হাসিনা-খালেদাকে জেদ পরিহার করতে হবেঃ নুরে আলম সিদ্দিক

411

জনসংখ্যার দিক থেকে এই বিশাল পৃথিবীতে বাংলাদেশ অষ্টম দেশ। আয়তনের দিক থেকে ৯৩তম। ১৯৭৩ সালে রাষ্ট্রীয় সফরে যখন আমি আমেরিকায় গিয়েছিলাম, তখন ভিয়েতনাম যুদ্ধে নিহত আমেরিকার নৌবাহিনীর এক এডমিরালের স্ত্রী সানফ্রান্সিসকোতে আমাকে নৈশভোজে আমন্ত্রণ করেছিলেন। তিনি আমাকে আমাদের দেশের জনসংখ্যা কত জিজ্ঞাসা করলেন। সে সময় বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি। আয়তন জিজ্ঞাসা করলে আমি বললাম, ৫৪ হাজার বর্গমাইল। তিনি সর্প-দংশনের মতো চমকে উঠে বিস্ময়াভিভূত ও আশ্চর্যান্বিত হয়ে আমাকে বললেন, তোমরা ঘুমাও কোথায়? আমি নির্লিপ্ত চিত্তে জবাব দিয়েছিলাম, আমাদের সবাই নিজ নিজ গৃহে ছাদের নিচেই ঘুমায়। উনি কী বুঝেছিলেন জানি না। প্রসঙ্গটি ওখানেই থেমে যায়। কিন্তু ওই রক্ষণশীল প্রৌঢ়া ভদ্রমহিলাটি কেন, মূল আমেরিকানদের মধ্যে আজও কেউ ভাবতে পারবেন না, ওই সীমানার মধ্যে আজ ১৬ কোটি মানুষ ঘুমায় কোথায়?

তখনকার সাড়ে সাত কোটি মানুষের মধ্যেও ১৯৭৪ সালে আমাদেরই শাসনামলে একবার দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। সেই দুর্ভিক্ষের মর্মান্তিক চিত্র মনে পড়লে আজও সমস্ত শরীরে কাঁটা দিয়ে ওঠে।

সেই দেশটিই আজ ১৬ কোটি মানুষের দায়ভার বহন করে চলেছে। আজ আর পিএল-৪৮০-এর চালের প্রয়োজন হয় না। খরা, বন্যা, সিডর, জলোচ্ছ্বাস না হলে খাদ্যে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ—এটা বললেও অত্যুক্তি হবে না। এর বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ যাই হোক না কেন, আমি সমস্ত হৃদয় দিয়ে এটাকে আল্লাহর রহমত হিসেবেই বিশ্বাস করি এবং তার কাছেই শোকর আদায় করি। কথাটি এ কারণে অবতারণা করলাম যে, শত টানাপড়েনেও বাংলাদেশ চরম বিপর্যয়ের হাত থেকে বার বার রক্ষা পেয়েছে।

সম্প্রতি রোহিঙ্গা ঢল বাংলাদেশের জন্য একটা অজানা আশঙ্কার অশনি সংকেত তৈরি করেছে। মিয়ানমারের বর্বর সেনাবাহিনীর পাশবিক, নৃশংস ও বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড, ধর্ষণ, ব্যভিচার রোহিঙ্গাদের শত শত বছরের ভিটামাটি ছেড়ে শুধু জীবন বাঁচানোর জন্য নাফ নদের উত্তাল তরঙ্গমালাকে অতিক্রম করে বাংলাদেশে আসতে বাধ্য করেছে। বহুদিন ধরে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় একটা অস্থিরতা বিরাজ করছে। শুধু সে কারণে ১০ লাখেরও অধিক রোহিঙ্গার দীর্ঘ অবস্থান আমাদের জন্য একটি সংশয়, উত্কণ্ঠা ও উদ্বেগের কারণ সৃষ্টি করেছে। এখনো আমরা ধনী রাষ্ট্র না হলেও বাড়তি ১০ লাখ রোহিঙ্গার ভরণপোষণের দায়ভার গ্রহণ করার মানসিকতা ও মননশীলতা আমাদের আছে। প্রান্তিক জনতা ইতিমধ্যে প্রচণ্ড আবেগে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের জন্য ত্রাণসামগ্রী নিয়ে এমনভাবে ছুটে গেছেন, তা শুধু অভূতপূর্বই নয়, বিশ্বকে বিমুগ্ধ ও বিমোহিত করেছে। জাতিসংঘসহ বিশ্বের মানবাধিকারে বিশ্বাসী ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সব মানুষই রোহিঙ্গা বিতাড়নে মিয়ানমারের এই বর্বরতার নিন্দা করেছেন এবং আশ্রয় প্রদানের জন্য বাংলাদেশের উদার ও অবারিত চিত্তের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।

আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক মহলের অনেকেই ম্রিয়মাণ ও মৃদু স্বরে কফি আনান কমিশনের সুপারিশের বাস্তবায়ন চাইলেও নিরাপত্তা পরিষদে মিয়ানমারের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ ও চাপ সৃষ্টির প্রস্তাব তো গৃহীত হয়ইনি, বরং চীন, রাশিয়া ও জাপানের মতো দেশও মিয়ানমারের ওপর অবরোধ আরোপের প্রস্তাবে সম্মত হতে পারেনি। এটা একদিকে যেমন বেদনাদায়ক, অন্যদিকে আমাদের কূটনৈতিক দৈন্যতাকেও প্রকটভাবে তুলে ধরে। রোহিঙ্গা উচ্ছেদ-পর্বের প্রথমদিকেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মিয়ানমার সফর করেন। তার সফরের পর মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা দুঃখজনকভাবে বৃদ্ধি পায় এবং ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। তাই সেই সফরে মিয়ানমারের সামরিক জান্তাকে তার প্রদেয় মন্ত্রণা কী ছিল, তা সহজেই অনুমেয়। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের প্রান্তিক জনতার চিত্তে তো বটেই, পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতেও নরেন্দ্র মোদির বক্তব্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে।

ভারতের প্রথিতযশা সংবাদ মাধ্যমগুলো মোদির মন্তব্য ও অবস্থানের বিপরীতে প্রতিবাদে বিসুভিয়াসের মতো জ্বলে ওঠে। যার ফলশ্রুতিতে মোদি সরকার নতুন করে বিবৃতি দিতে বাধ্য হয় (পররাষ্ট্র সচিবের মাধ্যমে)। এমনকি সুষমা স্বরাজের বাংলাদেশ সফরের প্রধানতম এজেন্ডাও বাংলাদেশে প্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের উদ্ভূত পরিস্থিতির প্রেক্ষাপট। বাংলাদেশে এসে সুষমা স্বরাজ রোহিঙ্গা মুসলিমদের রাজনৈতিক অধিকারসহ মিয়ানমারে তাদের প্রত্যাবর্তনই শুধু নয়, পূর্ণ নাগরিক অধিকার প্রদানের আহ্বান জানিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে ‘বাধ্য করা হবে’ উক্তিটি প্রণিধানযোগ্য। ভবিষ্যৎই বলে দেবে, এ বক্তব্যটি শুধু কূটনৈতিক, নাকি এর মধ্যে আন্তরিকতাও আছে।

