মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যা বললেন ইমরান খান

728

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়েছিলর ঘুমন্ত বাঙালির ওপর। নৃশংসতা আর আক্রোশ নিয়ে খুন করেছিল অসংখ্য বাঙালিকে। এই বর্বর আক্রমণের খানিক আগেও ঢাকায় ছিলেন পাকিস্তানি ক্রিকেটার ইমরান খান। মহান মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিনগুলোতে ইমরান পশ্চিম পাকিস্তান অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে খেলতে এসেছিলেন ঢাকায়।

২০১১ সালে প্রকাশিত পাকিস্তানের সাবেক এই তারকা ক্রিকেটার ও বর্তমানের শীর্ষ রাজনীতিকের প্রকাশিত রাজনৈতিক আত্মজীবনী পাকিস্তান: দ্য পার্সোনাল হিস্ট্রি-তে উঠে এসেছে তার সে সময়ের অভিজ্ঞতার কথা। ১৯ বছর বয়সী ইমরান সে সময় লক্ষ্য করেছিলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতি বাঙালিদের ক্ষোভ ও তীব্র ঘৃণার বিষয়টি।

ইমরান লিখেছেন, ‘আমরা পূর্ব পাকিস্তান দলের বিপক্ষে খেলছিলাম। সবকিছুই সেদিন আমাদের কাছে শত্রুভাবাপন্ন মনে হচ্ছিল। শত্রুভাবাপন্ন মনে হচ্ছিল ঢাকা স্টেডিয়ামের দর্শক, এমনকি প্রতিপক্ষ পূর্ব পাকিস্তান দলের খেলোয়াড়দেরও।’

আরও অনেক পাকিস্তানির মতো তিনিও প্রায় অন্ধকারে ছিলেন, তখনকার পূর্ব পাকিস্তান কী অন্যায় আর বৈষম্যের শিকার হচ্ছিল এ ব্যাপারে। জানতেন না সে সময় পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ কী ভাবছিল। কীভাবে, কোন পরিস্থিতিতে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তান সম্পর্কে জন্ম নিয়েছিল এত ক্ষোভ।

বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক ক্রিকেটার ও পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের সফল ক্রিকেট-সংগঠক সৈয়দ আশরাফুল হক পূর্ব পাকিস্তানের সেই অনূর্ধ্ব ১৯ দলে খেলেছেন। ২৫ মার্চের কাল রাতের কয়েক দিন আগে আশরাফের কাছ থেকেই ইমরান প্রথম জানতে পেরেছিলেন এ ব্যাপারে। আশরাফ সে রাতে ইমরানকে দুই পাকিস্তান যে খুব সম্ভবত আর একসঙ্গে থাকছে না, এ ব্যাপারে ধারণা দেন। জানান, স্বাধীনতার আন্দোলন ক্রমেই শক্তিশালী হচ্ছে।

আশরাফুলের কথায় ইমরান একটা ধাক্কার মতো খেয়েছিলেন, ‘আমি চমকে উঠেছিলাম এটা শুনে। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের ভাবনা সম্পর্কে আমার কোনো ধারণাই ছিল না। এ জন্য দায়ী ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে গণমাধ্যমের ওপর সামরিক জান্তার পুরো নিয়ন্ত্রণ।’

পাকিস্তানের মানুষ এই কথাটা অনেক জায়গাতেই বলে থাকেন। গণমাধ্যমের ওপর আরোপিত সেন্সরশিপের কারণেই নাকি পূর্ব পাকিস্তানে কী ঘটছে, এ সম্পর্কে তারা কিছুই জানতেন না। পাকিস্তানের সামরিক জান্তা গণমাধ্যমে যা দেখাত, সেই সময় অন্ধের মতো পাকিস্তানিরা সেটাই বিশ্বাস করতেন। ইমরান তার বইয়েও সেটি স্বীকার করে নিয়েছেন। তার কথায় একটা বিষয় প্রমাণিত, একই রাষ্ট্রে বসবাসকারী হিসেবে পাকিস্তানের দুই অংশের মানুষের মধ্যে যে মানসিক নৈকট্য থাকার কথা ছিল, তার কিছুই ছিল না পাকিস্তান নামের সেই রাষ্ট্রে। দুই অংশের মানুষের মানসিকতার দূরত্ব ছিল আকাশ-পাতাল।

অন্য খবর  যেভাবে লেখা হলো ‘দি রিমেইন্স অব দি ডে’ : কাজুও ইশিগুরো

১৯৭১ সাল নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে অন্য সব অভিজাত পাকিস্তানিদের মতো ইমরানও মনে করেন, পশ্চিম পাকিস্তানের রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকা সেনাবাহিনী একের পর এক ভুল করেছে, আর সেই ভুলের পুরো ‘সুযোগ’ নিয়েছে ভারত। জিন্নাহর দ্বি-জাতি তত্ত্বের ওপর গড়ে ওঠা পাকিস্তান ভেঙে দুই টুকরো হওয়া নিয়েও ইমরানের লেখায় উঠে এসেছে হাহাকার। বাংলাদেশ যে এই যুদ্ধে অংশ নেওয়ার আগে নিজেকে আলাদা দেশ হিসেবে ঘোষণা করেই স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, সেটিও ইমরান এক রকম অস্বীকার করেছেন এই যুদ্ধকে ‘গৃহযুদ্ধ’ আখ্যা দিয়ে।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন ‘ভারতের দখলদারি’র কথা। তার ভাষায় পশ্চিম পাকিস্তানের ভুলের কারণে ইন্দিরা গান্ধী পূর্ব পাকিস্তানে দখলদারি চালান। মুক্তিযোদ্ধাদের ‘বাঙালি বিদ্রোহী’ হিসেবে অভিহিত করে ইমরান লিখেছেন, ‘নেহরু-কন্যা ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে থাকা ভারত পূর্ব পাকিস্তানে আক্রমণ চালায় বাঙালি বিদ্রোহীদের সহযোগিতা করতে। ১৯৬৫ সালে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে যেটা হয়নি, এবার খুব দ্রুতই পরাজয় মেনে নিতে হয়। ঢাকায় আমাদের সেনাবাহিনী অপমানজনক আত্মসমর্পনে বাধ্য হয়। ভারত ৯০ হাজার যুদ্ধবন্দী নিয়ে যায়। আমাদের দেশ ভেঙে দুটো হয়ে যায়, পূর্ব পাকিস্তান হয়ে যায় নতুন দেশ—বাংলাদেশ। তার বাবা যা পারেননি, ইন্দিরা তার চেয়েও বেশি কিছু অর্জন করেন জিন্নাহর পাকিস্তানের ধারণাটিকে ধ্বংস করার মাধ্যমে।’

