বিএনপির দৃষ্টিতে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা

361
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা

মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার লক্ষ্যে দেড় দশক আগে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে সংগঠিত ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি স্থায়ী বিভক্তি রেখা টেনে দিয়েছে। এই ঘটনাটি দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ-বিএনপির মধ্যে জন্ম দিয়েছে অবিশ্বাস এবং চিরকালীন শত্রুতা— এমনটিই মনে করেন রাজনীতি বিশ্লেষকরা।

তবে বিশ্লেষকদের এই মতের সঙ্গে একমত নয় বিএনপি। ঘটনার দেড় দশক পরে এসেও দলটির নেতারা বলছেন, ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের ঘটনা ছিল একটি সন্ত্রাসী ঘটনা। সেই ঘটনার সঙ্গে জোট সরকারের কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। ঘটনার পর তারা সাধ্যমতো চেষ্টা করেছে প্রকৃত দোষীদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনতে। কিন্তু ওই ঘটনার শিকার আওয়ামী লীগের কাছ থেকে কোনো সহযোগিতা পায়নি তৎকালীন সরকার।

সোমবার (১৯ আগস্ট) বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘দেড় দশক আগে ২১ আগস্ট যে ঘটনাটি ঘটেছিল, সেটি ছিল একটি সন্ত্রাসী ঘটনা। এই ঘটনায় আমরা তীব্র নিন্দা করি, ঘৃণা করি, নিন্দা জানাই, জানিয়েছি, জানাচ্ছি এবং এই ধরনের ঘটনা যেন পুনরাবৃত্তি না হয়, তার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে সচেতন থাকা দরকার।’

ঘটনার ১৪ বছর পর গত বছর ১০ অক্টোবর বিচারিক আদালত থেকে যে রায় দেওয়া হয়, সে রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ‘রাষ্ট্রযন্ত্রের সহায়তায় ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা করা হয়। এই হামলা ছিল আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করা।’

ওই রায়ের পর বিশ্লেষকরা মত দেন, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মতো বর্বরোচিত রাজনৈতিক পাশবিকতার সঙ্গে কোনো বিচারেরই  তুলনা চলে না। বিএনপি এ থেকে কখনো নিস্তারও পাবে না।

এ প্রসঙ্গে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বক্তব্যটা এমন— ‘কেন? কেন? এখানে বিএনপি দায়ী হওয়ার কোনো কারণ থাকতে পারে না। এটা সম্পূর্ণ সন্ত্রাসী ঘটনা। যারা দোষ করেছে, সঠিকভাবে তদন্ত করে তাদেরকে বের দরকার। যে তদন্ত হয়েছে, সেটি সঠিক হয়নি বলে আমরা মনে করি। আর যাদের সাজা দেওয়া হয়েছে, তাদের সম্পর্কে যেভাবে এসেছে, মুফতি হান্নান যে স্টেটমেন্ট দিয়েছে— এগুলো তো রাজনৈতিক। তারেক রহমানকে জড়িয়ে ওটাকে রাজনৈতিককরণ করা হয়েছে।’

অন্য খবর  স্বেচ্ছাসেবকদলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে সাবেক ছাত্রনেতা ঝিলু

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বচন্দ্র রায় বলেন, ‘যারা লেখেন, সব সময়ই বিজয়ীর পক্ষে লেখেন। বিজয় কীভাবে এলো, সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা হলো ইতিহাস বিজয়ীর পক্ষে যাবে। হিটলার যদি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জয়লাভ করত, তাহলে হিটলারের পক্ষেই ইতিহাস লেখা হতো। বিএনপিকে ফাঁসানোর চেষ্টা হচ্ছে। দেশে যখন গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরবে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে জনগণের সরকার নিশ্চিত হবে, তখন বানানো ইতিহাস পরিবর্তন করা হবে।’

‘সেই কারণেই আজকের ঘটনা দিয়ে কিছু পরিমাপ করতে পারব না। নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ দিয়ে যখন সিদ্ধান্তে আসতে পারব, সেদিন প্রকৃত চিত্রটা ফুটে উঠবে। আজ আমি অনেক কথাই বলতে পারব। কিন্তু অনেক কথা বলা আমার জন্য নিরাপদ নয়। মৃত্যু ভয় সবারই থাকে, কম-বেশি,’— বলেন এই বিএনপি নেতা।

বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে হিংসা-প্রতিহিংসা থাকলেও দেশের প্রধান দুই নেত্রী শেখ হাসিনা-খালেদা জিয়া পরস্পর পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। দু’জন দু’জনের ব্যাপারে খুব একটা কঠিন হননি। ১৯৯১-১৯৯৬ আমলে শেখ হাসিনার সঙ্গে খালেদা জিয়ার এবং ১৯৯৬-২০০১ আমলে খালেদা জিয়ার সঙ্গে শেখ হাসিনার ব্যবহার খুব একটা কঠিন ছিল না। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত জোটের আমলে সংঘটিত ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা সব হিসাব বদলে দেয়। এই গ্রেনেড হামলার কারণেই তারেক রহমান দেশে ফিরতে পারছেন না।

কিন্তু বিশ্লেষকদের এই মতকেও স্বীকার করছেন না বিএনপি নেতারা। গয়েশ্বরচন্দ্র রায় বলেন, ‘রাজনীতিতে বিভক্তি রেখাটা ২১ আগস্টের ঘটনা নয়। বিভক্তি রেখাটা শুরু হয়েছে ভিন্ন মতাবলম্বীদের অস্তিত্ব বা তাদের কর্মকাণ্ডে অস্বীকার করার মধ্য দিয়ে। ২১ আগস্টের ঘটনাটা অনাকাঙ্ক্ষিত। কোনো নাগরিকই হত্যাকাণ্ড পছন্দ করে না, করার যৌক্তিক কারণও নেই। কিন্তু এই ঘটনাকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে।’

অন্য খবর  বিএনপির সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে দোহার আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশ

তবে বিএনপির অনেক নেতাই মনে করেন, প্রতিটি অপরাধের মানদণ্ড অনুযায়ী বিচার করারও সুযোগ আছে। যেকোনো ব্যক্তিকেই বিচারের আওতায় এনে বিচার করা যায়। সুতরাং ২১ আগস্ট ঘটনারও বিচার হওয়া উচিত। কারণ, এই মর্মান্তিক ঘটনা রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে একটা আতঙ্কের জন্ম দিয়েছে। রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে খুন, গুম, অপহরণের মতো যেসব বিষয় সংযোজন হচ্ছে, সেগুলোও জনগণের কাছে কাম্য নয়। সাধারণ নাগরিক, রাজনীতিবিদ— প্রত্যেকেরই নিরাপদ জীবেনের গ্যারান্টি থাকা দরকার।

বিএনপির কোনো কোনো নেতা ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সঙ্গে রমনার বটমূলে বোমা হামলা, উদীচী বোমা হামলা, পল্টনে সিপিবির সমাবেশে হামলা এমনকি পিলখানা ট্রাজেডিকেও মেলাতে চান। তারা বলছেন, ২১ আগস্টের হামলা যেমন গ্রহণযোগ্য না, তেমনি উদীচী, সিপিবি, বটমূলে হামলাও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় গ্রহণযোগ্য নয়।

মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া দল আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার জন্যই ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছিল— এ যুক্তির পক্ষে যখন বেশিরভাগ মানুষই একমত, ঠিক তখন বিএনপি নেতাদের মূল্যায়ন অন্য রকম। মুক্তিযুদ্ধে রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের একক নেতৃত্বকে স্বীকার-ই করে না বিএনপি।

গয়েশ্বরচন্দ্র রায় বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে এ দেশের আপামর জনগোষ্ঠী, দলমত নির্বিশেষে সবাই। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব তারা (আওয়ামী লীগ) কথা-বার্তা-বিবৃতির মধ্য দিয়ে দিয়েছে। কিন্তু প্রাকটিক্যাল ফিল্ডে যারা যুদ্ধ করেছে, তারা কিন্তু কেউ দলীয় লোক না। ক্ষমতাসীন দল মুক্তিযুদ্ধ করেনি, এমন কথা বলা যাবে না। তার অর্থ এই না যে, যুদ্ধে একমাত্র তারাই ছিল। যুদ্ধ শুরু হয়েছে ২৭ মার্চ জিয়াউর রহমানের ঘোষণার মধ্য দিয়ে। ১৭ এপ্রিল মুজিব নগরে একটা অস্থায়ী সরকার গঠন করা হয়। মাঝ খানের এই ক’দিন যুদ্ধটা কার নেতৃত্বে চলছে? সুতরাং আওয়ামী লীগ করলেই মুক্তিযোদ্ধা হয়ে যায়, অন্য দল করলেই রাজাকার আলবদর— এটা কোনো ধরনের রাজনীতি!’

আপনার মতামত দিন