সাংবাদিকতায় কেনো ৫৭ ধারার খগড়!

823

নিত্যকার ঘটনা, দুর্ঘটনা আর নিয়মিত খবরের পাশাপাশি অনুসন্ধানী খবর পাঠকদের সামনে তুলে ধরা সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব। এই দায়িত্বের আওতায় একজন সাংবাদিক যেমন দেখেন তেমনই লেখেন। তিনি ভালোকে ভালো বলেন, মন্দকে মন্দ। তাই পেশাগত প্রয়োজনেই সাংবাদিকদের সংগ্রহ করা খবরে উঠে আসে নানামুখী ভালোমন্দের মিশেল।

কিন্তু সেই খবরে যদি কারো আপত্তি থাকে, তাহলে তা প্রকাশের ধারাবাহিক প্রক্রিয়া সংবাদমাধ্যমের স্বীকৃত রূপ। এজন্য কেউ কোনো খবরের প্রতিবাদ জানাতে চাইলে সে সুযোগ অবারিত। প্রতিবাদ প্রকাশে ব্যর্থ হলে তার জন্য খোলা আছে প্রেস কাউন্সিলের দরোজা। তাতেও সন্তুষ্ট না হলে ক্ষতিপূরণ মামলা ঠুকতেই পারেন যে কেউ।

কিন্তু গণমাধ্যমের মাথার ওপরে সম্প্রতি ঝুলিয়ে দেওয়া তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার জুজু সব স্বাভাবিক নিয়মকেই যেনো হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে? সাংবাদিকরা তো বটেই, আইনজীবীসহ সুশীল সমাজের কেউই এই আইনকে স্বাভাবিক বলে মেনে নিতে পারছেন না।

তাহলে কেনোইবা এমন অস্বাভাবিক আইন তৈরি করা হলো? তৈরির পর সমালোচনার মুখে এ আইন সংশোধনের প্রেক্ষিত তৈরি হলেও কেনো এতোদিনেও তা বাতিল বা সংশোধন হলো না? কেনো তথ্য-প্রযুক্তির অপরাধকে কেবল সাংবাদিকদের জন্য খড়গ হিসেবে ব্যবহার শুরু হলো? কেনো শুরু হলো সাংবাদিকদের গ্রেফতার, রিমান্ড, হাজতবাস?

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি এই আইন পাস হয় ২০০৬ সালে। ২০১৩ সালে এটি সংশোধন করা হয়। তারপর থেকেই ওই আইনের ৫৭ ধারা নিয়ে আলোচনা ও সমালোচনার ঝড় উঠে।

এ ধারায় বলা হয়েছে, (১) কোন ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েব সাইটে বা অন্য কোন ইলেক্ট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যাহা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেহ পড়িলে, দেখিলে বা শুনিলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হইতে উদ্বুদ্ধ হইতে পারেন অথবা যাহার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করিতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোন ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উস্কানি প্রদান করা হয়, তাহা ইহলে তাহার এই কার্য হইবে একটি অপরাধ৷

অন্য খবর  তরুনদের ভাবনা: করোনা থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় সচেতনতা

(২) কোন ব্যক্তি উপ-ধারা (১) এর অধীন অপরাধ করিলে তিনি ১ (অনধিক চৌদ্দ বৎসর এবং অন্যূন সাত বৎসর কারাদণ্ডে) এবং অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন৷

এখনো পর্যন্ত এ আইনে কারো ১৪ বছর জেল হয়নি বটে, কিন্তু ৫৭ ধারায় মামলা হয়েছে কয়েকটি। মামলার পরপরই হয়েছে গ্রেফতার আর রিমাণ্ডে নেওয়ার ঘটনা।

এসবকে আইনের অপব্যবহার আখ্যা দিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বাংলানিউজকে বলেন, আইনে ইন্টারনেটে মিথ্যা ও অশ্লীল প্রচারের বিষয়টি বলা হয়েছে। কিন্তু আমরা দেখলাম সংবাদ প্রকাশের পর ৫৭ ধারায় সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে। গ্রেফতার করা হচ্ছে।

কিন্তু কেন এই গ্রেফতার বা রিমাণ্ডের আবেদন এ প্রশ্ন রেখে মনজিল মোরসেদ বলেন, মামলা হওয়ার পর পুলিশ তদন্ত করবেন। যদি তথ্য উদঘাটন না করতে পারে তাহলে রিমাণ্ডের আবেদন করবেন। কিন্তু যে বিষয়বস্তু নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে,সেটা তো ইন্টারনেটে আছেই। সেখানে আবার তথ্য উদঘটনের জন্য রিমাণ্ড কেন?

