কুলসুম বেগম শ্রেষ্ঠ জয়িতা রত্নগর্ভা মা নির্বাচিত

285
কুলসুম বেগম

ঢাকা দোহার উপজেলার নারিশা ইউনিয়নের মালিকান্দা গ্রামের কুলসুম বেগমের জীবনের গল্পটা অন্যদের থেকে একটু আলাদা। একজন নারী হয়ে সমাজ সচেতনতা ও সন্তানদের লেখাপড়ার প্রতি তিনি ছিলেন সচেতন। সাংসারিক কাজের পাশাপাশি সন্তানদের লেখাপড়া শিখিয়ে করেছেন সুশিক্ষিত। তাই স্বীকৃতি মিলেছে রত্নগর্ভা মায়ের। তার জন্ম ঢাকার দোহার উপজেলার মালিকান্দা গ্রামের সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারে। পরিবারের সিদ্ধান্তে কিশোরী ১৪ বছর বয়সে বিয়ে হয় তার। বিয়ের কারণে সংসারের হাল ধরতে বন্ধ হয়ে যায় তার লেখাপড়া। শিক্ষা ছাড়া মুক্তি নাই-এ কথা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করেন তিনি। সেজন্যই সন্তানদের লেখাপড়ার জন্য রীতিমতো সংগ্রাম করেছেন তিনি।

তার স্বামী দোহার উপজেলার সুতারপাড়া এলাকার আইয়ুব আলী চৌকদার। তারা গৃহস্থ পরিবার। জমিজমা, ফসল এসব নিয়ে থাকতে হয় বারো মাস। কিশোরী কুলসুম বেগমকেও সব সামলাতে হয়। ঘরসংসারের পাশাপাশি সন্তানদের লেখাপড়ার কথাও ভাবতেন তিনি। তার স্বামী সন্তানদের কৃষিকাজ করতে বলতেন আর কুলসুম ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠাতে চাইতেন। এ নিয়েও সংসারে অশান্তি চলতো।

এ বিষয়ে কুলসুম বেগম বলেন, যে গ্রামে আমার  বিয়ে হয় সেসময় সেখানে কোনো মসজিদ, মাদ্রাসা ও স্কুল ছিল না। সেসময় আমি ভাবতাম যে কি ভাবে  সন্তানদের মানুষ করব। একপর্যায়ে নিজের গহনা বিক্রি করে মালিকান্দা এলাকায় জমি কিনে বাড়ি করে বসবাস শুরু করি। সন্তানদের ভর্তি করিয়ে দিই বাড়ির কাছের স্কুলে। বাড়িতে কৃষাণ কৃষাণী আর পরিবারের সদস্যদের জন্য প্রতিদিন ১০ কেজি চালের ভাত রান্না করেছি। মানুষের কষ্ট সহ্য করতে পারি না, যেসময় শুনেছি কারও ঘরে খাবার নেই সেসময় আমি খাবারের ব্যবস্থা করে দিয়েছি। আবার টাকার জন্য লেখাপড়া করতে পারছেন না তাদেরকেও আমি সহযোগিতা করেছি। নিজের সন্তানদের মতো এলাকার শিশুদেরও দেখার চেষ্টা করেছি। ঘর গৃহস্থালির কাজ সামলিয়ে এলাকার শিশুদের কথাও চিন্তা বাবনা করেছি। সে জন্য বিনা পয়সায় বাড়িতে মক্তবে কুরআন শিক্ষার ব্যবস্থা করেছি। এলাকার শিশুদের স্কুলে পাঠানোর জন্য তাগিদ দিয়েছি। যাতে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত না হয় কেউ।

অন্য খবর  সাধ্যের সবটুকু দিয়ে দোহার-নবাবগঞ্জকে সাজাতে চাই: সালমান এফ রহমান

ওই সময়ে পুঁথি পাঠের প্রচলন ছিল। তাই কুলসুম বেগম পুঁথি পাঠে পারদর্শী ছিলেন। সন্ধ্যার পর বাড়ির উঠোনে পুঁথি পাঠের আসর বসাতেন। গাজী কালু চম্পাবতী, বিষাদ সিন্ধু ও রঙিন রূপবানের মতো জনপ্রিয় সব কাহিনি পড়ে শুনিয়ে মানুষকে আনন্দ দিতেন। পুঁথি পাঠে শ্রোতা ছিলেন এলাকার নারী-পুরুষেরা।

বড় ছেলে আবুল বাশার ঢাকার তেজগাঁও পলিটেকনিক্যালে সুযোগ পায়। কৃষিকাজের ব্যাঘাত ঘটবে বলে তার স্বামী ছেলেকে ভর্তি করাবে না। কিন্তু মায়ের (কুলসুম বেগম) প্রবল আগ্রহ ছেলেকে কলেজে ভর্তি করাবে। অবশেষে নিজের জমানো টাকা-পয়সা ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে কুলসুম বেগম ছেলেকে ভর্তি করান। গোপনে ছেলের জন্য চাল সরিয়ে রেখে হোস্টেলে পাঠাতেন। সেখান থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে চাকরি হয় আবুল বাশারের। পরে নতুন চাকরি নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে চলে যান। এভাবে ৭ সন্তানকে সুশিক্ষিত করে গড়ে তুলেছেন কুলসুম বেগম। সন্তানদের মধ্যে বড় ছেলে আবুল বাশার সিভিল ইঞ্জিনিয়ার (অবসরপ্রাপ্ত), বাবুল চৌকদার ব্যবসায়ী, আব্দুল আওলাদ হোসাইন এমদাদ আলী উচ্চবিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক, এমারত হোসেন পদ্মা সরকারি কলেজের সহযোগী অধ্যাপক, কবিরুল বাশার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও ছোট ছেলে শিমুল বাশার ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের চিফ রিপোর্টার হিসাবে কর্মরত এবং একমাত্র মেয়ে কহিনুর বেগম স্বামী-সংসার নিয়ে সুখেই দিন কাটাচ্ছেন। সংগ্রামী এ নারী কুলসুম বেগমের হাতে ১ ফেব্রুয়ারি মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর ও বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয় ঢাকা বিভাগের শ্রেষ্ঠ জয়িতা রত্নগর্ভা মা (সফল জননী) হিসাবে ক্রেস্ট ও সম্মাননা তুলে দেওয়া হয়। ২০১৯ সালেও কুলসুম বেগম ঢাকার দোহার উপজেলার শ্রেষ্ঠ জয়িতা রত্নগর্ভা মা নির্বাচিত হন।

আপনার মতামত দিন