মুসলিম রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাতিসংঘের যে অক্ষমতা, নিষ্প্রভ-নিস্পৃৃহ ও মৃতপ্রায় অবস্থা পরস্ফুিট হয়েছে, তাতে মনে হয়েছে, পৃথিবীতে উদ্ভূত যে কোনো রাজনৈতিক অস্থিরতায় নিষ্ফল বিতর্ক ছাড়া কোনো সমস্যার সমাধান করার মতো শক্তি ও মননশীলতা জাতিসংঘের নেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর গড়ে ওঠা এ সংস্থাটি এখন নিছক একটি বিতর্কের পাদপীঠ। বিশ্ব-মানবতার বিপরীতে উদ্ভূত যে কোনো ইস্যুতে পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি প্রদান ছাড়া স্থায়ীভাবে জাতিসংঘ কোনো সমাধান আজ পর্যন্ত দিতে পারেনি, ভবিষ্যতেও পারবে না— এটা প্রায় নিশ্চিত। কেবল ‘ডিম দিবস’, ‘হাত ধোয়া দিবস’—এসব দিবস পালনের উদ্যোক্তারূপেই তারা বিশ্বদরবারে নিজেদের প্রতিভাত করছে। শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারা বিশ্বে তাই এ প্রশ্নটি প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে—উদ্ভূত সমস্যা সমাধানে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে অক্ষম এই আন্তর্জাতিক ব্যয়বহুল, বিতর্ক অনুষ্ঠানের আয়োজক ‘ঠুঁটো জগন্নাথ’ প্রতিষ্ঠানটিকে রেখে কী লাভ?

অন্য খবর  সরকারিকরন উপলক্ষে জয়পাড়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের আনন্দ মিছিল

এখন দেশের নৈমিত্তিক রাজনৈতিক সমস্যার দিকে দৃষ্টি ফেরানো যাক। সিলেট ও ময়মনসিংহের হাওরাঞ্চলে এবং উত্তরবঙ্গের বিশাল অঞ্চলজুড়ে বন্যার বিভীষিকাময় প্রাদুর্ভাব ও ব্যাপক ফসলহানির কারণে যখন বাংলাদেশ বিপর্যস্ত হয়ে উঠছিল, তখন দাম্ভিক ক্ষমতালোভী—যার চেতনায় মানুষের কোনো মূল্যই নেই—তিনি আড়াইটি মাস লন্ডনে বিলাসবহুল ও প্রাচুর্যের জীবন কাটিয়ে এলেন। ভাগ্যের কী নিষ্ঠুর পরিহাস, দেশে প্রত্যাবর্তনের পর কী সাড়ম্বর অভ্যর্থনা! কাকে প্রশ্ন করব ভেবে পাই না, এ সংবর্ধনার উপলক্ষ কী? লন্ডনে ওই আড়াই মাস অবস্থানকালে তার অর্জন কী? মৌলিক অধিকার-বিবর্জিত এই দেশে যখন আন্দোলন সৃষ্টি করার জন্য নির্ভীক, নির্মোহ ও নির্যাতনের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে একটি মিছিলও দেখা যায় না, তখন বাকসর্বস্ব এ সংগঠনটির রথী-মহারথীদের জনসম্মুখে কী চরিত্র প্রতিভাত হয়, শুধু সংবাদ সম্মেলনে বাগাড়ম্বর ছাড়া?

শেখ হাসিনা সংসদ, প্রশাসন এমনকি বিচারিক ব্যবস্থাকেও নিঃশেষিত প্রায় করে ফেলেছেন। অন্যদিকে বেগম খালেদা জিয়া বিধ্বস্ত সামাজিক অবস্থায় মৌলিক পরিবর্তনের আন্দোলন সৃষ্টিতে কার্যকর কোনো উদ্যোগ না নিয়ে শুধুই ক্ষমতা দখলের কূটিল কৌশলী মতলবে ব্যাপৃত আছেন। কী দুর্ভাগ্য দেশের প্রান্তিক জনতার! ২৩টি বছরের সংগ্রামের দীর্ঘ পথপরিক্রমণে যাদের দৃপ্ত পদচারণায় পাকিস্তানের সামরিক জান্তারও বার বার বুক কেঁপে উঠেছে এবং পরাজিত হয়েছে, যে মুক্তিপাগল জাগ্রত জনতা আগ্নেয়গিরির গলিত লাভার মতো প্রজ্বলিত হয়ে উঠে সব ষড়যন্ত্রের জালকে পুড়িয়ে ভস্মীভূত করেছে, যে উদ্বেলিত জনতার বুক-নিঃসৃত রক্ত পরাধীনতার বক্ষ বিদীর্ণ করে স্বাধীনতার সূর্যকে ছিনিয়ে এনেছে— রাজনৈতিক অধিকারের প্রশ্নে তারা আজ নিঃস্ব, রিক্ত। আন্দোলনের প্রশ্নে তারা নিস্পৃহ ও নির্বিকার। এর মূল কারণ রাজনৈতিক নেতৃত্বের দুর্দমনীয় ক্ষমতালিপ্সা। তাদের প্রতি জনগণের আস্থাহীনতা ও বীতশ্রদ্ধ মানসিকতা থেকে তাদের ফিরিয়ে আনতে হলে, এই আত্মকেন্দ্রিক ক্ষমতালিপ্সু রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের বাস্তিল দুর্গকে ভাঙতে হলে বিকল্প যে সৎ, সাহসী ও প্রান্তিক জনতার স্বার্থের প্রতি নিবেদিত নেতৃত্ব প্রয়োজন, সেই নেতৃত্ব খুঁজে বের করতে হবে। আমি মনে করি, কাজটি কঠিন হলেও অসম্ভব নয়।