তিনি বলেন, গ্রেফতার করে রিমাণ্ড আবেদন করা এখন একটা নিয়মে পরিণত হয়েছে। এটা তো ঠিক না। এছাড়া সংবাদ প্রকাশের কারণে নিয়ম অনুসারে প্রেস কাউন্সিলসহ যথাযথ ব্যবস্থায় না গিয়ে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে জেল খাটানোর চিন্তাও অসুস্থ মানসিকতা।

আইন সংশোধনের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের এ আইনজীবী বলেন, আমরা ইতিমধ্যে শুনেছি আইনটা সংশোধন হবে। কিন্তু সংশোধিত আইনে যদি ঘুরে ফিরে আগের বিষয়গুলো থাকে তাহলে তো কোন লাভ হবে না।

যদিও আশার কথা এই যে সম্প্রতি আইনমন্ত্রী বলেছেন, আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা যেভাবে আছে সেভাবে থাকবে না। ৫৭ ধারায় যে ব্যাপারগুলো নিয়ে আপত্তি ও অষ্পষ্টতা এবং যেখানে মনে হচ্ছে বাক স্বাধীনতা বন্ধের জন্য এটি করা হচ্ছে, সে গুলো পরিষ্কার করে দেওয়া হবে। কিন্তু কবে হবে এই সংশোধন? কবে নাগাদ স্বাধীন সাংবাদিকতার ওপরে চেপে বসা খড়গটা সরানো হবে?

অন্য খবর  তরুনদের ভাবনা: গুটিকয়েক মানুষ সচেতন হলেও বেশিরভাগ মানুষই অসচেতন

২০১৫ সালে ওই আইনের ৫৭ ধারার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ১১ ব্যক্তি রিট করেন। পরে প্রাথমিক শুনানি নিয়ে রুলও জারি করা হয়। যে রুল বিচারাধীন। ওই রিটে আইনজীবী ছিলেন ব্যারিস্টার জ্যোর্তিময় বড়ুয়া।

তিনি বলেন, ভয়টা প্রথম থেকেই ছিলো। আইনের ৫৭ ধারা উল্লেখ করে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা হবে। আর সেটাই হচ্ছে। এটা নিয়ে সাংবাদিকদের আরও বেশি সোচ্চার হওয়া দরকার ছিলো।

ব্যারিস্টার জ্যোর্তিময় বড়ুয়া বলেন, সাংবাদিকদের কাজ হচ্ছে লেখা। সমাজের ভালো-মন্দ সবই লিখবেন। কিন্তু ৫৭ ধারা অনুসারে (যাহা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেহ পড়িলে, দেখিলে বা শুনিলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হইতে উদ্বুদ্ধ হইতে পারেন) সাংবাদিকরা যে কোনো লেখার জন্য মামলায় পড়তে পারেন। কারণ আইনে বলছে ‘মিথ্যা বা অশ্লীল।’ এখন কোনটা মিথ্যা আর কোনটা সত্য সেটা নির্ধারণ করবে কোর্ট। কিন্তু এটা নির্ধারণের আগেই সাংবাদিকদের জেলে যেতে হচ্ছে। রিমাণ্ডের আবেদন করা হচ্ছে। আবার এই আইনের মামলায় জামিন পাওয়াও কঠিন।

তিনি বলেন, সংবাদ প্রকাশের পর স্ট্যান্ডার্ড নিয়ম হচ্ছে প্রতিবাদ দেওয়া। সেটা প্রকাশ না করলে প্রেস কাউন্সিলে অভিযোগ করা। আর সেখানে যদি নাও যান তাহলে মানহানি কিংবা ক্ষতিপূরণের মামলা করতে পারেন। কিন্তু এতসব না করে সোজা গিয়ে ৫৭ ধারায় মামলা ঠুকে দেন। এ ধারা বাদ না দিলে সাংবাদিকরা সেলফ সেন্সরশিপে চলে যাবে। আর সেটা হলে গুর্ড গভর্নেন্সও থাকবে না।

আপনার মতামত দিন