দোহার-নবাবগঞ্জে চলছে মাদকের রমরমা ব্যবসা

1966

ঢাকার দক্ষিণের দুই উপজেলা দোহার এবং নবাবগঞ্জ। উপজেলা দুটিতে মোট জনসংখ্যা প্রায় ৭ লক্ষ। আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে উন্নয়নের অনেক ছোঁয়া লেগেছে এ দুই উপজেলায়। প্রবাসী অধ্যুষিত এই দুই উপজেলায় বর্তমানে মাদক এক ভয়াবহ সমস্যার নাম। বিভিন্ন প্রকার মাদকের বিস্তার ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে উপজেলায় দুটিতে। এখানে হাত বাড়ালেই মাদক পাওয়া যায়। প্রতি ১ কি.মি. রাস্তায় ২-৩টি করে মাদকের স্পট রয়েছে। মাদকাসক্তের কারণে এলাকার আইনশৃংখলা, পারিবারিক কলহ, খুনের ঘটনা বেড়ে চলছে বলে আশংকা প্রকাশ করছেন সচেতন মহল।

প্রায় প্রতিদিনই দোহার এবং নবাবগঞ্জ থানায় বিভিন্ন রকম মাদক দ্রব্যসহ ধরা পড়ছে মাদক ব্যবসায়ীরা। চলতি সপ্তাহেই মাত্র একদিনের ব্যবধ্যানে গত ৩০ মার্চ বৃহস্পতিবার রাতে ১৫০ পিস ইয়াবাসহ দোহার থানার এস আই সুরুজ্জামানের হাতে ধরা পড়ে দুইজন । পরদিন ৩১ মার্চ শুক্রবার রাতে নবাবগঞ্জ থানার এস আই মহির উদ্দিন ৫০০ পিস ইয়াবাসহ আটক করেন একজনকে। এর আগে ২০১৬ সালের মে মাসে দোহার উপজেলার নারিশা থেকে ৮ হাজার পিস ইয়াবাসহ দুইজনকে আটক করে দোহার থানা পুলিশ। বিভিন্ন স্থানে মাদক ব্যবস্যাকে কেন্দ্র করে প্রায়ই ঘটছে মারামারি এমনকি খুনের মতো ঘটনা।

পরিসংখ্যান বলছে মাদক ব্যবস্যাকে কেন্দ্র করে নবাগঞ্জের চেয়ে দোহারে খুনের সংখ্যা বেশি। সম্প্রতি চলতি বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার রাত ৮টায় দোহার উপজেলার কুসুমহাটি ইউনিয়নের বাবুডাঙ্গী এলাকায় মিন্টু শেখ (২৩) নামে এক ব্যক্তি খুন হয়েছেন। যার নেপথ্যে রয়েছে মাদক ব্যবসা। এ ঘটনায় পুলিশ একজনকে আটক করে আইনি ব্যবস্থা নিয়েছে। মাদক ব্যবস্যা নিয়ে খুনের ঘটনা এটিই প্রথম নয়। এর আগেও ঘটেছে মাদক ব্যবস্যাকে কেন্দ্র করে ঘটেছে বেশ কয়েকটি খুনের ঘটনা। ২০১৬ সালের ১৮ আগস্ট বৃহস্পতিবার সকালে দোহার উপজেলার নারিশা ইউনিয়নের রুইতা গ্রাম থেকে মো. সেলিম (২৬) নামে এক যুবকের লাশ উদ্ধার করে দোহার থানা পুলিশ। পুলিশ জানায় এ হত্যাকন্ডের পেছনেও ছিল মাদক ব্যবস্যা। ২০১৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার রাতে নবাবগঞ্জ উপজেলার বক্তারনগর গ্রামে দুর্বৃত্তদের ধারালো অস্ত্রের কোপে ইয়ারন বেগম (৩৫) নামে এক নারী নিহত হন । আহত হন তার স্বামী মোতা (৪৫) ও নাতনি রিয়া আক্তার (৮) ।  আহত অবস্থায় ইয়ারনকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তবরত চিকিত্সক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। নবাবগঞ্জ থানা পুলিশ জানায় এ ঘটনার পেছনে রয়েছে  মাদক সেবন ও বেচাকেনায় বাধা দেয়া। এত গেল খুনের ঘটনা। এছাড়াও প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে মাদক ব্যবস্যাকে কেন্দ্র করে মারামারি, ইভটিজিং, পারিবারিক কলহের মতো নানা ঘটনা।

অন্য খবর  নবাবগঞ্জ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮৬ ব্যাচের পুনর্মিলনী

