দোহার নবাবগঞ্জের স্কুল কলেজে পর্ণগ্রাফির ছড়াছড়ি

1791

দোহারের একটি অতি পরিচিত স্কুলের নবম শ্রেনীর ছাত্র সাব্বির(ছদ্মনাম)। গত বার্ষিক পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করার পর প্রবাসী বাবা ছেলেকে পুরস্কার হিসেবে কি দেবেন, তা জানতে চেয়েছিলেন। উত্তরে ছেলে বলেছিল, একটা মাল্টিমিডিয়া মোবাইল ফোনের কথা।

বাবা প্রথমে দিতে রাজি হননি। এত কম বয়সের ছেলেকে মোবাইল ফোন দিবেন, তাও আবার দামি ফোন- তার বিবেক সম্মতি দিচ্ছিল না। কিন্তু ছেলে বোঝালো, তার বন্ধুদেরও মোবাইল ফোন আছে। তাদের বাবা মা দিয়েছেন। আর এখন তো ছেলে-বুড়ো সবার কাছেই ফোন থাকে। সবারই দরকার হয়।

বাবা ছেলের সাথে তর্কে জড়ালেন না। অগত্যা ১৮ হাজার টাকা মুল্যের একটা দামি মোবাইল সেট বিদেশ থেকে পাঠিয়ে দিলেন।

মেমোরি কার্ড, ব্লু টুথ, এমপি থ্রি, এমপি ফোর, ব্রাউজার কি নেই তাতে। সাব্বির খুশি হয়ে যায়। পরদিন বন্ধুর বাসায় গিয়ে কম্পিউটার থেকে আট গিগা মেমোরি কার্ডের পুরোটাই পর্নো ভিডিওতে পূর্ণ করে নিয়ে আসে। রাতভোর ঘরের দরজা লাগিয়ে কানে হেডফোন দিয়ে বাসায় দেখে। নতুন ভিডিও সংগ্রহের জন্য ক্লাসে বন্ধুদের তাগাদা দেয়। ক্রমেই পর্নোগ্রাফির প্রতি আকর্ষন আসক্তিতে রূপ নেয়।

ক্লাসরুমের পেছনে, খেলার মাঠে বসে বন্ধুরা একসাথে দেখে। মজা পায়, পুলকিত হয়।

একদিন টিফিনের সময় ক্লাসরুমে কয়েকজন বন্ধু মিলে নতুন আনা এক দেশী পর্ণোভিডিও দেখছিল। শিক্ষক ক্লাস নিতে আসলেও তারা খেয়াল করেনি। মাথা নিচু করে দেখতে থাকায় স্যারের সন্দেহ হলে হাতে নাতে ধরা পড়ে সাব্বির ও তার পাঁচ বন্ধু। শিক্ষকের নিকট তীব্র ভৎসনার শিকার হলেও তাতে তাদের কিছু যায় আসেনি। এরপর প্রধান শিক্ষকের নিকট পাঠানো হয় তাদের, শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে মোবাইল ফোনটি জব্দ করেন।

একইসাথে, বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের মোবাইল ফোন ব্যাবহারে সতর্ক করা হয়।কিন্তু তার পরেরদিনও শিক্ষার্থীদের সার্চ করে মোবাইল ফোনে পাওয়া যায় মেমোরিকার্ডে, যার প্রতিটিতে ছিল দেশি-বিদেশি পর্নোভিডিও’র ভাণ্ডার।

উপরের ঘটনাটি কল্পিত নয়, সত্য। এটি একটি নমুনা মাত্র, দেশের অধিকাংশ স্কুল পড়ুয়াদের মাঝে এই ধরনের প্রবণতা দেখা যায়। কম বয়সে বিস্তারিত জানাকে তারা এ্যাডভেনটেজ মনে করে। ক্লসে যে যতো বেশি জানবে, আড্ডাতে সে অধিক জনপ্রিয়। বড় থেকে ছোট, ক্রমে ক্রমে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে আজ সর্বত্র।

আর যে হারে দোহার নবাবগঞ্জে চাইনিজ রেস্টুরেন্ট ও মোবাইল সার্ভিসিং সেন্টার গড়ে উঠেছে সে ক্ষেত্রে দোহার নবাবগঞ্জে এর হার ৯০ শতাংশের উপরে বলে অভিমত মোবাইল সার্ভিসিং সেন্টার গুলোর মালিকদের। কেননা প্রবাসী অধ্যুষিত এলাকা হওয়ায় দামী মোবাইল ও ইন্টারনেট ব্যবহারের হার অনেক বেশি।