সম্প্রতি প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাকে নিয়ে একটি অকল্পনীয় নাটক মঞ্চস্থ হয়ে গেল। প্রথমে শোনা গেল, অসুস্থতার কারণে ছুটি নিয়ে তিনি চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাচ্ছেন। আইনমন্ত্রী অসুখের প্রেক্ষাপটে ছুটির বিষয়টি সংবাদ মাধ্যমকে অবহিত করেন। পরবর্তীতে থলের কালো বেড়ালটি বেরিয়ে পড়ল। দুর্নীতি, বেআইনিভাবে বিদেশে অর্থপাচার ও নৈতিক স্খলনের অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। সংবাদ মাধ্যমের ফাঁকফোকর দিয়ে এটাও বেরিয়ে এসেছে যে, ফুলবেঞ্চের অন্য মাননীয় বিচারপতিগণ তার সঙ্গে বসে বিচারকার্য পরিচালনা করতে অসম্মতি জানিয়েছেন। বিষয়টি ভীষণ গোলমেলে। এটি এতই উচ্চমার্গের যে, সাধারণ মানুষের বিষয়টি সম্যক বুঝতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। ঘটনাপ্রবাহের দিকে অসহায়ের মতো অপলক নেত্রে চেয়ে থাকা ছাড়া তাদের গত্যন্তর নেই।

তবুও প্রশ্ন থেকেই যায়। দেশের প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে এহেন মারাত্মক অভিযোগ থাকলে তাকে চুপিসারে বিদেশ যাওয়ার অনুমতি প্রদান করা হলো কেন? দেশের সম্মান, সার্বভৌমত্ব ও সংহতির স্বার্থে সমগ্র বিষয়টির পূর্ণ তদন্ত করে বিচারের আওতায় আনাই তো সঙ্গত ছিল। মৌলিক অধিকার-বিবর্জিত এই সমাজ ব্যবস্থায় এমনিতেই মানুষের মন এক অজানা আশঙ্কায় দুরু দুরু করে। সে ক্ষেত্রে এ ধরনের নাটক মঞ্চস্থ হতে দেখলে উদ্বেগ-উত্কণ্ঠা বেড়ে যায় এবং আইনের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থায় প্রচণ্ড আঘাত আসে—এটাই স্বাভাবিক। প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার স্থলে আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞাকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে। এখানেই বিষয়টির যবনিকা টানলে সমস্যাটির সুষ্ঠু সমাধান হবে না। বরং মূল অভিযোগটির তদন্ত করে জনগণের কাছে তার রিপোর্ট তুলে ধরতে হবে। তার অবর্তমানেও বিষয়টির তদন্ত হতে পারে বলে অনেক অভিজ্ঞজন অভিমত ব্যক্ত করেছেন। কারণ প্রধান বিচারপতি কোনো ব্যক্তি নন, একটি প্রতিষ্ঠান।