মদ, গাজা, আফিম, ঝাটকি, ফেন্সিডিল, হেরোইন, ইয়াবা সহ নেশার সকল প্রকার মাদকই পাওয়া যায় এখন দোহার নবাবগঞ্জের বিভিন্ন স্পটে। এক সময় ফেন্সিডিল,হেরোইনের চাহিদা থাকলেও বর্তমানে ইয়াবা সেবনের সংখায়ই সবচেয়ে বেশি।

গত এক মাসের অনুসন্ধানে জানা গেছে দোহার নবাগঞ্জে সাধারণত পাওয়া যায় তিন ধরনের ইয়াবা। প্রথম ধরনের ইয়াবা ট্যাবলেটের বেশির ভাগ সবুজ বা গোলাপি রঙের হয়। এর ঘ্রাণ অনেকটা বিস্কুটের মত হয়ে থাকে। দ্বিতীয় ধরনর ইয়াবা ট্যাবলেট এর দাম তুলনামূলকভাবে কম। কিন্তু এটিও নেশাসৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে। তৃতীয় ধরনের ট্যাবলেটি আরও সস্তা এবং নেশায় আষক্তদের নিকট এটি ভেজাল বলে পরিচিত। ইয়াবা সেবনকারীদের মধ্যে প্রচলিত ধারণা অনুসারে, চিতা নামের পিলটি সবচেয়ে নিম্নমানের ইয়াবা ট্যাবলেট হিসেবে গণ্য হয়। এর গায়ে ক্ষুদ্র চিহ্ন থাকে। অন্যদিকে গোলাপ জল নামের ইয়াবা পিলকে উচ্চ মানের ট্যাবলেট হিসেবে গণ্য করা হয়। ইয়াবা ট্যাবলেটের গায়ে ইংরেজি ডাব্লিউ ওয়াই (WY) লেখা থাকে। ওয়াই (Y) লেখার ধরন দীর্ঘ হলে এবং ইয়াবার রঙ পুরোপুরি গোলাপি হলে ধারণা করা হয় সেটি ইয়াবা হিসেবে ভাল মানের।

নবাবগঞ্জের বাসিন্দা চলচ্চিত্র অভিনেতা জামিলুর রহমান শাখা বলেন, এক সময় ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদক সেবন উচ্চবিত্তের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল কিন্তু এখন তা সবার হাতের নাগালে। এ কারণে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত যুবকদের মধ্যেও মাদকের বিস্তার ঘটছে। দোহার-নবাবগঞ্জে গাঁজা, ইয়াবা, ফেনসিডিল, বাংলামদসহ নেশাজাতীয় দ্রব্য ব্যবহার করে আসক্ত হয়ে পড়ছে তরুণ সমাজ। মাদকের ছোবল থেকে শিশু, কিশোর, তরুণ, যুবক, বৃদ্ধ কেউ বাদ যাচ্ছে না।

দোহার-নবাবগঞ্জ মাদকে ছড়াছড়ি হলেও এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অনেকটাই হিমশিম খেতে হচ্ছে প্রশাসনকে। নবাবগঞ্জ উপজেলা সদরের আশপাশের তিনটি গ্রামের প্রায় শতাধিক যুবক ও ছাত্র মাদকাসক্ত হয়ে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে এমন অভিযোগ স্থানীয়দের। এর মধ্যে ১০-১৫ জন মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে রাস্তায় রাস্তায়  ঘুরছে। দোহার-নবাবগঞ্জের পুরুষ অধিবাসীদের শতকরা প্রায় ৮০ জন প্রবাসী। ছেলে-মেয়েদের উঠতি বয়সে মা বাবার শাসন থেকে তারা মুক্ত। ছেলে-মেয়েরা তাদের সহজ-সরল মাকে স্কুল-কলেজের বেতন কিংবা পোশাক-প্রসাধনী কেনার কথা বলে টাকা হাতিয়ে নিয়ে নেশাখোর বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় মেতে উঠছে। ফলে নিজের অজান্তেই মাদকের বিষাক্ত থাবায় নিজেকে সঁপে দিচ্ছে ।

অনুসন্ধানী সূত্রে জানা যায়, দোহার-নবাবগঞ্জ উপজেলায় মাদকের প্রধান স্পট প্রায় ৬০টি। এদের মাঝে ভাসমান স্পটের সংখ্যাই প্রায় দুই শতাধিক। এসব জায়গায় হাত বাড়ালেই ইয়াবা, গাঁজা, হেরোইন, ফেনসিডিল, বাংলা মদ পাওয়া যায়। জানা গেছে মোটরসাইকেল, রিকশা এমনকি চলন্ত বাস এবং ইজিবাইকে ও মাদকের বেচাকেনা হয়ে থাকে। কিছু স্থানে মাদক ব্যবসার পিছনে জড়িত আছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অনেক কর্মী। যাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে গড়ে উঠছে মাদকের নিরাপদ আখড়া।

