বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে মৎস শিকারের জন্য নতুন এক ধরণের জালের ব্যবহার ক্রমেই বাড়ছে, যা নিষিদ্ধ কারেন্ট জালের মত মিহি ও হালকা, এবং এই জাল একবারে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে মাছ ধরতে সক্ষম। জেলেদের অনেকে এই জাল ব্যবহার করে খুশী। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিয়ে বলছেন যে এ জাল মাছসহ জলজ জীববৈচিত্র্যের জন্য কারেন্ট জালের চাইতেও ক্ষতিকর। নতুন এই জালের পরিচিতি চায়না দুয়ারী নামে।
শুরুর দিকে মূলত পদ্মা নদীর তীর ধরে এই জালের ব্যবহার হলেও এখন সারা দেশেই, বিশেষত বড় নদীর ধারে, চায়না দুয়ারী জাল ব্যাপক ভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ঢাকার দোহার, নবাবগঞ্জ; মানিকগঞ্জের হরিরামপুর, মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলায় ব্যাপক ভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে এই জাল।
চায়না দুয়ারী জাল কী?
এটিকে জাল হিসেবে বর্ণনা করা হলেও মৎস বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে চায়না দুয়ারী মূলত মাছ ধরার এক ধরণের ফাঁদ। এই জালের বুননে একটি গিঁঠ থেকে আরেকটি গিঁঠের দূরত্ব খুব কম, যে কারণে এতে মাছ একবার ঢুকলে আর বের হতে পারে না। একে চায়না জাল, ম্যাজিক জাল এবং ঢলুক জাল নামেও ডাকা হয়।
রাজশাহী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা অলক কুমার সাহা জানিয়েছেন, বাংলাদেশে মাছ ধরার জালের ‘মেস-সাইজ’ অর্থাৎ জালে একেকটি গিঁঠের দূরত্বের অনুমোদিত পরিমাপ উল্লেখ আছে এবং এই মাপটি সাড়ে চার সেন্টিমিটার। জালের ‘মেস-সাইজ’ এর চেয়ে কম হলে, সেটি দেশের আইন অনুযায়ী নিষিদ্ধ। “এই কারণে বাংলাদেশে কারেন্ট জাল নিষিদ্ধ, ঠিক একই কারণে চায়না দুয়ারীও নিষিদ্ধ,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন এই মৎস কর্মকর্তা।
তবে এক্ষেত্রে একটি ফাঁক থেকে যাচ্ছে। মি. সাহা নিশ্চিত করেছেন যে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ জালের তালিকায় চায়না দুয়ারীর উল্লেখ নাই, যদিও আইনের ব্যাখ্যা অনুযায়ী এটি নিষিদ্ধ। “সেই সুযোগটিই অনেক জেলে নিচ্ছেন।”
নাম চায়না দুয়ারী বলা হলেও এই জাল উৎপাদিত হয় বাংলাদেশেই। তবে জালের সুতা সূক্ষ্ম আর মিহি বলে অনেকের ধারণা এ সুতা চীন থেকে আমদানি করা হয়। জালের দুই মাথা খোলা বলে একে দুয়ারী বলা হয়।
কেমন দেখতে চায়না দুয়ারী জাল?
মান এবং দৈর্ঘ্য ভেদে চায়না দুয়ারীর আকার নির্ধারিত হয়। সাধারণত ৫০ থেকে ১০০ ফুট পর্যন্ত দীর্ঘ হতে পারে এই জাল। প্রস্থ হবে এক থেকে দেড় ফুট, আর এর গিঁঠ হবে খুবই ক্ষুদ্র। লোহার চারকোনা রড দিয়ে অনেকগুলো ফ্রেম বানানো হয় জালের মধ্যে দেয়ার জন্য, এবং প্রয়োজন অনুসারে জালের দৈর্ঘ্য অনুযায়ী রডের ফ্রেমের সংখ্যা নির্ধারিত হয়। এটি নদীর একেবারে তলদেশ পর্যন্ত যায় এবং তলদেশের মাটির সাথে মিশে থাকে। ফলে কোন মাছ একবার জালে ঢুকলে আর বের হতে পারে না। আর এই জাল এত সূক্ষ্ম যে ছোট ছোট জাতের মাছ, এমনকি মাছের ডিমও অনেক সময় উঠে আসে। দৈর্ঘ্য এবং মান অনুযায়ী একটি চায়না দুয়ারীর দাম সাড়ে তিন হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত হতে পারে বলে জেলে ও মৎস বিভাগের কর্মকর্তাদের সূত্রে জানা গেছে।
কারেন্ট জালের সাথে পার্থক্য কী?
