রাজধানী ঢাকা থেকে দোহার উপজেলায় আসতে সময় লাগে মাত্র দুই থেকে আড়াই ঘন্টা। এখানকার বেশিরভাগ মানুষ প্রবাসী। বিধায় প্রায় প্রতিটি পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা মোটামুটি সচ্ছল। দোহার পৌরসভার জয়পাড়ায় আধুনিক বিপণি বিতান আর সরকারি-বেসরকারি অফিসের গমগমে ভীড়। বেসরকারি চিকিৎসা সেবার বাজারটি বেশ বড় এখানে। জয়পাড়া ব্রিজের ঢাল থেকে শুরু করে থানার মোড় পর্যন্ত একটু পরপরই চোখে পড়ে নানা রকম নামের বেসরকারি দাঁতের চিকিৎসালয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, তাদের বেশির ভাগেরই সেবার মান নিম্মমানের। অনিয়মও আছে অনেক। উপজেলা স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের হিসাব বলছে, দোহারে দাঁতের চিকিৎসালয় আছে মোট ১৫টি, এর ১০টিই আবার দোহার পৌর এলাকায় অবস্থিত। দাঁতের চিকিৎসালয়গুলো আকারে ছোট, দেখতে অনেকটা চিকিৎসকদের চেম্বারের মতো। একজন নিবন্ধিত দন্ত চিকিৎসক স্থানীয় সরকারের কাছ থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে চিকিৎসালয় খুলতে পারেন।
সারা বিশ্বের নানান দেশে,মানুষের পছন্দের তালিকায় প্রথমে থাকা এই পেশায় ব্যাচেলর ডিগ্রীর নাম হল, বিডিএস বা BDS (Bachelor of Dental Surgery)। এছাড়াও বিশ্বে, ডক্টর অব ডেন্টাল সার্জারী,ডক্টর অব মেডিসিন (ডেন্টাল) ইত্যাদি নামে স্বীকৃত ডিগ্রী রয়েছে। বিডিএস পাশের পর এই ডাক্তারদের সাধারনত “Dentist” বলা হয়। যেমনভাবে, হার্টের চিকিৎসকদের Cardiologist, কিডনি,মূত্রাশয় চিকিৎসকদের Urologist,চোখের চিকিৎসকদের Opthlmologist ইত্যাদি বলা হয়।
দেশের একমাত্র ডেন্টাল কলেজ “ঢাকা ডেন্টাল কলেজ” আর বাকী আটটি সরকারী মেডিকেল কলেজে “ডেন্টাল ইউনিট” এর মাধ্যমে সরকারীভাবে এটি পড়ানো হয়। এছাড়াও বেসরকারী আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ডেন্টাল কলেজ রয়েছে এবং কিছু বেসরকারী মেডিকেলের সাথে ডেন্টাল ইউনিট রয়েছে। মেডিকেলের বেসিক সব সাব্জেক্টে এর সাথে ডেন্টাল এর কিছু বেসিক সাবজেক্ট মিলিয়ে এই বিদ্যা পড়ানো হয়। চার বছরের কোর্সের সাথে এক বছরের ইন্টার্নশীপ রয়েছে। এসব বিদ্যা শেষ করেই অর্জন করতে হয় ডাক্তারি সার্টিফিকেট। “এমবিবিএস” অথবা “বিডিএস’’ সার্টিফিকেট অর্জনের পরই তিনি নিজেকে চিকিৎসক বা ডাক্তার বলে পরিচয় দিতে পারেন না।
এবার দোহারে আসা যাক, পৌরসভার কর কার্যালয়ের তালিকার তথ্য মিলিয়ে দেখা যায়, পৌর এলাকায় অন্তত তিনটি চেম্বার ট্রেড লাইসেন্স ছাড়াই চলছে। গত ৩ দিনের অনুসন্ধান শেষে জয়পাড়ার আটটি দন্ত চিকিৎসালয় ঘুরে দেখা যায়, বেশির ভাগ চেম্বারে সেবা দিচ্ছেন ডেন্টাল টেকনোলজিষ্টরা। চিকিৎসালয় গুলোতে দেখা মেলেনি ‘বিডিএস’ ডিগ্রীধারী কোন চিকিৎসকের। অনেক চেম্বার ঘুপচি, সাজ সরঞ্জাম ও ঘরদোরও তাদের নোংরা। এমনই চিত্র ধরা পড়ল নিউজ ৩৯ এর ক্যামেরায় জয়পাড়া রতন স্বাধীনতা ভাস্কর্যের পাশে অবস্থিত “ঢাকা ডেন্টাল