আমাদের দেশের থ্রিলার পাঠকরা যখন “ড্যান ব্রাউন”র বইগুলো পড়ে এবং ভালো লেগে যায়, তখন আপনা-আপনিই একটা আক্ষেপ মনের মনে আসে। “ইশ, আমাদের দেশে কোনো লেখক যদি এই রকম বিশ্বমানের মৌলিক থ্রিলার লিখতো!”
কিন্তু আমাদের আক্ষেপ করার দিন শেষ। বেশ কয়েকজন লেখক, আন্তর্জাতিক মানের থ্রিলার লিখে যাচ্ছেন কয়েকবছর ধরে। তারমধ্যে “মাশুদুল হক” একজন। আজ কথা বলবো লেখকের এমন দু’টি বই নিয়ে, যে বইগুলো পড়লে মনে হবে যেন ড্যান ব্রাউনের বা আন্তর্জাতিক কোনো লেখকের বই পড়ছি!
ভেন্ট্রিলোকুইস্ট:
জহিরের বিয়ের অনুষ্ঠানে অনেকদিন পর দেখা হয়ে যায় পুরনো বন্ধুদের সাথে। দুই বন্ধু — নৃতত্ববিদ মারুফ এবং পত্রিকার ফিচার এডিটর রুমী, বন্ধুদের সাথে কথা প্রসঙ্গে জানতে পারে তাদেরই আরেক বন্ধু শওকত পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে ভেন্ট্রিলোকুইজম। যেই সহপাঠী একসময় বাকশক্তি হারিয়ে বোবা হয়ে গেছিল, সে’ই নাকি এখন কণ্ঠের কারিশমা দেখাচ্ছে!
কৌতুহলী হয়ে তারা দুজনে শওকতের সাথে দেখা করতে গিয়ে দেখলো শওকতের এক অস্বাভাবিক আচরণ, আর উত্তেজনার বশে তাদেরই সহপাঠিনী রুনু সম্পর্কিত এমন কিছু কথা বলে ফেলে যা দুজনকে করে তোলে আরো কৌতুহলী।
রহস্যময় কথাগুলোর মর্মার্থ অনুসন্ধান করতে গিয়ে ওরা জড়িয়ে পড়ে দারুণ রহস্যময় এক অনুসন্ধানে, বেরিয়ে আসে ভয়ঙ্কর আর শিউরে ওঠার মত সব সত্য, যেন কেঁচো খুঁড়তে একেবারে জীবন্ত ডায়নাসোর, সাধারণ মানুষকে কখনই জানতে দেয়া হয় না এমন সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর বহু বছর আগে হারিয়ে যাওয়া এক সম্প্রদায়ের কথা, যার পদে পদে ওদের জন্য ওৎ পেতে আছে মৃত্যু, বিপদ, জড়িয়ে আছে ঘনিষ্ঠ কিছু মানুষের জীবন।
বেরিয়ে আসে ডাক্তার রুশদী, রুশদীর মানসিক হাসপাতালের আড়ালের ভয়ঙ্কর কিছু সত্য।
ঘটনায় জড়িয়ে পড়ে হাসান, মারুফের বোন বিনু, প্রেক্ষাপটে বেরিয়ে আসে এক সিক্রেট মিশনের এজেন্ট মিলি, প্রায় মফস্বল এলাকার মত একটি গ্রামের খুব লাজুক ছেলে লোকমান।
বেরিয়ে আসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন জাপানের শিরো ইশির এক ভয়ঙ্কর কালো অধ্যায়, হিটলারের এক অ্যান্থ্রপলজিস্ট ও বিভিন্ন গা শিউরে ওঠা বিষয়।
সাথে যুক্ত হয় ধর্মতত্ত্ব, বাহাই, বাবি, স্যাটানিক, আব্রাহামিক ধর্মের বিভিন্ন বিষয়।
“ভেন্ট্রিলোকুইস্ট” শুধু একটি উপন্যাসই নয়, পাঠকদের জন্য ইতিহাস, স্থাপত্য, গণিত, ধর্মতত্ত্ব আর বিজ্ঞানের এক অভূতপূর্ব যাত্রা।
