ঢাকা-১ (দোহার-নবাবগঞ্জ) আসনটি একসময় বিএনপির দুর্গ হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু নানা কারণে বিএনপির সেই অবস্থানে অনেকটা চিড় ধরেছে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জনের কারণে সারাদেশের অনেক আসনের মতো এই আসনেও বিএনপির অস্তিত্ব কিছুটা সংকটে পড়েছে।
সংসদীয় এ আসনে দলের হারানো মর্যাদা পুনরুদ্ধারে নির্বাচনের মাঠে শোনা যাচ্ছে তিন সম্ভাব্যপ্রার্থীর নাম। তবে, কাঙ্ক্ষিত জাতীয় মেরুকরণ করতে পারলে দলের বাইরের কাউকে এই আসনে ছাড় দিতে পারে বিএনপি।
স্থানীয় নেতাকর্মীদের আলোচনায় আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসেবে ঢাকা-১ আসন থেকে ধানের শীষের প্রতীক পেতে পারেন দলের ভাইস চেয়ারম্যান, সাবেক বিমান ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নান। এছাড়া আব্দুল মান্নানের মেয়ে মেহনাজ মান্নান এবং ঢাকা জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও নবাবগঞ্জ উপজেলার চেয়ারম্যান খন্দকার আবু আশফাকের নামও শোনা যাচ্ছে।
তবে ভেতরের খবর হলো, জোট রাজনীতির যোগ-বিয়োগে জাতীয় পার্টির সালমা ইসলামও এই আসন থেকে বিএনপির সমর্থন পেতে পারেন।
ঢাকা-১ আসনটি দোহার ও নবাবগঞ্জ উপজেলা নিয়ে গঠিত। ২০০৮ সালের সীমানা পুনর্বিন্যাসের কারণে সাবেক ঢাকা-১ ও ঢাকা-২ আসন সংযুক্ত করে ঢাকা-১ আসন করা হয়। এর আগে দোহার উপজেলা ঢাকা-১ এবং নবাবগঞ্জ উপজেলা ঢাকা-২ সংসদীয় আসনে অন্তর্ভুক্ত ছিল।
বিএনপি অধ্যুষিত এই আসন ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে দলটির হাতছাড়া। ওই নির্বাচনে বিএনপিপ্রার্থী সাবেক বিমান ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নান হেরে যান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটপ্রার্থী অ্যাডভোকেট আবদুল মান্নান খানের কাছে।
২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি ও তার মিত্র জোট। সীমানা পুনর্বিন্যাসের আগে ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচনে এই অঞ্চলের নির্বাচনী এলাকা তৎকালীন ঢাকা-১ (দোহার) থেকে বিএনপিপ্রার্থী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা এবং তৎকালীন ঢাকা-২ (নবাবগঞ্জ) থেকে বিএনপিপ্রার্থী আবদুল মান্নান টানা চারবার এমপি নির্বাচিত হন।
বিএনপির স্থানীয় নেতাকর্মীরা জানান, এই আসনে আগামী নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীদের তালিকায় আব্দুল মান্নান ও আবু আশফাকের নাম রয়েছে সবার ওপরে।
দলের জ্যেষ্ঠ নেতা হিসেবে হাইকমান্ডের কাছে বিশেষ কদর রয়েছে আব্দুল মান্নানের। বিশ্বস্ত আর অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ হিসেবে জিয়া পরিবারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত তিনি। অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান হিসেবে দলে তার সুখ্যাতিও রয়েছে। তবে বয়সের কারণে সাবেক প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নান নির্বাচনে অংশ না নিলে তার মেয়ে ব্যারিস্টার মেহনাজ মান্নান এই আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বলে গুঞ্জন রয়েছে। মেহনাজ মান্নান বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার নাসির উদ্দিন অসীমের সহধর্মিনী। যুক্তরাজ্যের লিঙ্কনস ইন থেকে বার অ্যাট ল ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। দেশে ফিরে এসে বাবার রাজনৈতিক ও অন্যান্য কাজে সহযোগিতা করছেন মেহনাজ। তবে বর্তমানে তিনি লন্ডনে অবস্থান করছেন।