কেয়ার-২” নামে একটি চিকিৎসালয়ে। সেখানে গিয়ে দেখা মিলল “খালিদ হোসেন” নামে একলোকের এসময় তিনি এক শিশুর দাঁতের চিকিৎসা করছিলেন। তাৎক্ষণিকভাবে ছবি তোলায় তেরে আসেন সাংবাদিকদের দিকে। পরিচয় জানতে চাওয়া হলে তিনি নিজেকে ‘ডাক্তার’ বলেই পরিচয় দিলেন। কিন্তু তিনি বিডিএস ডিগ্রীধারী কিনা তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমার বিডিএস সার্টিফিকেট নেই। আমি ডিপ্লোমা কোর্স করেছি। তাই আমরা কিছু কিছু কাজ করতে পারি”। তিনি আরো বলেন, তাদের ১ম শাখা অর্থাৎ ‘ঢাকা ডেন্টাল কেয়ার-১’ এ বিডিএস ডাক্তার আছেন। তার কথা মতো জয়পাড়া হাই স্কুলের বিপরীতে অবস্থিত “ঢাকা ডেন্টাল কেয়ার-১” এ গিয়ে দেখা গেল নাহিদ উদ্দিন এবং মো. মাহফুজ নামে দুইজন লোকের। তারা সেখানে বসে আছেন। বিডিএস ডাক্তার আছেন কি না? জানতে চাইলে মাহফুজ সাহেব নাহিদকে দেখিয়ে বলেন, উনি বিডিএস ডাক্তার। কিন্তু নাহিদকে প্রশ্ন করা হলে তিনি অস্বীকার করে বলেন, “আমি বিডিএস ডাক্তার নই, সপ্তাহে দুদিন ঢাকা থেকে বিডিএস ডাক্তার আসেন। তারাই রোগী দেখেন। আমরা শুধু হালকা কিছু কাজ করি। যেমন দাঁত তোলা, স্কেলিং করা ইত্যাদি”।
অপরদিকে জয়পাড়া মুক্তিযোদ্ধা মার্কেটের নিচ তলায় অবস্থিত “সবুজ ডেন্টাল কেয়ার” নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠানে গিয়েও দেখা মিলল, সেখানে নেই কোন চিকিৎসক। বসে আছেন অনুপ দাস নামে এক ব্যক্তি। আপনাদের এখানে বিডিএস ডিগ্রীর চিকিৎসক সেবা দেন কিনা? জানতে চাইলে তিনি প্রতিবেদককে বলেন, “আমাদের এই শাখায় কোন বিডিএস ডাক্তার নেই। কিন্ত অন্য শাখায় আছেন। আর এসব জেনে আপনি কি করবেন? লেখালেখি করেও কোন লাভ নেই। এতে আমাদের কিছুই হবে না”। তার কথামতো তাদের অন্য শাখা উপজেলা মার্কেটের দো’তলায় গেলে সেখানেও পাওয়া যায়নি কোন বিডিএস ডিগ্রীধারী চিকিৎসক। সেখানকার দায়িত্বে থাকা শেখর রায় নামে একজন জানালেন “তিনি একজন ডেন্টিষ্ট, ডিপ্লোমা কোর্স করেছেন। কিন্তু তিনি বিডিএস ডিগ্রীর নন”। তিনি আরো জানান, সপ্তাহে দুদিন ঢাকা থেকে বিডিএস চিকিৎসক আসেন তারাই রোগীদের চিকিৎসা করেন। আর তিনি শুধু দাঁত স্কেলিং করেন”।
জয়পাড়া মুক্তিযোদ্ধা মার্কেটের পাশেই দেখা মিলল আরেকটি চিকিৎসালয় নাম “মুক্তা ডেন্টাল কেয়ার-২”। দেখা গেল সেখান থেকে সেবা নিয়ে বেড়িয়ে যাচ্ছেন ৩ জন মধ্য বয়সী রোগী। সেখানে ঢুকে পাওয়া গেল নেপাল রায় নামে একজনকে। বিডিএস চিকিৎসক আছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি তাদের ১ম শাখায় যেতে বলেন। তার কথা মতো উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স রোডে অবস্থিত “মুক্তা ডেন্টাল কেয়ার-১” এ গিয়ে দেখা যায় ঘুপচি একটি ঘরে দাঁতের চিকিৎসার দুটি চেয়ার বসানো। রোগী চেয়ারে বসার পর শুধু চিকিৎসকের দাঁড়ানোর জায়গাটুকু থাকে। চেম্বারটির মালিক গোপাল চন্দ্র রায় নিজে দাঁতের চিকিৎসক নন। বিডিএস চিকিৎসক আছেন কিনা জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, “উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ‘দাঁতের সার্জন’ রফিক উদ্দিন এখানে রোগী দেখেন”। তার দেখাদেখি গোপাল নিজেও এখন দাঁত তোলেন এবং দাঁত ও মাড়ির ময়লা পরিষ্কার (স্কেলিং) করেন।
