বৈশাখের আকাশে ফুটন্ত সূর্য, রোদ্দুরে তপ্ত প্রকৃতি, হঠাৎ হঠাৎ মৃদু গরম হাওয়া। করোনার থাবায় ভয়ার্ত দোহার উপজেলা লকডাউনের খপ্পরে। জনমানুষ শূন্য পথঘাট। জনজীবনে শঙ্কা-উৎকণ্ঠা থাকলেও প্রকৃতি চলছে তার আপন মহিমায়। তাই তো লকডাউনের মধ্যেও দোহার উপজেলা সেজেছে কৃষ্ণচূড়া ফুলের রূপে।
ফুলে-মুকুলে সেজেছে তার চিরচেনা রূপে। করোনার মধ্যেই প্রায় দূষণহীন দোহারের আনাচে-কানাচে উঁকি মারছে গ্রীষ্মের নানা রঙের ফুল। এ ঋতুতে কখনো কালবৈশাখীর রুদ্র তাণ্ডব আবার কখনো রোদের খড়তাপ। একই সঙ্গে গাছগাছালিতে নানা জাতের পাখিদের কিচিরমিচিরও প্রকৃতিতে প্রাণ ফেরার কথাই জানান দিচ্ছে।
এমন রুক্ষ গ্রীষ্মে প্রকৃতি সাজছে বাহারি ফুলে। যে ফুল কেড়ে নেয় দোহার উপজেলাবাসীর মন। গাছে গাছে ফুটেছে রক্তিম লাল কৃষ্ণচূড়া। এবার করোনার মন খারাপ সময়ে নীরবে সৌন্দর্য বিলাচ্ছে কৃষ্ণচূড়া। ঝলমলে রঙের খেলা আর কখনো কখনো বাতাসে সোঁদা গন্ধে আপন ছন্দ তুলে ধরেছে প্রকৃতি। দোহার উপজেলার রাস্তা গুলো যেনো সেজেছে কৃষ্ণচূড়া ফুল দিয়ে।
এখন দোহার উপজেলার প্রায় এলাকার অলিগলিতে ও রাস্তায় এই গাছের দেখা মিলছে। তবে দোহারের প্রাণকেন্দ্র জয়পাড়া বাজার এলাকায় কৃষ্ণচূড়ার লাল আগুন চোখে পড়ে। কৃষ্ণচূড়ার এই মায়াবী আহ্বান পথচারী সব বয়সের মানুষের হৃদয়কে আন্দোলিত করে। কেননা- দুঃখ, যন্ত্রণা, বঞ্চনা, হতাশা ও সংশয়ে ভরা আমাদের যাপিত জীবনে ফুল ও বৃক্ষ আনন্দ আর প্রেমের এক অফুরান উৎস।
কৃষ্ণচূড়া ফুলের বর্ণ-বৈচিত্র লক্ষণীয়। গাঢ় লাল, লাল, কমলা, হলুদ এবং হালকা হলুদের এক দীর্ঘ বর্ণালীতে বিস্তৃত এর পাপড়ির রঙ। প্রথম ফোটার উচ্ছ্বাস আস্তে আস্তে স্তিমিত হয়ে আসলেও বর্ষার শেষ পর্যন্ত কৃষ্ণচূড়ার গাছ থেকে ফুলের রেশ হারিয়ে যায় না। শুধু ফুল নয়, পাতার ঐশ্বর্যেও কৃষ্ণচূড়া অনন্য। এই পাতার সবুজ রঙ এবং সূক্ষ্ম আকৃতি অতিশয় আকর্ষণীয়।
গ্রীষ্মের খেয়ালি হাওয়ায় নম্র, নমনীয় পাতাদের নৃত্য বড়ই দৃষ্টি শোভন। কৃষ্ণচূড়ার কচি ফলেরা পাতার মতোই সবুজ। তাই পাতার ভিড়ে সহজে তাদের দেখা যায় না। শীতের হাওয়ায় পাতা ঝরে গেলেই ফল চোখে পড়ে। পাকা ফল গাঢ় ধূসর। পাতাহীন কৃষ্ণচূড়ার শাখায় তখন ফল ছাড়া আর কিছুই থাকে না। বসন্তে আবার কৃষ্ণচূড়ার দিন ফেরে। একে একে ফিরে আসে পাতার সবুজ, প্রস্ফুটনের বহুবর্ণের দীপ্তি নিঃশব্দে ঝরে পড়ে বির্বণ ফলেরা। কৃষ্ণচূড়া ফিরে পায় তার দৃষ্টি নন্দন শোভা।
গ্রীষ্মের তাপদাহে ক্লান্ত নয়নে প্রশান্তির বার্তাবাহক এই কৃষ্ণচূড়া। উঁচু আসনে লাল- বসনে রানির বেশধারী কৃষ্ণচূড়া প্রকৃতির মাঝে এক অনন্য মাত্রা যোগ করে যেন। ডালে ডালে চোখ- ধাঁধানো রঙের ঔজ্জল্য ছড়ায় রক্তলাল কৃষ্ণচূড়া। দীর্ঘ, প্রসারিত গাছে ফুলের প্রাচুর্য লাল হয়ে ওঠে আকাশে-বাতাসে। এ যেন লাল রঙের এক মায়াবী ক্যানভাস, যে কারো চোখে এনে দেয় শিল্পের দ্যোতনা।
বাঙালির কবিতা, সাহিত্য, গান ও বিভিন্ন স্থানে কৃষ্ণচূড়া ফুলের কথা নানা ভঙ্গিমায় উঠে এসেছে। কবি শামসুর রহমান লিখেছেন, ‘আবার ফুটেছে দ্যাখো কৃষ্ণচূড়া থরে থরে শহরের পথে/কেমন নিবিড় হয়ে। কখনো মিছিলো কখনো বা/একা হেঁটে যেতে যেতে মনে হয়- ফুল নয়, ওরা/শহীদের ঝলকিত রক্তের বুদবুদ, স্থৃতিগন্ধে ভরপুর।’
কৃষ্ণচূড়া এক ধরনের বৃক্ষ জাতীয় উদ্ভিদ, যার ইংরেজি নাম ফ্লেম ট্রি (Flame Tree) এবং বৈজ্ঞানিক নাম ডেলোনিক্স রেজিয়া (Delonix Regia)। এই গাছ চমৎকার পত্র-পল্লব এবং আগুনলাল কৃষ্ণচূড়া ফুলের জন্য প্রসিদ্ধ। এটি ফাবাসিয়ি পরিবারের অন্তর্গত একটি বৃক্ষ।
আমাদের দেশে সাধারণত বসন্তের শেষের দিকে এ ফুল ফোটে। কৃষ্ণচূড়ার ফুল ফোটার আগে কলি দেখতে মোহরের মতো দেখায়, তাই হিন্দিতে এই ফুলকে বলা হয় গুলমোহর। ‘ফুটুক না কৃষ্ণচূড়া, ছুঁয়ে দিক মন, জেগে উঠুক ভালোবাসার বন্ধন’।