এদিকে, নবাবগঞ্জ উপজেলার টানা দুবারের চেয়ারম্যান খন্দকার আবু আশফাকও বিএনপির শক্তিশালী সম্ভাব্যপ্রার্থী হিসেবে রয়েছেন। মান্নান পরিবারের বাইরের প্রার্থী হিসেবে দীর্ঘদিন এলাকায় কাজ করছেন তিনি। তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে তার যোগাযোগ রয়েছে। ছাত্রদল থেকে উঠে আসা এই নেতাকে নিয়ে এলাকার তরুণ নেতাকর্মীরা অনেকটা উজ্জীবিত। নেতাকর্মীদের যেকোনো বিপদেও পাশে দাঁড়ান তিনি।
ঢাকা-১ আসনে বিএনপির মনোনয়ন প্রসঙ্গে কথা হয় দোহার উপজেলা বিএনপির সভাপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদের। তিনি বলেন, ‘অত্র এলাকায় দুজনের নামই সবার মুখেমুখে। তারা হলেন- আব্দুল মান্নান ও আবু আশফাক। তবে দলীয় মনোনয়নের বিষয়টি নির্ভর করবে মনোনয়ন বোর্ডের ওপর।’
‘আমার ব্যক্তিগত মতামত হলো, যিনি সর্বদা তৃণমূল নেতাকর্মীদের পাশে রয়েছেন তারই মনোনয়ন পাওয়া উচিত। এক্ষেত্রে আবু আশফাকের নাম আসে সবার আগে। মান্নান ভাইয়ের বয়স হয়েছে, এছাড়া নেতাকর্মীদের সঙ্গেও ওনার যোগাযোগ নেই। এলাকার কোনো কর্মসূচিতে তাকে পাওয়া যায় না। মান্নান ভাইয়ের মেয়ের সঙ্গেও এলাকার নেতাকর্মীদের যোগাযোগ নেই। এসব দিক বিবেচনায় আশফাক এগিয়ে আছেন।’
সাহাবুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বিএনপির প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে এখানে শক্তিশালী কোনো প্রার্থী নেই। যদি সুষ্ঠু নির্বাচন হয় তাহলে কোনোভাবেই আওয়ামী লীগ এ আসনে পাস করবে না। আর যদি জোর করে ছিনিয়ে নেয়া হয়, সেটা ভিন্ন কথা। তারপরও যারা মূল প্রতিদ্বন্দ্বী, তাদের মধ্যে গ্রুপিং রয়েছে। প্রত্যেক গ্রুপেরই আবার একজন করে নেতা রয়েছেন। আওয়ামী লীগের রয়েছেন সালমান এফ রহমান, মান্নান খান, মাহাবুবুর রহমান। জাতীয় পার্টির রয়েছেন সালমা ইসলাম। তবে প্রতিদ্বন্দ্বী যারা রয়েছেন তাদের মধ্যে সালমা ইসলাম এগিয়ে আছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘একসময় এখানকার ভোটারদের মধ্যে ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার প্রভাব ছিল। কিন্তু এখন তার ভক্ত-সমর্থক নেই বললেই চলে।’
নবাবগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি আজাদুল ইসলাম হাই বলেন, ‘প্রাক্তন মন্ত্রী আব্দুল মান্নান। তিনি আমদের সম্মানিত ব্যক্তি ও নেতা। উনি অসুস্থ কিন্তু বিএনপির প্রতি ওনার যে অবদান, তারই ফলশ্রুতিতে ওনাকে সুন্দর একটা অবস্থানে রাখা হয়েছে। আশা করি সুন্দরভাবে ওনার রাজনীতির ইতি হবে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে স্বাভাবিক রাজনীতি তার পক্ষে করা সম্ভব নয়। অপরদিকে, খন্দকার আবু আশফাককে ৯০ ভাগ মানুষ সমর্থন করেন। তার প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো প্রার্থী অত্র এলাকায় নেই।’
আব্দুল মান্নানের মেয়ে মেহনাজ মান্নান সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আসলাম, দেখলাম আর হয়ে গেলাম; এমন তো নয়। গ্রাউন্ড ওয়ার্ক তো করা প্রয়োজন। তিনি ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি নিতে পারেন। কারণ রাজনীতির মাঠ তো কারও একার নয়। কর্মীদের আস্থায় আনতে হবে।’
বিএনপির প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমাদের ভাবী সালমা ইসলাম রয়েছেন। দেশের শীর্ষ ধনী সালমান এফ রহমানও এখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন। ওনাদের জাতীয় পর্যায়ে ইমেজ রয়েছে। এর প্রভাব স্থানীয় পর্যায়েও পড়তে পারে। তবে এখানে যে-ই নির্বাচন করুক ভোটের রাজনীতিতে বিএনপি এগিয়ে আছে।’