বইটি পড়ে অনেক অনেক ভালো লেগেছে। দারুণ এক থ্রিলার, বৈচিত্র্যময় কাহিনী। সাসপেন্স, মিস্ট্রি, থিওলজি, সাইন্স এলিমেন্ট, হালকা হরর আবহ- সবই আছে বইয়ে। বি-শা-ল পরিসরে ঝড়ের বেগে চলেছে কাহিনী। বেশ টানটান উত্তেজনাময় ছিলো পুরো বইটি। কী নেই বইয়ে? প্রাচীন ধর্মতত্ত্ব, বিজ্ঞান, ইতিহাস, মেডিকেল সাইন্স, মনস্তত্ত্ব, প্রেতচর্চা, আধুনিক স্থাপত্যের খুঁটিনাটি, বাহাই ও বাবি ধর্মের ইতিহাস, গণিতবিদ্যা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রক্তাক্ত এবং লুকিয়ে ফেলা কিছু অধ্যায় এবং কিছু চরিত্রের ব্যক্তিগত জীবনের কিছু আলো আঁধারী অধ্যায়।
পড়াশুনা ও গবেষণার মাধ্যমে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ঘাটতি যে পেছনে ফেলে দেয়া যায় তার প্রমাণ দেখিয়েছেন লেখক এই বইয়ে। বইটি লিখতে লেখককে যে কী পরিমাণ পরিশ্রম করতে হয়েছে সেটাই আমি ভাবছি শুধু পড়তে পড়তে। এত এত তথ্যের মিশেলে এত জটিল একটা প্লট, যেই সেই কাজ না। দারুণ এক কাজ দেখিয়েন লেখক। পাঠক অনেক অনেক তথ্য পাবে পড়তে পড়তে, কিন্তু এত তথ্য ধারণ করতে পাঠকের ক্লান্তি আসবে না।
গল্পটি উত্তম পুরুষে হবার সুবাদে মনে হচ্ছিলো আমিই মারুফ, আমার সাথেই ছিল রুমী। আমার সাথেই যেন সবকিছু ঘটে চলছে, আমিই বর্ণনা করছি ঘটনাগুলো। বর্ণনাভঙ্গীটা এতোই বাস্তবিক যে, মারুফ-রুমীর সাথে যা হচ্ছে, তার সবই আমি নিজেই অনুভব করছি। সাধারণত থ্রিলার গল্প-উপন্যাসগুলো তৃতীয় পুরুষে লেখা হয়, রহস্য ধরে রাখার জন্যে। কিন্তু লেখক উত্তম পুরুষে বইটি লিখে বেশ সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন।
লেখক শুরু থেকে রহস্যের জাল যেভাবে ছড়িয়েছে, ঠিক সেভাবেই ধীরে ধীরে রহস্যের জাল গুটিয়েছেন। রহস্যের সমাধানের মাধ্যমে দারুণ তৃপ্তি দিতে পেরেছেন। পাঠককে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ধরে রাখার মত একটি বই।
বইটির নামকরণও যথার্থ লেগেছে, শুরুতে ভেন্ট্রিলোকুইস্ট শওকতকে মনে হলেও কাহিনীর মূল ভেন্ট্রিলোকুইস্ট আরেকজন। তার পুতুল হয়েই সবাই চলছে। সেই দিক থেকেই নামকরণেও লেখক দারুণ খেল দেখিয়েছে।
মারুফের চরিত্রকে কিছুটা অন্ধকারে রেখেছেন লেখক, সেটা হয়তো গল্পটি মারুফের জবানীতে বলার কারণেই। দুয়েকটা বানান আর বিরামচিহ্ন বাদে বইয়ে নেগেটিভ দিক বলতে আর কিছুই নেই।
মিনিমালিস্ট:
দীর্ঘ চার বছর পর আবার রুমি ও মারুফ একসাথে জড়িয়ে পড়লো এক অদ্ভুদ ঘটনায়। দু’টো লক্ড রুম মিস্ট্রিতে। পড়ে গেল এক অদ্ভূত রহস্য মীমাংসায়, এক সুদীর্ঘ অনুসন্ধানে। যে অনুসন্ধানে মিশে আছে সহস্রবছর ব্যাপী গোপনে উচ্চারিত প্রশ্ন, মূল্যবান শত শত জীবন এবং অবিশ্বাস্য ঐতিহাসিক সব স্মারক।
কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে ছোটখাটো সাপ না শুধু, একেবারে অ্যানাকোন্ডার ডেরা। ঘটনা প্রবাহে বের হয়ে আসে দেশের এক বিত্তশালী ব্যক্তি, আতিক সাহেব। ঘটনায় বেরিয়ে আসে আতিক সাহেবের নাতনী জিনান। ঘটনায় জড়িয়ে পড়ে ভারতীয় এক গোয়েন্দা, রমেন্দ্রদা।
গল্পটি শিখদের নিয়েও। তাদের ঐতিহ্যের, সংস্কৃতির। আবার গল্পটি শিখদের আড়ালে অন্য কারোরও। হ্যাঁ, গল্পটি এক মাস্টারমাইন্ড উন্মাদেরও; যে ক্ষমতা, প্রতিশোধ ও রাজনীতির জন্য যে কোনো কিছু করে বসতে পারে।
গল্পটি প্রচলিত-অপ্রচলিত, প্রাচীন-অপ্রাচীন কতগুলো ধর্মবিশ্বাসের।
গল্পটি মিনিমালিজমের। মিনিমালিস্টদের জীবনবোধের। তাদের ইতিহাসের।
গল্পটি ঈসা, মুসা, আব্রাহামিক বিভিন্ন নবীর ও বিভিন্ন ধর্মপ্রচারকদের। বিভিন্ন ধর্মীয় ঐতিহাসিক স্থানের।
হ্যাঁ, গল্পটি পৃথিবীর মানব-ইতিহাসের দুই প্রাচীন রত্নেরও।
এছাড়াও গল্পটি আরো অনেকের। বাংলাদেশ, ভারত বা ভারতবর্ষ ছাড়াও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলের। আরো অনেকে রাজনীতির। অনেক সংগ্রামের। অনেক আলো-আঁধারী অধ্যায়ের।
এর সুবিস্তৃত বিশাল পটভূমিতে মারুফ-রুমি খুঁজে ফেরে এমন এক সত্য যা ধামাচাপা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মিথ্যা আর ছলনায় মোড়া দৈত্যাকার মহীরুহ।
কান পেতে শুনতে চেষ্টা করুন। কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। নানা ঘটনা, উপঘটনার সুদীর্ঘ যাত্রা। যার উপলক্ষ্য খুব খারাপ কিছু এবং বৃহৎ ও মহতী এক বোধের।
মাশুদুল হক এর “মিনিমালিস্ট” পাঠককে এক অদ্ভুত দর্শনের দিকে টেনে নিয়ে যাবে।
এই বইটিও পড়ে অনেক অনেক ভালো লেগেছে। দারুণ এক কাল্ট থ্রিলার। সাসপেন্স, মিস্ট্রি, থিওলজি, সাইন্স এলিমেন্ট, হিস্টোরি, মিথ সবই আছে বইয়ে। বিশাল ও আন্তর্জাতিক পরিসরে ঝড়ের বেগে চলেছে কাহিনী। বেশ টানটান উত্তেজনাময় ছিলো পুরো বইটি। প্রাচীন ধর্মতত্ত্ব, কিছু নতুন ধর্ম, মিথ, বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, রাজনীতি, কিছু অমূল্য রতনের ইতিহাস, শিখ ধর্ম, সাবমিশন, মিনিমালিজম এর ইতিহাস, ইতিহাস থেকে লুকিয়ে ফেলা অনেক অনেক অধ্যায় এবং আরো অজানা অনেক কিছু আছে বইয়ে।