জয়পাড়া কলেজ মার্কেটে অবস্থিত একটি সাইবার ক্যাফেতে দেখা গেলো স্কুল শুরুর আগে ও ছুটির পরে স্কুল ছাত্রদের আনাগোনা। তারা চলে যাওয়ার পর কম্পিউটার হিস্টোরি থেকে দেখা গেলো তারা পর্ণ সাইটগুলোতে পরিদর্শন করেছে নতুবা কোন সিনেমার আইটেম গান ডাউনলদ করেছে। এর মাঝে আবার সেলেব্রেটি সাইটগুলোতে তাদের প্রবেশের হার বেশি।

অন্য খবর  দোহারে ডাকাতি প্রস্তুতিকালে ৪ ডাকাত আটক

বর্তমানে আরেকটি হুজুগে এরকমই এক বিব্রতকর পরিস্থিতি পার করলেন লাক্স-সুন্দরী বিদ্যা সিনহা মিম। অনলাইনের অশ্লীল কিছু সাইট আর ব্লগে কে বা কারা যেন দুই মিনিটের নোংরা একটি বিদেশী ভিডিও ফুটেজ আপলোড করে ছড়িয়ে দিয়েছে তার নামে। এই নিয়ে এখনো চলছে তুমুল প্রপাগান্ডা। আর কোমলমতি ও অপ্রাপ্ত বয়স্কদের দেখা যাচ্ছে এই ধরনের সাইতগুলো ভিজিট করতে। বেড়ে গেছে টাকা ফেক্সি করার পরিমাণও।

ওয়েস্ট ইন্ডিজের এক ক্রিকেটারের সঙ্গে অশ্লীল এই ভিডিও ফুটেজের মেয়েটি সোনালী চুলের ইউরোপিয়ন বা আমেরিকান হলেও তাকেই বলা হচ্ছে বিদ্যা সিনহা মিম।

২০০৭ সালের লাক্স চ্যানেল আই সুপারস্টার খেতাব বিজয়ী বিদ্যা সিনহা মিম এবার তার নামে ছড়িয়ে দেওয়া অশ্লীল ভিডিও প্রসঙ্গে সোচ্চার হয়েছেন।

সাইবার ক্রাইম সম্পর্কে মিম বললেন, এটি অনেক বড় অপরাধ। সাইবার ক্রাইম একজন মানুষের জীবন বিপন্ন করে দিতে পারে। এ ধরনের কাজ মিডিয়ার সবার জন্যেই ক্ষতিকর। এমন অবস্থা হলে নতুনদের মনে ভয় নামে ভাইরাসটা বাসা বাঁধবে। আর মিডিয়ায় নতুনদের আসাটা বন্ধ হয়ে যাবে।

তিনি আরও বলেন, এটা আমাদের জন্যে খুবই লজ্জাজনক একা কারো পক্ষে এই অপরাধীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব না। সবাই মিলে যদি সোচ্চার হওয়া যায়, তাহলে সেই চক্র কিছু করার আগে অবশ্যই চিন্তা করবে। কিন্তু আফসোস আমাদের দেশের মানুষ প্রতিবাদ না করে উল্টো এ ধরনের ক্রাইমকে এনজয় করে। এ বিষয়ে কঠোর আইন দরকার। যদি সাইবার ক্রাইমে জড়িত থাকা ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হয়, তাহলেই এর প্রতিরোধ সম্ভব।

এক্ষেত্রে চীন আমাদের কাছে বড় উদাহরন হতে পারে। সেখানে পাঠ্যপুস্তকে যোগ হয়েছে যৌন শিক্ষা। কিন্তু ইন্টারনেট পর্নোগ্রাফি পুরোদমে নিয়ন্ত্রিত। যার কারনেই সেখানে শিক্ষার্থীরাও যেমন যথেষ্ট সচেতন, তেমনি সামাজিক সহিংসতাও কম।

দেশে পর্নো ভিসিডি নির্মাণ হচ্ছে, এটা পুরোনো গল্প। বিক্রি হচ্ছে, এটা ওপেন সিক্রেট। আইন করেও পর্নোগ্রাফি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু তারপরও কর্মকাণ্ডগুলো এখন অবাধে চলছে।

একজন কিশোর, যার হয়তো যৌনতা সম্পর্কে হালকা ধারণা আছে, কিন্তু এর ভিজুয়ালিটি সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। সে খুব স্বাভাবিক ভাবেই পর্নো ছবির প্রতি কৌতূহলী হবে। সঙ্গত কারনেই কোমলমতি আঠারো বছরের কম বয়সী শিশুরাই সবচেয়ে বেশি পরিমানে পর্নো ভিডিও’র প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছে। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এটাই হল বাস্তবতা। কিন্তু এর জন্য দায়ি কে? পরিবার, রাষ্ট্র, সমাজ, শিক্ষা ব্যবস্থা এবং মানসিকতা সবাই দায়ী।

