রত্যাখ্যান করেন। তার সহযোগী নরমান্ডির প্রিসেপটর জিওফ্রি ডি চারনি -এ একই পথ অনুসরণ করেন এবং নিজেকে নির্দোষ বলে দাবী করতে থাকেন। এই দুজনকেই ধর্মদ্রোহীতা এবং উৎপথে চরার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয় এবং নিজ সিদ্ধান্তে অটল থাকার অপরাধে ১৩১৪ সালের মার্চ ১৮ তারিখে প্যারিসে পুড়িয়ে মারা হয়। জ্যাকুয়াস ডি মলি মৃত্যুর শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অনমনীয় ছিলেন বলে প্রচলিত মত থেকে জানা যায়। তিনি তাকে খুটির সাথে এমনভাবে বাঁধতে বলেছিলেন যাতে নটর ডেম ক্যাথেড্রাল দেখতে পারেন। এছাড়া মৃত্যুর কলে ঢলে পড়ার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি হাত জোড় করে প্রার্থনা করছিলেন। লোকমুথে প্রচলিত আছে, অগ্নিশিখা জ্বলতে থাকা অবস্থায় তিনি বলেছিলেন যে, শীঘ্রই ঈশ্বরের সামনে তার সাথে পোপ ক্লিমেন্ট এবং রাজা ফিলিপের দেখা হবে। এর কয়েক মাস পরেই পোপ ক্লিমেন্ট মারা যান এবং রাজা ফিলিপ সেই বছরের শেষ দিকে এক শিকার অভিযানে বেরিয়ে দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন।

টেম্পলারদের শেষ কয়েকজন নেতা চলে যাওয়ার পর অধিকাংশ সদস্যদেরই তিনটি পরিণতি হতে দেখা গিয়েছিল। হয় তাদেরকে আটক করে পোপতান্ত্রিক বিচারের মাধ্যমে শাস্তি দেয়া হয়েছে যদিও কারও বিরুদ্ধেই তেমন কোন অপরাধ প্রমাণিত হয়নি, নয়তো অন্যান্য সামরিক যাজকসম্প্রদায় যেমন নাইট হসপিটালারে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, অথবা পেনশন এবং ভাতা প্রদানের মাধ্যমে শান্তিতে বসবাসের সুযোগ দেয়া হয়েছে। অনেক টেম্পলারই পোপের শাসন বহির্ভুত অঞ্চল যেমন যোগাযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন স্কটল্যান্ডে চলে গিয়েছিল। পর্তুগালের টেম্পলাররা কেবল তাদের নাম পরিবর্তন করার মাধ্যমে নতুনভাবে কাজ শুরু করে। তাদের নতুন নাম হয় অর্ডার অফ ক্রাইস্ট।

২০০১ সালে ভ্যাটিকান গোপন সংগ্রহশালায় একটি অভিনব দলিল পাওয়া গেছে যা চিনন পার্চমেন্ট নামে পরিচিত। এই দলিলটি সম্ভবত ১৬২৮ সালে ভুল করে অন্য একটি ফাইলের মধ্যে রাখা হয়েছিল। যাহোক, এই দলিল থেকে জানা গেছে, ১৩১২ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে টেম্পলার সম্পদ্রায়কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার আগে ১৩০৮ খ্রিস্টাব্দে পোপ ক্লিমেন্ট তাদের বিরুদ্ধে আনীত সকল ধর্মদ্রোহীতার অভিযোগ থেকে তাদেরকে অব্যাহতি দিয়েছিলেন। অর্থাৎ প্রথমে নিজ বিচার বুদ্ধি দিয়ে তিনি টেম্পলারদেরকে নির্দোষ বললেও পরে স্বার্থের খাতিরে বা অন্য কোন কারণে তাদেরকে দোষী সাব্যস্ত করেছেন। এই দলিলটি মূলত টেমস্পলারদের মামলার তথ্যাদিতে পরিপূর্ণ। ২০০৭ সালের অক্টোবর মাসে স্ক্রিনিয়াম পাবলিশিং হাউজ, যারা ভ্যাটিকানের হয়ে দলিলপত্র প্রকাশ করে থাকে, টেম্পলারদের মামলা সংশ্লিষ্ট দলিলপত্র প্রকাশ করে যার মধ্যে চিনন পার্চমেন্টও অন্তর্ভুক্ত ছিল।

বর্তমানে রোমান ক্যাথলিক চার্চ স্বীকার করেছে যে, মধ্যযুগে নাইট টেম্পলারদের অবস্থান সম্পূর্ণ সঠিক ছিল। তারা অন্যায় কিছু করেনি এবং তাদের যাজকসম্প্রদায় সম্পূর্ণ খ্রিস্টান ধর্মীয় আইন মোতাবেকই কাজ করেছিল। পোপ ক্লিমেন্ট তখন সে ধরণের আজ্ঞাপত্র ইস্যু করতে বাধ্য হয়েছিলেন। বাধ্য হওয়ার কারণ ছিল জনসাধারণের মধ্যে স্ফুলিঙ্গের মত ছড়িয়ে পড়া গুজবের চাপ এবং প্রভাবশালী রাজা ফিলিপ ৪-এর অসাধারণ প্রভাব।

আপনার মতামত দিন