‘খেলারাম দাতা-র কোঠা’ ও ‘আন্ধারকোঠা’ নামে পরিচিত প্রাচীন স্থাপনাটি ও দীঘি ঘিরে ছড়িয়ে আছে খেলারাম দাতা’র কিংবদন্তি। এই দালানটি কলাকোপার অস্তিত্বে থাকা সবচে’ পুরোনো দালান-কোঠা। ২০১৪ সালে এটি সংস্কার করা হয়। সেই সময় এটা যে উপকরণ দিয়ে বানানো হয়েছিল সেই চুন-সুরকি দিয়ে আনুমানিক আদি রুপ ফিরিয়ে আনা হয়েছে। বলা হয়ে থাকে এর একটি তলা মাটিতে দেবে গিয়েছে, সেখানে এখন আর যাওয়া যায় না। খেলারামকে ঘিরে বেশ কয়েকটি কিংবদন্তি এলাকাবাসীর মধ্যে প্রচলিত আছে।
খেলারাম সমন্ধে ঐতিহাসিক তথ্য তেমন পাওয়া যায় না। ইতিহাস বইগুলোতেও তেমন কিছু লেখা নেই। যা কিছু আছে এলাকাবাসীর মৌখিক কিংবদন্তিতে। নবাবগঞ্জের শিশুরা খেলারামের গল্প শুনতে শুনতে বড় হয়।
অনেক বছর আগে একটা জাতীয় পত্রিকার শিশু-কিশোর পাতায় খেলারাম নিয়ে একটা নিবন্ধ ছাপা হয়েছিল। আর বিটিভিতে এক অনুষ্ঠানে এটি ফিচার করা হয়েছিল, সেখান থেকে বেশ কিছু তথ্য পেয়েছি। বিটিভির তথ্য ও কিংবদন্তি অনুসারে খেলারাম জলদস্যু ছিলেন। তার মাতৃভক্তি অতি প্রসিদ্ধ।
খেলারাম সারাজীবন ডাকাতি করে প্রচুর সম্পদ অর্জন করলেও এক সময় তার মধ্যে অনুতাপ সৃষ্টি হয়। ডাকাতি ত্যাগ করে বাড়িতে স্থায়ী হন। এবং পাপ মোচন করতে প্রচুর দান খয়রাত শুরু করেন। এজন্য তার নামের সাথে “দাতা” শব্দটি স্থায়ী ভাবে লেগে যায়। ইদানিং কেও কেও তাকে “খেলারাম দাদা” বলেন, এটি ভুল সম্ভোধন। দাতা বিকৃত হয়ে দাদায় পরিণত হয়েছে। তার প্রকৃত সারনেম জানা যায় না। কেও কেও ‘দত্ত’র সাথে দাতার মিল দেখে মনে করেন তার সারনেম দত্ত ছিল। যেহেতু ‘দাতা’ উপাধির ব্যাক্ষা পাওয়া যায় তাই ‘দত্ত থিওরি’ গ্রহণযোগ্য মনে হয় নি। যদি সারনেম দত্ত হয়েও থাকে তবুও দত্ত থেকে দাতা হয় নি, দানের কারণে দাতা হয়েছে। অর্থাৎ ‘দাতা’ থেকে আমরা ‘দত্ত’-এ যেতে পারছি না।
বিটিভির তথ্য অনুযায়ী তিনি ব্যবসায় করতে মালয় সাগর পর্যন্ত যেতেন, এবং পর্তুগিজদের সাথে মিলে জলদস্যুতা করতেন। স্থানীয় জনশ্রুতিতে তিনি কোথায় জলদস্যুতা করতেন তা বলা না হলেও জীবনের একটা পর্যায় পর্যন্ত দস্যুতার ব্যাপারে একমত। তার জাহাজ ইছামতিতেও আসত। বাড়ী থেকে নদী পর্যন্ত একটা সুরঙ্গ ছিল যেটি দিয়ে তিনি তার জাহাজে যাতায়াত করতেন বলে প্রচলিত আছে। সেই সময় কোনো বাঙালি সাগরে জাহাজ ভাসিয়েছেন বিষয়টাই রোমাঞ্চকর।
কয়েকটি পত্রিকা লিখেছে প্রাসাদটি উনবিংশ শতকে তৈরী করা হয়েছে। আর বিটিভি বলেছে সপ্তদশ শতকের কথা, সেই হিসেবে চারশত বছরের পুরোনো। বিটিভির মত অধিক গ্রহণযোগ্য। উনবিংশ শতকে তৈরি করা দালান কলাকোপায় এখনও বেশ ভালভাবেই টিকে আছে। আর এটি দেখলেই বোঝা যায় আরও অনেক আগের। দেড়শত বছর আগের হলে ইতিহাসে খেলারাম দাতার বিবরণ থাকত আর কিংবদন্তিগুলো কিংবদন্তি না হয়ে মানুষের চোখে দেখা ঘটনা হত।