রাজশাহী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মি. সাহা বলেছেন, চায়না দুয়ারীর জালের কারণে নদীতে মাছের বিচরণ কঠিন হয়ে গেছে। আর সেক্ষেত্রে কারেন্ট জালের চাইতেও বিপজ্জনক চায়না দুয়ারী। দুইটি জালের মধ্যে সাদৃশ্য যেমন আছে, তেমনই কিছু পার্থক্যও আছে। যেমন, কারেন্ট জাল নদীর মাঝখানে আড়াআড়ি পাতা হয়। কিন্তু চায়না দুয়ারী নদীর কম গভীর অংশে পাতা হয়। দুইটি জালই হালকা ও মিহি বুননের হলেও চায়না দুয়ারী ছোট ফাঁসবিশিষ্ট, যা কপাটের মত কাজ করে। এতে মাছসহ যেকোন জলজ প্রাণী একবার ঢুকে পড়লে জালের মুখ বন্ধ হয়ে যায়।
কেন জেলেদের মধ্যে জনপ্রিয়?
রাজবাড়ী জেলার গোয়ালন্দ উপজেলার একজন জেলের সঙ্গে চায়না দুয়ারী জাল সম্পর্কে কথা হয় বিবিসি বাংলার। তিনি জানালেন যে জেলেদের মধ্যেই চায়না দুয়ারী জাল বেশ জনপ্রিয় এবং কারেন্ট জালকে সরকারিভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার পর এই জালের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন ওই এলাকার অনেক জেলে।
“এক রাতে এই জালে যে পরিমাণ মাছ উঠে তা অন্য কোন জালে উঠে না, সেই তুলনায় পরিশ্রম তেমন করতে হয় না,” চায়না দুয়ারী ব্যবহারের কারণ সম্পর্কে বলছিলেন এই জেলে। “সেই তুলনায় পরিশ্রম তেমন করতে হয় না। আর নদীর গভীরেও বেশি যেতে হয় না। এর চেয়ে সুবিধা আর কিছুতে নাই।” কিন্তু বাজারে প্রচলিত অনেক জালের তুলনায় এই জালের দাম বেশি, তাই এখনও অনেক জেলেই আবার চায়না দুয়ারী জাল ব্যবহার করছেন না। তবে গোয়ালন্দের এই জেলে জানাচ্ছেন যে নিষিদ্ধ জেনেও সেখানকার জেলে সম্প্রদায়ের বেশিরভাগই এই জাল কিনতে চায়।
তিনি অবশ্য দাবি করেন, এ জালে ধরা পড়া অনেক মাছই তারা বিক্রি করার আগেই নদীতে ছেড়ে দেন। তবে তিনি এও স্বীকার করেন যে ছেড়ে দেয়া ওইসব মাছ সব সময় বাঁচে না।
কেন বিপজ্জনক এই জাল?
যেহেতু এই জালে একবার ধরা পড়লে আর বের হতে পারে না, তাই অনেক বিপন্ন প্রজাতির মাছ ও জলজ প্রাণী মারা পড়ে। সেগুলো আর ওইসব প্রাণীর বংশ বৃদ্ধিতে কোন ভূমিকা রাখতে পারে না। বিশেষজ্ঞরা বলেন, এই কারণে জলজ জীববৈচিত্র্য নষ্ট হবার আশঙ্কা রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎসবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক বিজয়া পাল বলেন, যে প্রক্রিয়ায় চায়না দুয়ারী দিয়ে মাছ ধরা হয়, তার কারণে অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত দুই ধরণের ক্ষতিই হয়। বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, নদীতে চায়না দুয়ারী জাল একবার পাতা হলে তাতে মাছ, মাছের বাচ্চা বা পোনা, এবং এমনকি মাছের ডিমও উঠে আসে। আবার যত মাছ ধরা পড়ে তার সবই ‘টার্গেটেড’ মাছ নয়। বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “বাজারে চাহিদা নেই, এমন অনেক মাছ ধরা পড়ে। সেগুলো জেলেরা ফেলে দেয়, কিন্তু সেগুলো বেশিরভাগ সময় আর বাঁচে না। “এর মানে হচ্ছে, এই মাছগুলো আর বংশবৃদ্ধি করতে পারলো না। এর মধ্যে হয়তো অনেক মাছ আছে, যা বিপন্ন প্রজাতির।”
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে গত কয়েক দশকে ১০০’র বেশি দেশি প্রজাতির মাছ বাজার থেকে ‘প্রায় নেই’ হয়ে গেছে।
বাংলাদেশে মৎস্য সুরক্ষা ও সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী, উন্মুক্ত জলাশয়ে জন্মানো প্রতিটি মাছকে একবার ডিম ছাড়া ও বাচ্চা ফুটানোর সুযোগ দিতে হবে। তার আগে মাছের পোনা ধরা আইনত দণ্ডনীয় একটি অপরাধ।
মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তা অলক সাহা জানান যে বিভিন্ন সময় জেলেদের এই জাল ব্যবহারের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সচেতন করা হয়, তবে তা সত্ত্বেও অনেকেই নিয়ম মানতে চায় না। দেশের বিভিন্ন জায়গায় ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে মাঝেমধ্যে কারেন্ট জালের সাথে চায়না দুয়ারী জাল আটক করে ধ্বংস করা হলেও এর ব্যবহার দিনে দিনে বেড়েই চলছে।