জয়পাড়া ব্রিজের ঢালে অবস্থিত আরেকটি প্রতিষ্ঠান নাম “জয়পাড়া দন্ত চিকিৎসালয়” সাইন বোর্ডে লেখা আছে “ভিতরে ডাক্তার বসেন। মুখের যাবতীয় চিকিৎসা অভিজ্ঞ ডাক্তার দ্বারা করা হয়”। কিন্তু ভিতরে গিয়ে পাওয়া গেল না কোন ডাক্তারের। দেখা গেল মো. বরকত আলী (রিমন) নামে একজন লোক বসে আছেন। ডাক্তার আছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি নিজেকে ডাক্তার বলে পরিচয় দেন। বিডিএস ডিগ্রীর চিকিৎসক কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমি বিডিএস ডাক্তার না। কিন্তু ডিপ্লোমা কোর্স করেছি। বিডিএস ডাক্তার প্রতি মঙ্গলবার বসেন। আর বাকি ৬ দিন আমিই রোগী দেখি”। ডাক্তার না হয়েও কিভাবে সপ্তাহে ছয় দিন তিনি রোগী দেখেন? এ প্রশ্ন করা হলে এর কোন সদোউত্তর দিতে পারেননি তিনি।
বাকী চেম্বারগুলোর মধ্যে মাত্র একটির মালিক ও চিকিৎসক যথাযথভাবে নিবন্ধিত। তিনটি চেম্বারের স্থায়ী কোন চিকিৎসক নেই তাদের ওখানে ঢাকা থেকে চিকিৎসক আসেন। বাকিগুলোতে চিকিৎসকের কাজ করছেন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট বা চিকিৎসা সহায়তাকর্মীরা। চারটিতে চিকিৎসক মালিকেরা নিজেরাই চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন। লাইসেন্স না থাকার দায়ে গত বছরের ২৯ আগস্ট উপজেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত আলিফ ডেন্টালকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করেন। অননুমোদিত চিকিৎসকের হাতে খারাপ সেবার প্রদানের দায়ে একই দিন সবুজ ডেন্টাল কেয়ারকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছিল। দাঁতের চিকিৎসালয়গুলোতে প্রায়ই ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়।
এ বিষয়ে নরসিংদী জেলার মনোহরদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ডেন্টাল সার্জন ডা. যুবরাজ আহমেদ শামীম বলেন, ‘এমবিবিএস অথবা বিডিএস ডিগ্রী ছাড়া কেউ নিজেকে ডাক্তার বলে পরিচয় দিতে পারবেন না। যদি তা করে থাকেন তাহলে তারা রোগীদের সাথে প্রতারণা করছেন।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে দোহার উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. জসিম উদ্দিন নিউজ ৩৯ কে বলেন, যাচাই-বাছাই করে অতিশিঘ্রই এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এ বিষয়ে দোহার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কে.এম. আল-আমীন নিউজ ৩৯ কে বলেন, এর আগে ভূয়া ডেন্টালের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করা হয়েছিল। শিঘ্রই তাদের বিরুদ্ধে আবারও আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।