খেলারাম দাতার পিতার সমন্ধে কোনো বিবরণ আমরা পাই না। তার জীবন কাহিনীতে মায়ের অবস্থান পুরোটা জুড়ে। কিংবদন্তিগুলো বয়ে চলেছে তাকে, তার মা আর দীঘিটাকে ঘিরে। খেলারাম দাতা’র কিংবদন্তি যা প্রচলিত আছে-
১. এক রাতে মাটির নিচ থেকে উঠেছে: প্রচলিত আছে দালানটি এক রাতে মাটির নিচ থেকে উঠে এসেছে। এই কিংবদন্তিটা বাংলাদেশে খুব জনপ্রিয়, দেশে বিভিন্ন এলাকায় একই রকম কিংবদন্তি প্রচলিত আছে প্রাচীন কোনো দালানের ব্যাপারে। মাত্র ৫ কিলোমিটার পশ্চিমে বান্দুরার ভাঙা মসজিদ সমন্ধে একই কথা প্রচলিত ছিল।
২. বাসন-দেয়া দীঘি: আন্ধারকোঠার সামনেই বড় একটা দীঘি আছে। এই দিঘীর পাড়ে এসে কেও থালা বাসন চাইলে পানির নিচ থেকে উঠে আসত। ব্যবহারের পর ফেরত দিতে হত। কেও একজন ফেরত না দেয়ায় তারপর থেকে আর বাসন-কোসন আসা বন্ধ হয়ে যায়। এরকম বাসন-দেয়া পুকুরের কিংবদন্তি দেশের আরও এলাকায় প্রচলিত আছে।
৩. সোনার নাও পবনে চলে: এটা খেলারামের সোনার নৌকা ছিল যা পবনে চলে। আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে স্বর্ণ নির্মিত কোনো নৌকা বাতাসের উপর চলে। বাস্তবে হতে পারে এমন নৌকা যার গায়ে স্বর্ণ খচিত নকশা ছিল বা কোনো একটা অংশে স্বর্ণের প্রলেপ ছিল। খেলারামের মত ধনী ব্যক্তির জন্য যা থাকা স্বাভাবিক। আর পবনে চলা মানে পাল তোলা নৌকা। পালতোলা নৌকা কেও দীঘি বা পুকুরে ব্যবহার করে না। কিন্তু সমুদ্রযাত্রী খেলারাম সমুদ্রের রিজেম্বল হিসেবে পাল তোলা নৌকা তার দীঘিতে ভাসিয়ে থাকতেই পারেন।
৪. দুধের চৌবাচ্চা: খেলারামের মা চেয়েছিলেন দুধের চৌবাচ্চায় সাতরে দুধ খেতে। মাকে খুশি করতে খেলারাম সেটি তৈরি করেছিলেন। ভবনের টিকে থাকা অংশে চৌবাচ্চাটি আমি খুঁঁজেছি, পাই নি। হয়তো আলাদা কোনো ইমারত হতে পারে সেটি। দোতলায় একটা ছোট ঘরে ছোট একটা হাউজের মত আছে যেটিকে সেই চৌবাচ্চা মনে করা হয়, কিন্তু সেটিতে সাতরানো সম্ভব না।
৫. সুড়ঙ্গ: সুড়ঙ্গের কথা আগে বলেছি। যেটি খেলারামের বাড়ি থেকে ইছামতির পাড় পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। খেলারাম ডাকাতি করে এসে ওই সুড়ঙ্গ দিয়ে প্রাসাদে প্রবেশ করতেন। যেটি শত শত বছরে বন্যায় ও ভূমিকম্পে ভরাট হয়ে বা ধ্বসে গিয়েছে। কোথায় কোন যায়গার নিচ দিয়ে গিয়েছে তার কোনো নিদর্শন এখন আর নেই, আশে শুধু বিশ্বাসে।
৬. খেলারামের মৃত্যু: একদিন খেলারাম মা’কে বলে, “মা, স্নান করতে যাই।” মা উত্তর দিয়েছিলেন, “যা।” তারপর খেলারাম দীঘিতে গিয়ে ডুব দিল আর উঠল না। সেই থেকে কলাকোপার মায়েরা সন্তানকে কখনও “যা” বলে না।
৭. স্বপ্নের গুপ্তধন: জলদস্যুর গুপ্তধনের কিংবদন্তি থাকবে না তা কি করে হয়! আগে থেকেই প্রচলিত ছিল যে এই প্রাসাদে গুপ্তধন আছে। বহু লোক বহু অনুসন্ধান করেছে, কেও পায় নি। খেলারামের কোনো এক বংশধর স্বপ্নে সেই গুপ্তধনের সন্ধান পায়। তারপর এক রাতে এসে তুলে নিয়ে যায়। এটা অবশ্য আধুনিক কালের ঘটনা।
বাস্তবে যা-ই ঘটুক না কেন নবাবগঞ্জে খেলারাম দাতা এক রহস্যময় পুরুষ যার গল্প বয়ে চলেছে যুগ-যুগান্ত ধরে।