সাবেক প্রধান বিচারপতি মরহুম সায়েম জিয়াউর রহমানের পৃষ্ঠপোষকতায় ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনার পর খুনি খন্দকার মোশতাক আহমদকে রাষ্ট্রপতির শপথ পাঠ করিয়েছিলেন। পরবর্তীতে তিনি নিজেই রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। বিচারপতি সাত্তারও গণতন্ত্র-বিবর্জিত সামরিক জান্তার সানুগ্রহে দেশের ভারপ্রাপ্ত ও নির্বাচিত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। একটা প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে তিনি রাষ্ট্রপতির পদটি দখল করতে সক্ষম হন। তখন আমি রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলাম বলেই এই কূটিল প্রক্রিয়ার সবকিছু অবলোকন করার সুযোগ পেয়েছি। তাই শতভাগ নিশ্চিত হয়ে বলতে পারি, এ দুই বিচারপতির কার্যকলাপ জনস্বার্থ-বিরোধী ছিল তো বটেই, দেশের সর্বোচ্চ বিচারিক প্রতিষ্ঠানকে কলঙ্কিত করেছে। অবশ্য প্রাসঙ্গিকভাবে এখানে উল্লেখ করতে হয়, এই বাংলাদেশে ’৭১-এর উত্তাল মার্চে জনাব বি এ সিদ্দিকী (তখনকার হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি) জেনারেল টিক্কা খানকে শপথবাক্য পাঠ করাতে সুদৃঢ় ও অকুতোভয় চিত্তে অস্বীকার করেছিলেন। এটি জাতি হিসেবে আমাদের গৌরবান্বিত করে।

অন্য খবর  সাংবাদিকতায় কেনো ৫৭ ধারার খগড়!

সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট একটি পর্যবেক্ষণ রায়ে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলকে নিন্দাসহকারে নাকচ করেছে বটে। কোর্ট অভ্যুত্থানকারী সামরিক জান্তাকে কঠোর ভাষায় নিন্দা করেছে এবং অভ্যুত্থানের সরকারকে অবৈধ ঘোষণা করেছে। কিন্তু নিজেদের গা বাঁচাতে যেসব বিচারপতি তাদের সহায়ক হিসেবে সহায়তা দিয়েছেন, সামরিক জান্তার প্রত্যক্ষ মদদে রাষ্ট্রপতি বা ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন—তাদের অপকর্মের বিষয়টিকে নিন্দার আবর্তে আনার ক্ষেত্রে এড়িয়ে গেছেন। ইতিহাস এ প্রশ্নটিকে একদিন রূঢ়ভাবে সামনে আনবেই।

প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে সরকারি ও বিরোধী দলের প্রচণ্ড বাক-বিতণ্ডা থামতে না থামতেই দেশের প্রধান নির্বাচন কমিশনার জনাব কে এম নূরুল হুদা প্রচণ্ড সমালোচনার শিকার হয়ে গেলেন। কারণ বিএনপির প্রতিনিধি দল নির্বাচন কমিশনের আমন্ত্রণে সংলাপে অংশগ্রহণের প্রাক্কালে প্রধান নির্বাচন কমিশনার মন্তব্য করেন, অবলুপ্ত বহুদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে জিয়াউর রহমানই পুনরায় প্রবর্তন করেন। ব্যস, আর যায় কোথায়! আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব তার সমালোচনায় ঝড় সৃষ্টি করলেন। ভাগ্যিস, তাকে বিতাড়িত করেনি। বাকশালের মাধ্যমে একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের পর ৭ নভেম্বরের সিপাহী বিপ্লবের মাধ্যমে জিয়াউর রহমান প্রথমে প্রধান সামরিক প্রশাসক ও পরবর্তীতে সামরিক জান্তার চিরাচরিত প্রহসনের ‘হ্যাঁ-না’ ভোটের নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি পদে সমাসীন হন। উল্লেখ করা প্রয়োজন, গদি দখলের কৌশলটি পাকিস্তানের লৌহমানব আইয়ুব খানের কৌশলেরই অনুসরণ। তবুও স্বীকার করতেই হয়, তিনি বহুদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তন করেন। সিইসির মন্তব্যটিকে এড়িয়ে গিয়ে আওয়ামী লীগ বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে পারত। কারণ, উপরের দিকে থুথু ফেললে নিজের গায়েই পড়ে।

