(এই প্রবন্ধটি লিখেছেন দোহারের কৃতি সন্তান বাংলাদেশ মেরিন একাডেমির ৪৭ তম ব্যাচের এক্স ক্যাডেট, আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ। আজকের লিখাটি সেসব তরুণদের জন্য যারা জীবনকে খুঁজে পেতে চায় বিভিন্ন রঙে, বর্ণে, গন্ধ ও স্বাদে। যারা নির্দিষ্ট পেশা মানেই জীবন বা সফলতা মনে করে না।)
সম্প্রতি মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর পরিচিত অনেকের ছোট ভাই-বোনের চান্স পাওয়ার আনন্দের সংবাদ পেয়েছি। আবার অনলাইন এবং অফলাইনে দেখেছি অনেককে মেরিট পজিশন আর মেডিক্যাল কলেজের নাম দিয়ে অভিনন্দন জানাতে। বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য সরকারি উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্টের পরও একইরকমভাবে অভিনন্দন জানানো হবে পরিচিত কৃতকার্যদেরকে।
সমস্যা হলো শুধুমাত্র ইঞ্জিনিয়ারিং বা মেডিক্যালে পড়ানোর জন্য আমাদের দেশের অভিভাবকদের প্রচন্ড আগ্রহ এবং শিক্ষার্থীদের মনে স্কুলের শুরু থেকেই এই বদ্ধমূল ধারণা জন্মায় যে, টপ পজিশনের ছাত্র-ছাত্রী মানেই ভবিষ্যৎ ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার। যেজন্য সরকারি মেডিক্যাল বা ইঞ্জিনিয়ারিং প্রতিষ্ঠানে মোট সীটের তুলনায় পরীক্ষার্থী থাকে অতিরিক্ত বেশি, অনেকসময় দেখা যায় একটা সীটের জন্য ২০০ জনেরও বেশি পরীক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে।
আমাদের পরিচিত কেউ যখন তথাকথিত ভালো বা সরকারি প্রতিষ্ঠানে চান্স পেতে ব্যর্থ হয় তখন সেই ছেলে বা মেয়ে মানসিকভাবে প্রচন্ড ভেঙ্গে পড়ে। এমতাবস্থায় বেশিরভাগ ফ্যামিলি মেম্বার এবং নিকটাত্মীয়রা তাদেরকে মানসিক সাপোর্ট দিতে ব্যর্থ হন। উপরন্তু কার পরিচিত কে কোথায় চান্স পেলো সেসব বলে ‘মরার উপর খাঁড়ার ঘা’ এর মতো ওদের মনকে আরও বিষিয়ে তুলে-যা অনুচিত।
তবে পরীক্ষার্থীদের মনে রাখা উচিত যে, মেডিক্যাল কলেজ বা ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স না পাওয়া মানেই জীবনের সব শেষ না। স্কুল কলেজে ভালোভাবে পড়াশোনা করে প্রত্যাশা অনুযায়ী ফলাফল না হলে মন খারাপ হওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু সেই খারাপ লাগাটা দীর্ঘস্থায়ী করা যাবেনা। এটা একটা ভুল ধারণা যে বুয়েট-মেডিক্যালে আমার হয়নি- তো আমার জীবন শেষ। তোমাদের জীবন তো মাত্র শুরু, এখনো তোমাদের পাড়ি দিতে হবে বহুদূর, বহু বন্ধুর পথ।
আমি ২০০৮ সালে এসএসসি পাশ করেছি। আমাদের ব্যাচ বা সমসাময়িক ব্যাচগুলোতে যারা ছিল তারা সবাই এখন বেশ প্রতিষ্ঠিত, সবাই নিজেকে এবং পরিবারকে সাপোর্ট দিচ্ছে। এদের কেউ চাকরিজীবী, কেউ ব্যবসায়ী, কেউ ডাক্তার, কেউ শিক্ষক, কেউ উদ্যোক্তা, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ ডিরেক্টর, কেউ পুলিশ, কেউ লেখক, কেউ আইনজীবী, কেউ ব্যাংকার, কেউ ফটোগ্রাফার, কেউ ফিল্মমেকার ইত্যাদি বিভিন্ন পজিশনে বিভিন্ন জায়গায় আছে। অর্থাৎ ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ারিং ছাড়াও আরও অসংখ্য ক্ষেত্র আছে জীবনে কিছু করার, প্রতিষ্ঠিত হবার। আমার স্কুল-কলেজের ব্যাচমেটদের মধ্যে ডাক্তার আছে সর্বসাকুল্যে ১০%, ইঞ্জিনিয়ারও একইরকম পার্সেন্টেজের হবে। এই ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার বাদে বাকি যে ৯০% আছে তাদের জীবন কি শেষ হয়ে গেছে? তারা কি রিমার্কেবল কিছুই করছেনা জীবনে? অবশ্যই বাকিদের মাঝে অনেকেই অনেক ভালো পজিশনে, সম্মানিত পজিশনে আছে। তাহলে মেডিক্যাল বা ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স না পেয়ে হতাশ কেন হচ্ছো? ডিফারেন্ট কিছু করার, আউট অব দ্যা বক্স কেন চিন্তা করছোনা?