পড়াশুনা ও গবেষণার মাধ্যমে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ঘাটতি যে পেছনে ফেলে দেয়া যায় তার প্রমাণ দেখিয়েছিলেন লেখক তার আগের বই “ভেন্ট্রিলোকুইস্ট”-এ। এই বইতে লেখক সেটিকে আরো পাকাপোক্তভাবে দেখিয়ে দিয়েছেন। বইটি লিখতে লেখককে যে কী পরিমাণ পরিশ্রম করতে হয়েছে, ভাবতে ভাবতে আমি হয়রান! অনেক অনেক তথ্য পেয়েছি পড়তে পড়তে, কিন্তু এত তথ্য ধারণ করতে একটুও ক্লান্তি আসেনি। সত্যি কথা বলতে, এত এত তথ্যসমৃদ্ধ থ্রিলার আমার খুব পছন্দের। অনেক অজানা তথ্য নতুন করে জানতে পারলাম, বেশ কয়েকবার পড়ার ফাঁকে ফাঁকে গুগল, উইকি ও বিভিন্ন ব্লগেও ঢুঁ মেরছি আরো বিস্তারিত জানার জন্য বিষয়গুলো।
লেখক দারুণ এক এক্সপেরিমেন্ট করেছেন বইয়ে। একেকটি অধ্যায় একেক পয়েন্ট অফ ভিউ থেকে দেখিয়েছেন। প্রত্যেকটি অধ্যায় আলাদা চরিত্রের জবানীতে বর্ণনা করেছেন। প্রত্যেকটা চরিত্রের দিক থেকেই ঘটনা প্রবাহ দেখিয়েছেন। গল্পটি যখন মারুফ বর্ণনা করছিল তখন নিজেকে মারুফ মনে হচ্ছিলো, আবার যখন রুমি বর্ণনা করছিল তখন রুমি, আবার কখনও জিনান, কখনও বা জসওয়ান্ত, মোটকথা একেক অধ্যায়ে নিজেকে একেকজন চরিত্র মনে হচ্ছিলো।
বইটি ভেন্ট্রিলোকুইস্ট এর সিক্যুয়াল হলেও, যারা ভেন্ট্রিলোকুইস্ট পড়েনি, এই বইটির কাহিনী বুঝতে একটুও সমস্যা হবে না। কারণ এই বইয়ে “ভেন্ট্রিলোকুইস্ট” এর মারুফ আর রুমি ব্যতিত বাকি সবাই’ই নতুন। নতুন চরিত্র, নতুন প্রেক্ষাপট, নতুন ঘটনা।
বইয়ে দৃশ্যায়ন, সংলাপ, হালকা-পাতলা অ্যাকশন এবং খুঁটিনাটি বর্ণনা করা হয়েছে খুব সুন্দরভাবে। প্রতিটা জায়গার এত ডিটেইল বর্ণনা দিয়েছেন, মনে হচ্ছিলো লেখক আমাকে নিয়ে ওখানে ঘুরতে গিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে জায়গাগুলোর বর্ণনা দিচ্ছেন খুব সন্দরভাবে।
নন-লিনিয়ার স্টোরিটেলিং এর কারণে শুরুর দিকে একটু খাপছাড়া লাগতে পারো কারো কারো। তবে “ভেন্ট্রিলোকুইস্ট”-এ লেখক যেই আকর্ষণ করেছেন তার লেখায়, সেটার কারণে থেমে থাকা সম্ভব না।
অনেক অনেক চরিত্রের কারণে অনেক পাঠকের কাছে বিরক্ত লাগতে পারে, আমারও কিছুটা লেগেছিলো। কিছু কিছু চরিত্রকে লেখক কিছুটা অন্ধকারে রেখেছেন। ক্যারেক্টার ডেভেলপমেন্ট কিছুটা কম হলেও যতটুকু করেছেন সেটা ভালোই লেগেছে। সাবমিটদেরকে ডেভেলপ লাগেনি অতটা।
বেশকিছু বানান ও বিরামচিহ্ন ভুল বা মুদ্রণজনিত ছিল, কিন্তু কাহিনীর যেই গতি ছিল, এসব অতটা চোখেই আটকায়নি।
দু’টি বইয়ের গল্পে ধর্ম, ইতিহাস, বিজ্ঞান, মিথ এসব থাকায় অনেকেরই মনে হতে পারে ড্যান ব্রাউনীয় প্রভাব আছে বইয়ে। কিন্তু এটা আসলে এই সিরিজেরই স্টাইল। লেখকের সিগনেচার স্টাইল’ই হয়তো এটা। যাই হোক, যারা ড্যান ব্রাউনীয় টাইপের বই পড়তে পছন্দ করেন, তাদের জন্য অবশ্যপাঠ্য দুইটি বই।