অন্য খবর  নবাবগঞ্জের সাধক বলাই চাঁদ দরবেশের মৃত্যু বার্ষিকী পালন

একজন শিশু তো দূরে থাক, একজন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রকেও পরিবার থেকে যৌনতা সম্পর্কে কোন ধারনা দেয়া হয় না। রাষ্ট্রীয়ভাবে পাঠ্য পুস্তকেও যৌনতা সম্পর্কে কোন বিশেষ শিক্ষার ব্যবস্থা নেই। কেবলমাত্র উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেনীর জীববিজ্ঞানে “মানবদেহ” নামক একটি অধ্যায় রয়েছে। সেখানে, দৈহিক অঙ্গের বিবরন, বয়:সন্ধিকালের লক্ষন, করণীয় সমন্ধে ধারনা দেয়া রয়েছে। কিন্তু দু:খজনক হলেও সত্য, অধিকাংশ কলেজেই অধ্যায়টি পড়ানো হয়না। কারন, শিক্ষক-শিক্ষিকারা অধ্যায়টি পড়াতে লজ্জা বোধ করেন।

বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শুধুমাত্র মেডিকেল ও জুয়োলজি বিভাগের শিক্ষার্থীরা এ সম্পর্কে কিছু শিক্ষা লাভ করে থাকেন। অন্য বিষয়ের শিক্ষার্থীরা যৌন শিক্ষা লাভের কোন সুযোগই পান না। ফলে কেবলমাত্র বন্ধু-সহপাঠীদের মাঝেই কিশোর যুবকরা এ সম্পর্কে ধারনা লাভ করে।

কিন্তু পরিপূর্ণ শিক্ষা না হওয়ায় তার কুপ্রভাব পড়ে স্বাভাবিক জীবনে। নেশার মত আসক্ত হয়ে পড়ে পর্নো ভিডিও’র প্রতি। ফলশ্রুতিতে স্কুল পড়ুয়াদের কেউ কেউ কৌতূহলী হয়ে পতিতালয়েও যায়!

মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন তার এক জরিপে তথ্য প্রকাশ করেছে যে, রাজধানীতে ৭৭ শতাংশ কিশোর পর্নো ভিডিওতে আসক্ত। এই হার শুধু আমাদের আতঙ্কিতই করে না, সামাজিক সহিংসতা বেড়ে যাওয়া আশঙ্কা স্পষ্ট বুঝিয়ে দেয়। তাই পর্নো ভিডিও প্রতিরোধ করা এখন জরুরী হয়ে উঠেছে।

সম্প্রতি পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণে আইন পাশ হলেও যথার্থ প্রয়োগের অভাবে এর সুফল পাচ্ছে না সমাজ। পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১২ এর ধারা ৮(৩) অনুযায়ী “কোন ব্যক্তি ইন্টারনেট বা ওয়েবসাইট বা মোবাইল ফোন বা অন্য কোন ইলেকট্রনিক ডিভাইসের মাধ্যমে পর্নোগ্রাফি সরবরাহ করিলে তিনি অপরাধ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবেন এবং উক্তরূপ অপরাধের জন্য তিনি সর্বোচ্চ ৫ (পাঁচ) বৎসর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ড এবং ২,০০,০০০ (দুই লক্ষ) টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।”

মাদকের পাশাপাশি অশ্লীলতাও যদি সমাজে ভাইরাস আকারে ছড়িয়ে পড়ে, তা দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুফল বয়ে আনবে না। এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে সরকারকে। প্রয়োজনে ইন্টারনেট পর্নোগ্রাফিও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কারণ, এখন ঘরে বসেই অশ্লীল ছবি প্রদর্শন সহজলভ্য।

গরীব দেশের জন্য ক্ষুধা ও দারিদ্রতার মাঝে পর্নো আগ্রাসন এক মারাত্মক অভিশাপ। এই অভিশাপ প্রতিরোধ করতে না পারলে দেশের তরুন সমাজের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। এই অন্ধকার দূর করতে যুবকদেরই এগিয়ে আসতে হবে।

একইসাথে রাষ্ট্রকে পর্ণো আগ্রাসন রোধে শুধু সুনির্দিষ্ট নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা তৈরী করলেই হবে না পাশাপাশি ব্যপক হারে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। নতুবা অদূর ভবিষ্যতে সামাজিক অবক্ষয় তীব্র আকার ধারন করবে।

আপনার মতামত দিন