ইমরানের বইয়ের এই অংশে একটি পরস্পর-বিরোধী তথ্য আছে। ১৯৭১ সালের জুনে পাকিস্তানের হয়ে তার আন্তর্জাতিক অভিষেক হয় ইংল্যান্ডে। সেই প্রথম তিনি আন্তর্জাতিক মিডিয়ার চোখে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যা সম্পর্কে প্রথম জানতে পারেন বলে লিখেছেন। আবার এও লিখেছেন, ১৯৭৪ সালে আরও একবার আশরাফুল হকের সঙ্গে তার দেখা হয়। আশরাফই তাকে জানান, গণহত্যার আসল চিত্রটি সম্পর্কে।

অন্য খবর  স্বাধীনতা পদকের জন্য খুশি নির্মলেন্দু গুণ, প্রধানমন্ত্রীকে কৃতজ্ঞতা

তবে বইয়ের এই অংশে ইমরান স্বীকার করে নিয়েছেন, সরকার নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমের ওপর থেকে পুরো বিশ্বাস তার উঠে যায়। ইমরান লিখেছেন, ‘কতজন আসলে নিহত হয়েছে এ সম্পর্কে দুই পক্ষের দেওয়া সংখ্যাই সঠিক কি না তা প্রমাণ করা কঠিন। তবে সম্ভবত কয়েক মাস ধরে চলা গৃহযুদ্ধে কয়েক লাখ সাধারণ মানুষ মারা যান, আরও কয়েক লাখ নিরাপত্তার জন্য ভারতে আশ্রয় নেন। এর আগে আমি ইংলিশ ও ভারতীয়দের সঙ্গে এ নিয়ে তর্ক করতাম, এর সবই পাকিস্তান ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে চালানো অপপ্রচার। কিন্তু হকের কাছ থেকে শোনার পর ঠিক করি, আমাদের সরকার যে অপপ্রচার চালাবে, তা বিনাবাক্যে মেনে নেব না।’

তবে ইমরানের আত্মজীবনীতে অন্যান্য পাকিস্তানিদের তুলনায় ১৯৭১-এর আসল ইতিহাস মেনে নেওয়ার ব্যাপারে বেশ উদার দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়েছে এই অংশে, ‘পাকিস্তানের বাকি সবার মতো আমিও আমাদের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের অপপ্রচার বিশ্বাস করতাম, যারা বাঙালি যোদ্ধাদের সন্ত্রাসী, জঙ্গি, বিদ্রোহী কিংবা ভারত-সমর্থিত যোদ্ধা হিসেবে আখ্যা দিত; এখন যেসব বিশেষণ ব্যবহার করা হয় পাকিস্তানের উপজাতি কিংবা বেলুচিস্তানে যারা লড়াই করছে, তাদের ব্যাপারে।’ জেনারেল নিয়াজি আর ইমরান একই বংশের। তাকেও ইমরান তার আত্মজীবনীতে আখ্যা দিয়েছেন ‘মিথ্যেবাদী’ হিসেবে।

ইমরানের আত্মজীবনীতে ১৯৭১ নিয়ে বেশ কিছু বিভ্রান্তি থাকলেও মোটের ওপর ১৯৭১ এ বাঙালিদের স্বাধিকার আন্দোলনের লড়াই, পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর নৃশংস গণহত্যা তিনি স্বীকার করে নিয়েছেন। আশ্চর্য হতে হয়, মাত্র ৪ বছর আগে প্রকাশিত সেই বইয়ের ইমরানের বক্তব্যের সঙ্গে এখনকার রাজনীতির প্রতিটা ছক কষে চলা ইমরানের বক্তব্যের পার্থক্য কী বিশাল! কদিন আগেও যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের ও আলী আহসান মুজাহিদের ফাঁসির আগমুহূর্তে দেওয়া তার বিবৃতিও বিস্ময় হয়ে এসেছে।

এক সময়ের ‘বিদ্রোহী কণ্ঠস্বর’ এই ইমরান এখন ‘আসল সত্যি’ বলার চেয়ে পাকিস্তানের মানুষের সাধারণ আবেগকে পুঁজি করে রাজনৈতিক অবস্থান শক্তপোক্ত করতেই যেন বেশি আগ্রহী। দলের নাম যিনি দিয়েছেন ‘তেহরিক-ই-ইনসাফ’, ‘ন্যায় বিচারের জন্য আন্দোলন’; সেই তিনিও যেন ধীরে ধীরে ঢুকে পড়ছেন কপট রাজনীতিবিদের খোলসে।

আপনার মতামত দিন