সুষমা স্বরাজের সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফরে দুটি বিষয়ই জোরেশোরে উঠে এসেছে। একটি মিয়ানমার থেকে নির্মমভাবে বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের পূর্ণ নাগরিক অধিকারসহ মিয়ানমারে পুনর্বাসন, অন্যটি আগামী নির্বাচনে সব দলের, বিশেষ করে বিএনপির অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা। যেভাবে সারা বিশ্ব এ প্রশ্নে উচ্চকিত, তাতে আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে বিএনপির অংশগ্রহণ ছাড়া একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা সম্ভব নয়। এ সত্যটি শেখ হাসিনা সম্যক উপলব্ধি করেছেন, এটা স্পষ্ট প্রতীয়মান। কাগুজে বাঘ বিএনপিকে মিছিল ও সভা করার ক্ষেত্রে কিছুটা ছাড় দিতেও তিনি শুরু করেছেন। বিলম্বে হলেও এ পদক্ষেপ নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণের পথকে কিছুটা সুগম করেছে। অন্যদিকে সব দল ও বিভিন্ন মহলের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের সংলাপের উদ্যোগটি একটি ইতিবাচক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।

সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব শুধু সরকার ও নির্বাচন কমিশনের নয়, বিরোধী দলের ওপরও এর দায়িত্ব বর্তায়। মনে রাখতে হবে, বিগত ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করে পুরো মেয়াদে তারা কোনো সফল আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেননি। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন আওয়ামী লীগ বর্জন করেছিল; কিন্তু সাংগঠনিক শক্তি এবং প্রত্যয়দৃঢ় কর্মীদের শক্তিতে আওয়ামী লীগ সরকারকে পদত্যাগ করিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে পুনরায় নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাধ্য করেছিল। এটা সুনিশ্চিত, বিএনপির সেই শক্তি বা আত্মবিশ্বাস—কোনোটিই নেই। অন্যদিকে শেখ হাসিনার একগুঁয়েমি তো সর্বজনবিদিত। সংসদ তো ভাঙতে হবেই; কারণ, সংসদকে রেখে আরেকটি সংসদ নির্বাচন সম্ভব নয়। অন্যদিকে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ প্রদানের স্বার্থে বিএনপিকেও নির্বাচনে অংশ নিতে হবে।

আপাত দৃষ্টিতে ক্ষমতাসীন দলের আনুগত্যে পুরো দেশটিকে দেখালেও বাস্তব অবস্থা ভিন্নতর। বিএনপি বরং তার সাংগঠনিক শক্তিকে সুবিধাবাদী চরিত্র থেকে সরিয়ে এনে প্রত্যয়দৃঢ়তার পাদপীঠে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে ২০১৯ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় না এলেও বিপুলসংখ্যক সংসদ সদস্য যে তারা পাবে—এটা নিশ্চিত করে বলা যায়। নির্বাচন-উত্তর নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের নিয়ে সংসদকে কার্যকর করতে পারলে একদিকে যেমন দেশে গণতন্ত্র নিশ্চিত হবে, অন্যদিকে পরবর্তীতে গণতান্ত্রিক ধারায় বিএনপির ক্ষমতায় আরোহণের পথও সুগম হবে। দেশ ও দেশের প্রান্তিক জনতার স্বার্থে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া উভয়কেই জেদ পরিহার করে দেশ ও জনগণের স্বার্থ রক্ষায় আন্তরিক হতে হবে।

 

আপনার মতামত দিন