আমি মেরিন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গ্যাস ট্যাংকার কোম্পানিতে চাকরি করছি। আমাদের পেশাকে সবাই একটু ভিন্নধর্মী, ব্যতিক্রমী হিসেবেই জানে৷ মেরিনারদেরকে মাসের পর মাস সমুদ্রে ভেসে বেড়াতে হয়। একদেশ থেকে আরেক দেশের বন্দরে, এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে, এক মহাসমুদ্র থেকে আরেক মহাসমুদ্রে আমাদের বিচরণ। আমার এন্টার্কটিকা বাদে বাকি ৬ মহাদেশের মাটিতে পা নামানোর সৌভাগ্য হয়েছে। ২০১৩ সালে ক্যারিয়ার শুরু করে এখনো পর্যন্ত ত্রিশটিরও বেশি দেশে যাবার সুযোগ হয়েছে। সেসবের মধ্যে আমেরিকা, ইউকে, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিলসহ আরও অনেক দেশই অল্পস্বল্প দেখার সুযোগ পেয়েছি। মেরিনার হওয়ার জন্য আমি কাউকে নিজ থেকে উৎসাহিত করিনা, আবার কেউ আগ্রহ প্রকাশ করলে অনুৎসাহিতও করিনা। অন্যান্য সকল পেশার মতো এ পেশাতেও বিভিন্ন সুবিধা-অসুবিধা আছে। তাই যারা আগ্রহী তাদেরকে সাজেস্ট করি ভালোভাবে আমাদের প্রফেশনাল ধাপগুলো, চাকরির বাজারের পরিসংখ্যান ইত্যাদি জেনে তারপর সিদ্ধান্ত নিতে। ইন্টারনেটের কল্যাণে যেকোন তথ্যই এখন খুব সহজে পাওয়া যায়, তাই কারো কথায় বিভ্রান্ত না হয়ে-সঠিক তথ্য জেনে এরপর সিদ্ধান্ত নাও।
মনে রেখো, বর্তমানে যে ডাক্তার দিনে ৫০/৭০/১০০ জন করে রোগী দেখছেন। উনি কিন্তু ক্যারিয়ারের শুরুতেই এমন সংখ্যক রোগী পাননি৷ বছরের পর বছর সময় এবং শ্রম দেয়ার পরেই উনি আজকে মাসে লাখ লাখ টাকা পাচ্ছেন৷ উনিও ইন্টার্নিশিপ শেষ করার পরে হয়তো অনেকদিন কোথাও চাকরি পাননি। একসময় হয়তো উনি ১৫/২০ হাজার টাকার চাকরি করতেন, ‘খ্যাপ’ মারতেন বিভিন্ন হাসপাতালে, সপ্তাহে ৩/৪ দিন নাইট ডিউটি করতেন। অর্থাৎ দীর্ঘসময় ধরে এত স্ট্রাগল করার পরেই বর্তমানের সুদিন উপভোগ করছেন। একইভাবে আজকে যিনি একজন ব্যাংকের ম্যানেজার, আলাদা রুমে এসিতে বসে থাকেন-উনি একসময় যথেষ্ট স্ট্রাগল করেছেন, ক্যাশ সামলিয়েছেন, ক্লায়েন্ট হ্যান্ডেল করেছেন, নতুন একাউন্ট করানোর জন্য পরিচিতদের অনুরোধ করেছেন। এরপর বর্তমান অবস্থানে এসেছেন, গাড়িতে করে অফিসে আসছেন।
আমাদের মেরিনারদের জীবনেও সেইম অবস্থা। শুরুতে জব পাবার জন্য স্ট্রাগল করতে হয়, দীর্ঘ অপেক্ষার পর হয়তো ১৫০-২০০ ডলারের মাসিক বেতনে ইন্টার্নিশিপ। এরপর বছরের পর বছর নানাবিধ পরীক্ষা, কোর্স করে তারপর মাসে ৮-১০ হাজার ডলার পাবার সুযোগ হয়। মেরিনার হিসেবে সবচেয়ে বড় সুবিধা যদি বলি তাহলে সেটা হলো, হালালভাবে বেশ ভালো এমাউন্টের বেতন পাওয়া (অবশ্যই স্ট্রাগলের পর)। আর সবচেয়ে কষ্টের ব্যাপার হলো, পরিবার ছেড়ে ৪/৬/৯ মাস দূরে থাকা এবং কোন প্রিয়জনের বিয়োগে হুট করেই দেশে ফেরার সুযোগ না থাকা।
প্রতিটি পেশা, প্রতিটি সেক্টরেই এই সুবিধা-অসুবিধার কম্বিনেশন আছে। তাই কোন পেশার ট্রেন মিস করলে মন খারাপ বা হতাশ না হয়ে অন্য গন্তব্যের ট্রেন ধরার আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। এরপর ফলাফলের জন্য সবসময় সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর নির্ভর করতে হবে। আল্লাহ আমাদের সকলের জীবনকে সহজ করে দিন, তোমাদের সকলের জন্য শুভকামনা রইলো।
– আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ
এক্স ক্যাডেট, বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি, চট্টগ্রাম (৪৭ তম ব্যাচ)