অন্য খবর  বান্দুরায় দুই ইয়াবা ব্যবসায়ী আটক

দোহারের জয়পাড়ার বেগম আয়েশা পাইলটের শিক্ষক মাহামুদুল হাসান সুমন বলেন, মাদকের ভয়াবহতায় ছেলে-মেয়েদের স্কুল-কলেজে পাঠাতেও ভয় হচ্ছে। মাদক প্রতিরোধে প্রশাসনকে আরো সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।

গোপন সূত্রে জানা গেছে, ভারতীয় সীমান্ত থেকে পাচার হয়ে বাংলাদেশের ভেতরে যেসব মাদক রাজধানী ঢাকায় প্রবেশ করে এসব ট্রলারঘাট তারই নিরাপদ রুট। দোহার উপজেলার মুকসেদপুর ট্রলারঘাট, নারিশা ট্রলারঘাট, মৈনট ট্রলারঘাট, বাহ্রা ট্রলারঘাট দিয়ে দোহারে মাদকের বড় বড় সব চালান প্রবেশ করে । এর পর তা ডিলারদের মাধ্যমে এসব মাদক ছড়িয়ে যায় সারা দোহার নবাবগঞ্জে ।

সূত্র আরো জানায়, দোহার উপজেলার মেঘুলা বাজার, জয়পাড়া বাজারের ভূতের গলি, বাহ্রা ঘাট, মৈনট আবাসন প্রকল্প, দক্ষিণ শিমুলিয়া,কাচারীঘাট, রাইপাড়া, খালপাড়, বৌ-বাজার, লটাখোলা বিলের পাড়,বাঁশতলা, জামালচর, নিকড়া, রসূলপুর, অরঙ্গবাদসহ বিভিন্ন স্থানে চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মাদক সরবরাহ ও বিক্রি করে থাকে।

অপরদিকে নবাবগঞ্জ উপজেলার শোল্লা ইউনিয়নের সাবেক এক জনপ্রতিনিধি বলেন, এখানকার রুপার চর গ্রামকে মাদকের শহর বলা হয়ে থাকে। কাশিয়াখালী বেড়িবাঁধ এলাকা, বারুয়াখালী, নবগ্রাম,আলালপুর,খানেপুর, পুরাতন বান্দুরা, নতুন বান্দুরা, গালিমপুর, চুড়াইন, আগলা, কৈলাইল, বলমন্তচর, আলগীরচর, আজিজপুর, মাদকের কেনা-বেচা অন্যতম স্পট। কারো কারো কছে এসব এলাকা মাদকের হাট নামেও পরিচিতি রয়েছে বলে জানা যায়।

দোহার উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহমান আকন্দ জানান, প্রশাসনের একার পক্ষে মাদক নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। অভিবাবকদেরকে আরো সচতেন হতে হবে। লক্ষ রাখতে হবে তাদের সন্তান কার সাথে মিশছে।

প্রায়ই বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় দেখা যায় দোহার নবাবগঞ্জে ভ্রাম্যমাণ আদালতে মাদক ব্যবসায়ীদের নানা মেয়াদে সাঁজা দিতে। কিছু মাদক কারবারিকে নিয়মিত মামলায় আদালতে পাঠায় পুলিশ। এর প্রায় কয়েক মাস পরে জেল খেটে এসেই শুরু করে পুরনো সেই মাদক ব্যবসা।

মাদক ব্যবসায়ীদের অল্পদিনের মধ্যেই বের হয়ে আসার কারন হিসেবে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এডভোকেট আবদুল্লাহ আবু সাইদ বলেন, আইনের অনেক ফাঁক ফোঁকর দিয়ে এরা সহজেই বের হয়ে আসে। ফলে প্রশাসনের পক্ষে এদের শাস্তি দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।

এ বিষয়ে দোহার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সিরাজুল ইসলাম শেখ জানান, মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত আছে। কোন মাদক ব্যবসায়ীকে ছাড় দেওয়া হবেনা।

নবাবগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোস্তফা কামাল নিউজ থার্টিনাইনকে বলেন, মাদকের সঙ্গে কোনো আপস নেই। পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণে আছে। অন্য যে কোন সময়ের চেয়ে বর্তমানে নবাবগঞ্জের পরিস্থিতি অনেক ভাল।

আপনার মতামত দিন