গ্রামে গ্রামে হেঁটে বেড়ান তিনি। উদ্দেশ্য শিক্ষাবঞ্চিত শিশু, প্রতিবন্ধী ও মায়েদের খুঁজে বের করা। তার পর এসব সুবিধাবঞ্চিত মানুষকে পড়ালেখা শেখান। কারো বাড়ির বারান্দা কিংবা উঠানে চাটাই, চট বা পাটি পেতে নিলেই তৈরি হয় তার স্কুল। ১৯৬৮ সালে ছাত্রজীবন থেকে নীরবে নিভৃতে এভাবেই নিজেকে বিলিয়ে চলেছেন অদম্য আলোর ফেরিওয়ালা মাধুরী বণিক (৬৩)। ব্যক্তিগত জীবনে অবিবাহিত। এলাকায় সদালাপী ও সাদা মনের মানুষ হিসেবেও পরিচিত। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী তিনি। তার কাছ থেকে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করে পাইলট, চিকিৎসক, জনপ্রতিনিধিসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন অনেকে। মা, শিশু ও প্রতিবন্ধী শিক্ষার প্রসারে তার স্কুলগুলো আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে স্বমহিমায়।
গত ১৮ মার্চ বিকাল ৫টায় ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলার পূর্ব সমসাবাদ নূর ইসলাম দবুর বাড়ির উঠানে শিক্ষা কার্যক্রম চলছিল মাধুরী বণিকের। শুরুতে কোরআন থেকে তেলাওয়াত করেন শিক্ষার্থী সোহানা। ওই স্কুলে হিন্দু (সনাতন) শিক্ষার্থী ছিলেন না। তবে গীতা থেকে পাঠ করে শিক্ষার্থী মুনিয়া ইসলাম। সে বলল, ‘মাসি (মাধুরী) আমাদের শুধু কোরআন তেলাওয়াত নয়, গীতা, বাইবেল ও ত্রিপিটক পাঠও শিখিয়েছেন। তিনি কোনো ধর্মকে ছোট না ভাবতে শিখিয়েছেন। আমরা তাই সব ধর্মকে শ্রদ্ধা করি।
এর পর শিক্ষার্থীরা জাতীয় সংগীত পরিবেশনের পর জাতীয় পতাকাকে সম্মান জানান। তার পর শপথবাক্য পাঠ করানো হয়। পরে শিশুদের পড়ালেখার আগ্রহ বাড়াতে শ্রুতিমধুর অঙ্গভঙ্গিমা করে কবিতা আবৃত্তি ও বর্ণমালা পাঠ করা হয়। শেষে শিক্ষককে শ্রদ্ধা জানিয়ে শিক্ষার্থীরা ঘরে ফেরেন। রুটিন অনুযায়ী প্রতিদিন বিকালে এখানে মাধুরী বণিকের স্কুল বসে।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গ্রামের সুবিধাবঞ্চিত নারী ও শিশুদের ফ্রি অক্ষরজ্ঞান দান করে আসছেন মাধুরী বণিক। মূলত তিন থেকে দশ বছর বয়সী শিশু, প্রতিবন্ধী ও নিরক্ষর মায়েরা তার স্কুলের শিক্ষার্থী। বর্তমানে কলাকোপা ও যন্ত্রাইল ইউনিয়নে তিনটি স্কুলে ১৯ জন প্রতিবন্ধী শিক্ষার্র্থী এবং ১৩০ জন নিরক্ষর মা ও শিশুকে শিক্ষা দান করছেন মাধুরী বণিক। শিক্ষার্থীদের আদর্শ মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করাই তার মূল উদ্দেশ্য। তার শিক্ষাপদ্ধতিও বেশ শ্রুতিমধুর। ক্লাসের শুরুতেই শেখান জাতীয় সংগীত পরিবেশন ও জাতীয় পতাকার প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং শরীরচর্চা। দেশের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, গুরুজনদের সম্মান করার শপথ তার নিত্যদিনের ক্লাসের একটি অধ্যায়। এ ছাড়া শিশুদের শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করতে বিস্কুট, চকোলেটসহ নানান পুরস্কারও দেওয়া হয়। সপ্তাহের বৃহস্পতিবার তিনি শিক্ষার্থীদের খেলাধুলা করান। এতে বিজয়ীদের বিশেষ পুরস্কার দেন নিজের টিউশনির উপার্জন থেকে।
কলাকোপা ইউনিয়নের পানালিয়া গ্রামের ‘মা’ শিক্ষার্থী মিনু আক্তার বলেন, ‘আমার পাশর্^বর্তী গ্রামেই দিদির (মাধুরী বণিকের) বাড়ি। তাকে আমি মায়ের মতো দেখি। কারণ তিনি নিজের মায়ের মতো ব্যবহার করেন। আমার ছেলে আর আমি দুজনই তার শিক্ষার্থী। ক্লাসে নিজে পড়ি, ছেলেকেও পড়াই। তার শিক্ষাপদ্ধতি আমার খুব ভালো লাগে। অল্প কদিনেই আমি নিজের নাম লিখতে শিখেছি। এখন ছেলে আর আমি দুজন ভালো ছাত্র।’
সমসাবাদ গ্রামের মুনিয়া ইসলাম বলেন, ‘দরিদ্র পরিবারের মেয়ে আমি। সেই ছোটবেলায় মায়ের কোলে করে মাধুরী মাসির স্কুলে যেতাম। এখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি। মাসির স্কুলে আসতে দেরি হলে আমিই ওদের শিক্ষক। কারণ আমি মাধুরী মাসির মতো আদর্শ পড়ালেখা শিখেছি। তার আদর্শ আমাকে অনুপ্রাণিত করে। আমি মাসিকে মায়ের মতো ভালোবাসি।’
মাধুরী বণিক ১৯৭৭ সালে দোহার নবাবগঞ্জ কলেজ থেকে ডিগ্রি পাস করেছেন। ছাত্রজীবনে তিনি কলেজ শাখা ছাত্রলীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদিকা ছিলেন। ১৯৭০ সালে তিনি নারী আন্দোলন শুরু করেন। সে সময়ে প্রতিষ্ঠা করেন নারী সংগঠন নবাবগঞ্জ উপজেলা মহিলা সংঘ। সেই থেকে আদ্যাবধি এ সংগঠনের সভাপতি তিনি।
মাধুরী জানান, মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি অস্ত্র সংরক্ষণের কাজ করেছেন। তবুও মুক্তিযোদ্ধার সনদ গ্রহণ করেননি। নিজেকে কখনো মুক্তিযোদ্ধা দাবিও করেননি। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কখনো রাষ্ট্রীয় সুবিধাও গ্রহণ করবেন না। যুদ্ধপরবর্তী সময়ে ঘূর্ণিঝড়, প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানা সামাজিক কর্মকা-ে জড়িত ছিলেন মাধুরী। এখনো ইভটিজিং ও বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ আন্দোলনে গ্রামে গ্রামে সভা করেন।
বর্তমানে মাধুরী বণিক নবাবগঞ্জ উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সহসভাপতি, মহাকবি কায়কোবাদ মুক্ত স্কাউট গ্রুপের সহসভাপতি, আনন্দধারা ললিতকলা একাডেমির উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদ নবাবগঞ্জ শাখার সহ-সভাপতি। ২০১৫ সালে সামাজিক কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ নবাবগঞ্জ উপজেলার শ্রেষ্ঠ জয়ীতা পুরস্কারে ভূষিত হন শিক্ষানুরাগী এই আলোকিত মানুষ।